সরকারি দফতরে ডাঁই হয়ে থাকা ফাইলের স্তূপ। কিংবা ভাঙা চেয়ার, খারাপ হয়ে যাওয়া আলমারি। এ সব পরিষ্কার করতে করতেই রাজকোষে চলে এল কোটি কোটি টাকা! অঙ্কটা চমকে দেওয়ারই মতো। প্রশাসনিক ভবনগুলি থেকে ওই আবর্জনা বিদায় করে ৮০০ কোটি টাকা পেয়েছে কেন্দ্র। পরিমাণটা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন’ বা ইসরোর ‘চন্দ্রযান-৩’-এর জন্য বরাদ্দ করা অর্থের চেয়ে ১৮৫ কোটি বেশি বলে জানা গিয়েছে।
কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে প্রশাসনিক ভবনগুলি থেকে স্ক্র্যাপ বা বাতিল কাগজপত্র, ফাইল, আসবাব ও অন্যান্য আবর্জনা বিক্রি করে রেকর্ড অর্থ পেয়েছে সরকার। চার বছর আগে ২০২১ সালে সংশ্লিষ্ট অভিযানের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই সময় থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত এগুলি বিক্রি করে সরকারের আয়ের পরিমাণ ছুঁয়েছে প্রায় ৪,১০০ কোটি।
এ বছরের ২ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অফিস পরিষ্কারের কাজ চালায় কেন্দ্র। বাতিল কাগজ, ফাইল এবং ভাঙাচোরা আসবাব বিক্রি হওয়ায় দফতরগুলিতে সব মিলিয়ে ২৩২ লক্ষ বর্গফুট জায়গা খালি করতে সক্ষম হয়েছে প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, বিক্রি হওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল ২৯ লক্ষ কাগজের ফাইল। গত চার বছরের নিরিখে এ বারের সাফাই অভিযানকে বৃহত্তম বলা যেতে পারে। এতে সাড়ে ১১ লক্ষেরও বেশি অফিস পরিষ্কার করেছে প্রশাসন।
কেন্দ্র জানিয়েছে, গোটা বিষয়টির তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিন জন মন্ত্রী। তাঁরা হলেন মনসুখ মাণ্ডবীয়ব্য, কে রামমোহন নাইডু এবং জিতেন্দ্র সিংহ। সরকারি অফিসের বাতিল জিনিস বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশাসনিক সংস্কার ও জন অভিযোগ বিভাগকে (ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস অ্যান্ড পাবলিক গ্রিভান্সেস বা ডিএআরঅ্যান্ডপিজি)। স্ক্র্যাপ পরিষ্কার এবং বিক্রির সময় আন্তঃমন্ত্রক সমন্বয় সাধনের কাজটি করেছে তারা।
গত অক্টোবরে মোট ৫৪টি মন্ত্রকের বাতিল ফাইল, নথি, ভাঙা চেয়ার এবং আসবাব সাফাইয়ের কাজ সম্পন্ন করেছে প্রশাসনিক সংস্কার ও জন অভিযোগ বিভাগ। এর মধ্যে একাধিক বিদেশি মিশনে যুক্ত দফতরও রয়েছে। ২০২১-’২৫ সালের মধ্যে মোট পাঁচ বার সরকারি দফতরগুলিতে সংশ্লিষ্ট অভিযান চালিয়েছে কেন্দ্র। গোটা বিষয়টি মোদী প্রশাসনের স্বচ্ছতা অভিযানের অন্তর্ভুক্ত বলে জানা গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারের বেশ কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এই অভিযানে মোট ২৩.৬২ লক্ষ অফিসকে অন্তর্ভুক্ত করে মোদী প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির ৯২৮.৮৪ লক্ষ বর্গফুট এলাকা দখল করে রেখেছিল বাতিল ফাইল। এর মাধ্যমে সেই জায়গা পুনরুদ্ধার করা হল। সংশ্লিষ্ট অভিযানে বিক্রি হয়েছে মোট ১৬৬.৯৫ লক্ষ বাতিল ফাইল। এই বিক্রি থেকে ৪,০৯৭.২৮ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলেছে কেন্দ্র।
কেন্দ্রীয় দফতরগুলি থেকে বাতিল ফাইল বিক্রি করার কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। সূত্রের খবর, এর জন্য মন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বহু বার বৈঠক করতে হয়েছে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা তিন মন্ত্রীকে। এ ছাড়া মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছে। অভিযান চলাকালীন এই প্রক্রিয়ায় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরগুলিতে ফাইল পরিষ্কারের কাজ চলার মধ্যেই ‘চন্দ্রযান-৩’ মিশনে সাফল্য পায় ইসরো। ২০২৩ সালের ২৩ অগস্ট প্রথম দেশ হিসাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটির পাঠানো নভোযানের ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। এর পর প্রায় দু’সপ্তাহ পৃথিবীর উপগ্রহটির বুকে হেঁটেচলে বেরিয়েছিল এর রোভার ‘প্রজ্ঞান’। চাঁদের বুকে ওই অবতরণস্থলের নাম ‘শিব শক্তি পয়েন্ট’ দিয়েছেন মোদী। গোটা মিশনটির মোট বাজেট ছিল মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা।
এর পাশাপাশি বৈদ্যুতিন বর্জ্য ঘেঁটে বিরল ধাতু বার করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। এর জন্য ১,৫০০ কোটি টাকার বিশেষ পুরস্কার-প্রকল্পের (ইনসেন্টিভ স্কিম) ঘোষণা করেছে মোদী সরকার। তাতে সাফল্য এলে ভারতের হাতে জ্যাকপট লাগবে বলে দাবি করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
গত কয়েক বছরে এ দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে বৈদ্যুতিন পণ্যের ব্যবহার। আমজনতার প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। কম্পিউটার-ল্যাপটপ ছাড়া অফিস-আদালত অচল। এ ছাড়া রয়েছে স্মার্টঘড়ি, ট্যাব বা অন্যান্য গেমিং ডিভাইস। এর জেরে শহর বা গ্রামাঞ্চলে ক্রমাগত জমা হচ্ছে বিপুল পরিমাণে বৈদ্যুতিন বর্জ্য, যা এ বার পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা করল কেন্দ্র।
বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের চিপ থেকে ব্যাটারি— সব কিছুতেই ব্যবহার হয় কোনও না কোনও বিরল ধাতু। আর তাই এর বর্জ্য পরিশোধন করে সেগুলি বার করে নিতে চাইছে কেন্দ্র। বাতিল বৈদ্যুতিন সামগ্রী এবং ফেলে দেওয়া ব্যাটারি থেকে লিথিয়াম, কোবাল্ট এবং নিকেলের মতো বিরল ধাতু পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেই কারণে বিশেষ পুরস্কার-প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে খনি মন্ত্রক।
চলতি বছরের ৪ অক্টোবর ‘জাতীয় জটিল খনিজ মিশন’-এর (ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল মিনারেল মিশন) অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। বৈদ্যুতিন বর্জ্য থেকে বিরল খনিজ বার করে আনার প্রকল্পটিকে এরই অন্তর্ভুক্ত করেছে খনি মন্ত্রক। সেই মোতাবেক অক্টোবরেই একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রশাসন।
ঘরের মাটিতে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম তৈরিতে চাই বিপুল পরিমাণে বিরল খনিজ। সারা বিশ্বে এর উপর সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। খনি মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিদের কথায়, বিপুল পরিমাণে বৈদ্যুতিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সেই চাহিদা কিছুটা মেটানো গেলে কমবে বিদেশি নির্ভরশীলতা। সেই কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় খনি মন্ত্রকের দাবি, বৈদ্যুতিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি শিল্প সংস্থা। এর জন্য নিয়ম মেনে সরকারের কাছে আবেদনপত্র জমা করেছে তারা। কী ভাবে গোটা প্রক্রিয়াটি শুরু হবে, তার নীলনকশা ছকে ফেলা হয়েছে। চলতি বছরের শেষের দিকে ফেলে দেওয়া বৈদ্যুতিন সামগ্রী থেকে বিরল ধাতু বার করার প্রক্রিয়াটি শুরু হবে, খবর সূত্রের।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে ফি বছর জমা হয় প্রায় ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন বৈদ্যুতিন বর্জ্য। এর মধ্যে আবার রয়েছে ৬০ কিলোটন ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) বাজেটে বাতিল বা ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি আমদানির উপর শুল্ক বাতিল করে কেন্দ্র। এর জেরে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বৈদ্যুতিন বর্জ্য পরিশোধন এবং পুনর্ব্যবহারের দিকে দেশীয় শিল্প সংস্থাগুলির আগ্রহ বাড়বে বলে আশাবাদী সরকার।