কখনও ভারতে পরমাণু হামলার হুমকি। কখনও আবার পাকিস্তানকে নুড়িভর্তি ডাম্পারের সঙ্গে তুলনা। ইসলামাবাদের ‘সিপাহ্সালার’ ফিন্ড মার্শাল আসিম মুনিরের একের পর এক মন্তব্যে উঠেছে বিতর্কের ঝড়। সেই তালিকাকে দীর্ঘ করে এ বার ‘মৃত্যুর ইচ্ছা’ প্রকাশ করলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাপতি। ফলে এই উপমহাদেশের আণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা ঘিরে ফের তীব্র হয়েছে জল্পনা।
সম্প্রতি, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় প্রাণ হারান ১০ সৈনিক। রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি সদর দফতরে তাঁদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনির। সেখানেই ‘মৃত্যু ইচ্ছা’ প্রকাশ করেন তিনি, যা নিয়ে শুরু হয়েছে হইচই।
সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে মুনির বলেন, ‘‘আমি একজন সত্যিকারের সৈনিক। দেশরক্ষার জন্যেই এই পৃথিবীতে এসেছি। আর তাই রণাঙ্গনে শহিদ হতে চাই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা।’’ এর পাশাপাশি পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ভারতের নাম জড়িয়ে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে নিশানা করেন তিনি। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেয় কাবুল এবং নয়াদিল্লি।
ফিল্ড মার্শাল মুনিরের দাবি, পাকিস্তানের দয়াতেই টিকে আছে আফগানিস্তান। কিন্তু ভারতের কথায় বার বার জঙ্গি হামলা চালাচ্ছে সেখানকার তালিবান সরকার। এর পরেই টিটিপির সঙ্গে কাবুল প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার অভিযোগ তোলেন ইসলামাবাদের ‘সিপাহ্সালার’। নিহত সৈনিকদের অবশ্য ‘ইস্পাতের দেওয়াল’ বলে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি।
এ দেশের সাবেক সেনাকর্তাদের অবশ্য দাবি, যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে লড়তে বীরের মৃত্যু বরণ করার মতো কলজের জোর নেই পাক সেনাপ্রধানের। ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা সংঘাতের সময় মেলে তার ইঙ্গিত। সূত্রের খবর, ওই সময় প্রাণভয়ে বাঙ্কারে আশ্রয় নেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। দুই থেকে চার ঘণ্টা সেখানে লুকিয়ে ছিলেন তিনি।
চলতি বছরের ৯ মে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাক বিমানবাহিনীর একাধিক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। সেই তালিকায় ছিল নুর খান ছাউনিও। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের এই ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকায় পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েন রেখেছিলেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। সূত্রের খবর, সেখানে নয়াদিল্লির ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়তেই বাঙ্কারে ছোটেন মুনির।
একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের মধ্যে একটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে ছিলেন পাক সেনাপ্রধান। ঠিক তার পরের দিন (পড়ুন ১০ মে) নিজের পরিবারের সদস্যদের কূটনৈতিক পাসপোর্টে বিদেশে পাঠিয়ে দেন তিনি। ফিল্ড মার্শাল মুনিরের এ-হেন ভূমিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদসংস্থা লেখে, ‘‘গর্জন করা সিংহ এখন ইঁদুরে পরিণত হয়ে কাঁপছে।’’
যদিও এ সব বাঁকা কথা একেবারেই গায়ে মাখেননি পাক সেনাপ্রধান। ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি হতেই তাঁর জন্যই যুদ্ধে জয় এসেছে বলে প্রচার শুরু করেন মুনির। গত ২১ মে পদোন্নতি হয় তাঁর। জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শালে উত্তীর্ণ হন তিনি। ইসলামাবাদের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে মুনিরই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই বিরল পদ পেলেন। প্রথম জন হলেন মহম্মদ আয়ুব খান, যাঁর হাত ধরে প্রথম বার সেনাশাসনের স্বাদ পায় পশ্চিমের প্রতিবেশী।
মুনির ফিল্ড মার্শাল হওয়া ইস্তক তাঁর সঙ্গে শুরু হয়েছে আয়ুবের তুলনা। ফলে বার বার সামনে আসছে একটা প্রশ্ন। এ বার কি তবে পূর্বসূরির রাস্তায় হেঁটে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করবেন পাক সেনাপ্রধান? এই নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ইসলামাবাদের জিয়ো গোষ্ঠীর বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুহেল ওয়ারাইচ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে থাকাকালীন এ ব্যাপারে মুনিরের একান্ত সাক্ষাৎকার মিলেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
ওয়ারাইচ লিখেছেন, ‘‘ব্রাসেল্সে পাক ফিল্ড মার্শাল জানিয়েছেন এই মুহূর্তে ঘরোয়া রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই। যাঁরা সরকার এবং কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা করছেন এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চান, তাঁরাই এই ধরনের গুজব ছড়াচ্ছেন।’’ এর সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও সেখানে স্পষ্ট করে দেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান।
ওয়ারাইচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিজের সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তরে মুনির বলেন, ‘‘ঈশ্বর আমাকে দেশের রক্ষক হিসাবে গড়েছেন। সেটা ছাড়া অন্য কোনও ক্ষমতা আমার চাই না।’’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছরের অগস্টে দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন সফরে যান ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান। সেখান থেকে ফেরার পথে ব্রাসেল্সে থেমেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন ১০ অগস্ট ফ্লরিডার টাম্পায় সাম্মানিক কনসাল তথা শিল্পপতি আদনান আসাদ আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন পাক সেনাপ্রধান। সেখানে অবশ্য গণমাধ্যমের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু, পরে বেশ কয়েকটি সূত্রকে উল্লেখ করে ‘দ্য প্রিন্ট’ জানিয়েছে, নৈশভোজে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের প্রসঙ্গ তোলেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। তখনই ভারতকে চরম হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
‘দ্য প্রিন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই অনুষ্ঠানে পাক সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘ভারত বাঁধ তৈরি করুক, আমরা অপেক্ষা করব। যখন বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখনই ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সেটা ধ্বংস করে দেব। সিন্ধু নদী ওদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আর আমাদের কাছেও ক্ষেপণাস্ত্রের কোনও অভাব নেই।’’ এর পাশাপাশি জনপ্রিয় জার্মান সংস্থা ‘মার্সেডিজ়’-এর তৈরি বিলাসবহুল গাড়ির সঙ্গে নয়াদিল্লির তুলনাও টানেন ফিল্ড মার্শাল মুনির।
সূত্রের খবর, নৈশভোজের অনুষ্ঠানে পাক সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘ভারত হাইওয়ের উপর দিয়ে আসতে থাকা ঝাঁ-চকচকে একটা মার্সেডিজ়, ঠিক ফেরারির মতো। কিন্তু আমরা নুড়িভর্তি ট্রাক। গাড়িটাকে যদি ট্রাক ধাক্কা দেয়, পরাজয় কার হবে?’’ এর পরই ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে এনে নয়াদিল্লিকে খোঁচা দেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। বলেন, ‘‘লড়াইয়ে লোকসানের হিসাব প্রকাশ্যে আনার সৎ সাহস নেই ভারতের। সেই কারণে ওই তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে তারা।’’
চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকার পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ধর্মপরিচয় জিজ্ঞাসা করে তাঁদের গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনার কয়েক দিন আগেই একটি অনুষ্ঠানে ‘দ্বিজ়াতি তত্ত্ব’-এর উল্লেখ করে উস্কানিমূলক মন্তব্য করেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। তাঁর নির্দেশেই পহেলগাঁও-কাণ্ড ঘটে বলে মনে করেন এ দেশের দুঁদে গোয়েন্দাকর্তাদের বড় অংশ।
জম্মু-কাশ্মীরে ওই সন্ত্রাসী হামলার পর ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে ভারত। পাশাপাশি, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে পহেলগাঁও-কাণ্ডের বদলা নেয় ভারতীয় ফৌজ। পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে-তে (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) একাধিক জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় এ দেশের সেনা। এর পরই সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে পাল্টা ভারতীয় সেনার একাধিক সামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজ।
পাক ফৌজের এই প্রত্যাঘাতের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন বুনিয়ান-আন-মারসুস’। এর মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাব থেকে শুরু করে রাজস্থান ও গুজরাত সীমান্তে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করে ইসলামাবাদ। ভূস্বর্গে নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসি (লাইফ অফ কন্ট্রোল) পেরিয়ে আছড়ে পড়ে কামান ও মর্টারের গোলাও। এর অধিকাংশকেই মাঝ-আকাশে ধ্বংস করে এ দেশের বাহিনী।
এর পর ইসলামাবাদকে শিক্ষা দিতে প্রথমে ড্রোন হামলা চালিয়ে চিনের তৈরি ‘এইচকিউ-৯পি’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। পরে পাক বায়ুসেনার একাধিক ছাউনিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় নয়াদিল্লি। ফলে তাদের বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। সূত্রের খবর, এর জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়াদিল্লির ফৌজ।
ভারতের এই প্রত্যাঘাতের পরেই সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব দেয় ইসলামাবাদ। পরে যুদ্ধ থামলে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা জানান, লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন। যদিও ১৫০-র বেশি পাক সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে বলে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে স্থানীয় ‘সামা টিভি’র পোর্টাল। নিহতদের নামের তালিকাও সেখানে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে ওই প্রতিবেদন পোর্টাল থেকে মুছে দেয় সংশ্লিষ্ট পাক সংবাদসংস্থা।
প্রাক্তন ভারতীয় হাই কমিশনার তথা কূটনীতিক জি পার্থসারথি ফিল্ড মার্শাল মুনির সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘পাক সেনাপ্রধান ধর্মান্ধ এবং মিথ্যা কথায় পারদর্শী। মেকি বীরত্বের কথা বলে নিজের উপরে আসা অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন তিনি। কয়েক বছর আগে তাঁকে ‘কোর্ট মার্শাল’ করা হয়েছিল। সেনা আদালতের সেই মামলা থেকে এখনও অব্যাহতি পাননি মুনির। সেই কারণেই ঘন ঘন হুঙ্কার ছাড়তে দেখা যাচ্ছে তাঁকে।’’