সদ্য বাহিনীতে যুক্ত হওয়া স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে পাকিস্তান। নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) ও পারে সেই অস্ত্র মোতায়েন করেছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। মাঝ আকাশে পাক মারণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারবে ভারতের হাতে থাকা রুশ ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)? এই নিয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। এ দেশের সেনাকর্তারা অবশ্য এই নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি।
সম্প্রতি নিয়ন্ত্রণরেখার ও পারে ‘ফতেহ টু’ নামের স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (শর্ট রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল বা এসআরবিএম) মোতায়েন করে ইসলামাবাদ। একে নয়াদিল্লির ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে মস্কোর তৈরি ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর উপর মূলত ভরসা রেখেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। বর্তমানে এর তিনটি ইউনিট মোতায়েন রয়েছে পাকিস্তান ও চিন সীমান্তে।
পাক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ‘ফতেহ টু’-র প্রথম পরীক্ষা চালান রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। গত বছরের মে মাসে সৈনিকদের এই হাতিয়ার চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইসলামাবাদের দাবি, বর্তমানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’গুলির ‘অ্যান্টিডট’ হিসাবে এই অস্ত্রটিকে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ চোখের নিমেষে ‘এস-৪০০’র কবচ ভেদ করে ভারতীয় সেনার সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ শানাতে পারবে ‘ফতেহ টু’।
এ হেন স্বল্পপাল্লার পাক ক্ষেপণাস্ত্রটি ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম বলে জানা গিয়েছে। যুদ্ধের সময়ে এর সাহায্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সেনাছাউনি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কমান্ড এবং কন্ট্রোল সেন্টার, এমনকি ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কেও ওড়ানো যাবে বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ। ‘এস-৪০০’কে ধ্বংস করার কথা মাথায় রেখেই নাকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ‘ফতেহ টু’ নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর।
চলতি বছরের ৩ মার্চ ‘ফতেহ টু’ নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসির কাছে মোতায়েনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ইসলামাবাদ। এর সাহায্যে পাক সেনা যে ভারতের মজবুত প্রতিরক্ষার বেড়াজাল ভাঙতে চাইছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শাহবাজ় শরিফ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় হাওয়া দিল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
পাকিস্তানের সরকারি সংস্থা ‘গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিজ় অ্যান্ড ডিফেন্স সলিউশন’-এর (জিআইডিএস) হাত ধরে জন্ম হয়েছে ‘ফতেহ টু’র। এর আগে ‘ফতেহ ১’ নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে এই সংস্থা, যার পাল্লা ছিল মাত্র ১৪০ কিলোমিটার। ওই সময় থেকেই হাতিয়ারটির পাল্লা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে ‘ফতেহ টু’র মোতায়েন নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছে পাক গুপ্তচর সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস’ বা আইএসপিআর। তাঁদের কথায়, ‘‘এই ক্ষেপণাস্ত্রে রয়েছে অত্যাধুনিক দিক নির্দেশকারী ব্যবস্থা (নেভিগেশন সিস্টেম)। হাতিয়ারটিকে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যে কায়দায় এটি উড়বে, তাতে কোনও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষেই একে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।’’
উল্লেখ্য, বিশেষ ধরনের একটি গাড়ির উপরে লঞ্চারে ‘ফতেহ টু’ ক্ষেপণাস্ত্রটিকে রাখা হয়েছে। ফলে যুদ্ধের সময়ে দ্রুত একে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যেতে পারবে পাক সেনা। ওই গাড়ি এবং লঞ্চার ইসলামাবাদকে চিনা প্রতিরক্ষা সংস্থা সরবরাহ করেছে বলে জানা গিয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেয়নি আইএসপিআর।
ভারতের আকাশকে সুরক্ষিত করতে ২০২১ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর প্রতিরক্ষাচুক্তি করে নয়াদিল্লি। এ দেশের বায়ুসেনাকে এই হাতিয়ার তুলে দিতে ৫৪০ কোটি ডলার খরচ করছে কেন্দ্র। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’টির মোট পাঁচটি ব্যাটারি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্রেমলিন। কিন্তু, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা দিতে পারেনি রাশিয়া। এখনও পর্যন্ত মোট তিনটি ‘এস-৪০০’ নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করেছে মস্কো।
রুশ ‘এস-৪০০’কে দুনিয়ার আধুনিকতম ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা (সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম) বলে গণ্য করা হয়। গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়েছে এই হাতিয়ার। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মস্কো-সহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহরকে যে ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে কিভ নিশানা করতে পারেনি, তার অন্যতম কারণ হল ‘এস-৪০০’। সেগুলিকে মাঝ আকাশেই ধ্বংস করেছে ক্রেমলিনের কবচ।
‘এস-৪০০’-এ মোট তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সেগুলির পাল্লা ৪০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার। এ ছাড়া ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’টির সঙ্গে জুড়ে আছে অত্যাধুনিক রাডার। তার নজর এড়িয়ে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ শানানো বেশ কঠিন। কিন্তু, তার পরেও পাক ফৌজের দাবিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, ক্রেমলিনের কবচ ভেদ করার একমাত্র উপায় হল, ‘ফতেহ টু’র মতো কয়েকশো ক্ষেপণাস্ত্র একসঙ্গে ছুড়ে দেওয়া। পাশাপাশি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসবে আত্মঘাতী ড্রোন। সে ক্ষেত্রে সব ক’টি ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা ‘এস-৪০০’র পক্ষে সম্ভব হবে না। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র এই গলদ গত দেড় বছর ধরে চলা পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে নজরে এসেছে। পাক জেনারেলরা সেটাই ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্যালেস্টাইনপন্থী হামাস, হিজ়বুল্লা, হুথি এবং ইরানের সঙ্গে টানা দেড় বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়েছে ইজ়রায়েল। ইহুদি ফৌজের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ভাঙতে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। ফলে হামাস, হিজ়বুল্লা, হুথি বা ইরানের ছোড়া অধিকাংশ রকেটকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে পারলেও কিছু কিছু আছড়ে পড়ে ইজ়রায়েলের বুকে। তখনই ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র গলদ সকলের নজরে চলে আসে।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফকে মোট তিন ধরনের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। সেগুলি হল, আয়রন ডোম, অ্যারো এবং ডেভিড্স স্লিং। এ ছাড়াও ইহুদিভূমিকে রক্ষা করতে সেখানে ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড মোতায়েন করেছে আমেরিকা। অন্য দিকে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ভারতীয় বায়ুসেনাকে মূলত ‘এস-৪০০’র উপরে ভরসা করতে হবে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
তৃতীয়ত, বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ‘এস-৪০০’কে সরাসরি নিশানা না করে এর সঙ্গে যুক্ত রাডার এবং কমান্ড-কন্ট্রোল সিস্টেমকে ওড়ানোর ছক কষতে পারে পাক ফৌজ। তাতে সাফল্য পেলে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’টি হাতে থাকা সত্ত্বেও, সেটিকে ব্যবহার করতে পারবে না বায়ুসেনা। একেও নয়াদিল্লির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বল্পপাল্লার ‘ফতেহ টু’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পঞ্জাব এবং রাজস্থানের বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করতে পারে পাক ফৌজ়। গত কয়েক বছরে জম্মু-কাশ্মীরে সিন্ধু নদীর একাধিক শাখা নদীতে বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে নয়াদিল্লি। ‘ফতেহ টু’র নিশানায় সেগুলিও থাকবে বলে মিলেছে সতর্কতা। অস্ত্রটি ইতিমধ্যেই গোলন্দাজ বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে ইসলামাবাদ।
তবে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা মুখে যতই বড় বড় কথা বলুন না কেন, ‘এস-৪০০’-এর ক্ষমতা নিয়ে এখনই প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত রাডার ৬০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকেও চিহ্নিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্রেমলিনের কবচে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রগুলির গতিবেগ চার থেকে ছয় ম্যাক। অর্থাৎ শব্দের চার থেকে ছ’গুণ গতিতে ছুটতে পারে ‘এস-৪০০’-এর ক্ষেপণাস্ত্র।
তৃতীয়ত, বর্তমানে চিনের তৈরি ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ব্যবহার করে পাক সেনা। এর ফাঁকফোকর ইতিমধ্যেই বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। ২০২২ সালের ৯ মার্চ ভুল করে একটি ‘ব্রহ্মস সুপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির দিকে ছুড়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। পাক আকাশসীমার ১০০ কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে শব্দের চেয়ে তিন গুণ গতিতে আছড়ে পড়ে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ওই ক্ষেপণাস্ত্র।
চিনা কবচ যে ‘ব্রহ্মস’কে চিহ্নিতই করতে পারেনি, তা ওই সময়ে একরকম স্বীকার করে নেয় ইসলামাবাদ। ফলে যুদ্ধের সময়ে এই বিষয়টিও রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের মাথায় রাখতে হবে। তা ছাড়া ইতিমধ্যেই রুশ ‘প্যানস্টার’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হাতে পাওয়ার জন্য মস্কোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। হাতিয়ারটির প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাবও দিয়েছে ক্রেমলিন।
পাশাপাশি ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’-এর পাল্লা বৃদ্ধির চেষ্টা চলাচ্ছে এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। বর্তমানে এই হাতিয়ারটির পাল্লা ৭৫ থেকে ১২০ কিলোমিটার। পাশাপাশি ‘মহেশ্বরাস্ত্র’ নামের একটি নতুন ধরনের রকেট তৈরি করছে সোলার ইন্ডাস্ট্রিজ়। এর পাল্লা প্রায় ২৯০ কিলোমিটার হবে বলে জানা গিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ‘এস-৪০০’ নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করতে পারেননি রাশিয়া। আর তাই কিছু দিন আগে মস্কো সফরে যান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। দ্রুত অস্ত্রটি সরবরাহ করার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে, পাক ফৌজ সীমান্তে ‘ফতেহ টু’র মতো হাতিয়ার মোতায়েন করায় ‘আকাশ’ এবং ‘বারাক-৪’-এর মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে সীমান্তের দিকে রওনা করেছে নয়াদিল্লি।