আতঙ্কের নাম ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র! রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের ১১টি বায়ুসেনা ঘাঁটিকে। ডাহা ফেল করেছে ইসলামাবাদের হাতে থাকা চিনের তৈরি জোড়া আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে চিহ্নিতই করতে পারেনি বেজিঙের এইচকিউ-৯পি এবং এইচকিউ-১৬। আর তাই এ বার জার্মানদের শরণাপন্ন হচ্ছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এতে নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
‘ব্রহ্মস’-এর মতো ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ ঠেকাতে আইআরআইএস-টি (ইনফ্রারেড ইমেজ়িং সিস্টেম-টেইল) নামের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে জার্মান ফৌজ। সূত্রের খবর, বর্তমানে এই হাতিয়ারটিই বাহিনীতে শামিল করতে চাইছে পাক সরকার ও সেনা। স্বল্পপাল্লার ‘ভূমি থেকে আকাশ’ (সারফেস টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্রটির অপর নাম ‘এম-২০০০’। মাটিতে বসানো লঞ্চার বা এসএলএমের (পড়ুন সারফেস লঞ্চড মিসাইল) মাধ্যমে ছুড়ে এর সাহায্যে আনায়াসেই ধ্বংস করা যায় শত্রুর ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র।
২০০৫ সাল থেকে আইআরআইএস-টির বহুল ব্যবহার করে আসছে জার্মানি। এ ছাড়া ইউরোপের মার্কিন শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটোভুক্ত (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) বেশ কয়েকটি দেশের বাহিনীর কাছেও রয়েছে এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে জাত চিনিয়েছে সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স। রাশিয়ার বহু ক্ষেপণাস্ত্রকে শূন্যে ধ্বংস করে বর্তমানে খবরের শিরোনামে রয়েছে ‘বার্লিনের বর্ম’।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, গত বছর আইআরআইএস-টি এসএলএমের বেশ কয়েকটি ইউনিটকে মিশর থেকে উড়িয়ে আনা হয়। পরে সেগুলি ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সরবরাহ করে জার্মান সরকার। ফলে দুর্ভেদ্য কবচে দেশের আকাশ ঢেকে ফেলার সুযোগ পায় কিভ। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, নিখুঁত নিশানায় একসঙ্গে ৬০টির বেশি শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে মাটিতে নামিয়ে আনার ক্ষমতা রয়েছে জার্মানির বহুচর্চিত ‘এম-২০০০’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, গত বছর ইউক্রেনীয় বাহিনীর ‘বার্লিনের বর্ম’ ভেদ করতে ব্যর্থ হয় রুশ ‘পি-৮০০ ওনিক্স’ ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। মস্কোর এই হাতিয়ারটিকে তাঁরা ‘ব্রহ্মস’-এর সমতুল্য বলে মনে করেন। আর সেই কারণেই পাক ফৌজ জার্মান কবচটি হাতে পেতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে এখনও কিছু জানায়নি ইসলামাবাদ। অন্য দিকে, বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে বার্লিনও।
আইআরআইএস-টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা আনুমানিক ৪০ কিলোমিটার। এর প্রতি ইউনিটে রয়েছে অত্যাধুনিক রেডার, অপারেশনাল সেন্টার এবং লঞ্চার। ২০ ফুট ফ্রেমের উপর গোটা ব্যবস্থাটি বসিয়েছেন জার্মান প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। সূত্রের খবর, ‘বার্লিনের বর্ম’গুলির প্রতি ইউনিটের দাম ২০ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থাটি শেষ পর্যন্ত মধ্য ইউরোপের দেশটি রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের কাছে বিক্রি করবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
জার্মান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটির নির্মাণকারী সংস্থার নাম ডাইহল ডিফেন্স। থাইসেনক্রুপ মেরিন সিস্টেমস নামের আর একটি প্রতিরক্ষা সংস্থার সঙ্গে অংশীদারি রয়েছে তাদের। ওই দুই কোম্পানি আবার ভারতের ডুবোজাহাজ নির্মাণ প্রকল্প ‘সেভেন্টিফাইভ-আই’-এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নয়াদিল্লিকে ‘ইন্টারেক্টিভ ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যাটাক সিস্টেম’ বা আইডিএএস সরবরাহ করার কথা রয়েছে তাদের। এর জন্য ৭০ হাজার কোটি টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এই দুই জার্মান কোম্পানি।
এ ছাড়া শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা রিলায়্যান্স ডিফেন্সের সঙ্গে একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে ডাইহল ডিফেন্সের। এর মাধ্যমে দূরপাল্লার কামানের গোলা তৈরিতে মন দিয়েছেন তারা। ১৫৫ মিলিমিটারের ওই গোলার পোশাকি নাম ‘ভলক্যানো’ বা অগ্নেয়গিরি রাখা হয়েছে। ভারতের মাটিতে এই গোলা তৈরি করে তা বিদেশে রফতানির পরিকল্পনা রয়েছে রিলায়্যান্স এবং ডাইহল ডিফেন্সের। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক কখনওই খারাপ করতে চাইবে না বার্লিন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ভাবে প্রায় দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তান। ফলে ‘বার্লিনের বর্ম’ কেনার মতো পকেটের জোর ইসলামাবাদের আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মাত্র ছ’টি আইআরআইএস-টি আকাশ প্রতিরক্ষা বিমানবাহিনীতে শামিল করে জার্মান সরকার। এর জন্য তাদের খরচ হয়েছিল ৯০০ মিলিয়ান ইউরো। ডলারের হিসাবে টাকার অঙ্কটা ৯৭ কোটি ১৭ লক্ষ ৩০ হাজার। ৩৬০ ডিগ্রি নজরদারির ক্ষমতা রয়েছে এই এয়ার ডিফেন্সের।
সম্প্রতি পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির ৪৫ শতাংশ নাগরিক দারিদ্রসীমার নীচে রয়েছেন। আর চরম দারিদ্রসীমার তলায় চলে গিয়েছেন আরও ১৬ শতাংশ বাসিন্দা। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফের থেকে ১০০ কোটি ডলার এবং এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের থেকে ৮০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে ইসলামাবাদ। দু’তরফে টাকা আসায় সাময়িক স্বস্তিতে রয়েছে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির শাহবাজ় শরিফ সরকার।
যদিও ভারতের হাতে মার খাওয়ার পর প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ব্যয় প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে পাকিস্তান। পাশাপাশি, অন্যান্য খাতে সামগ্রিক ব্যয় সাত শতাংশ কমিয়েছে ইসলামাবাদ। কিছু গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের চাপে ১০ হাজার কোটি পাকিস্তানি মুদ্রার উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিকে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে শাহবাজ প্রশাসন।
চলতি বছরের জুন মাসে মার্কিন সফরে গিয়ে পাক ফেডারেলমন্ত্রী মুসাদিক মালিক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে ভাল কোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন দেশের থেকে নয়াদিল্লি যে হাতিয়ার কিনেছে, সেগুলি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। সেই কারণেই আমাদের আর্জি যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক অস্ত্র-প্রযুক্তি আমাদের বিক্রি করুক। সেগুলো আমরা কিনে নেব। অস্তিত্বরক্ষার জন্য এটা আমাদের খুবই প্রয়োজন।’’
সূত্রের খবর, আগামী ১৪ জুন আমেরিকার ‘সেনা দিবস’-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আগামী দিনে ফের ওয়াশিংটনের থেকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার কিনতে পারে ইসলামাবাদ। পাশাপাশি, জার্মানি নেটোর সদস্য হওয়ায় ‘বার্লিনের বর্ম’ হাতে পেতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিতে পারেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। এর বদলা নিতে ৯ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) ন’টি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারত। সঙ্গে সঙ্গেই সংঘাত তীব্র করে ইসলামাবাদ। একাধিক ড্রোন পাঠিয়ে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের একাধিক সেনাছাউনিকে নিশানা করে মুনিরের বাহিনী।
কিন্তু, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে পাক ড্রোনগুলিকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি। এর পরই ইসলামাবাদকে শিক্ষা দিতে তাদের ১১টি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে চরম আঘাত হানে ভারতীয় সেনা। এই হামলায় ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ। এর পরই অত্যাধুনিক হাতিয়ার পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকে পশ্চিমের প্রতিবেশীটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সেনাকর্তারা।
পহেলগাঁও হামলার পর সিন্ধু জল চুক্তিকে স্থগিত করে ভারত। নয়াদিল্লির এই ‘জল যুদ্ধ’ মোকাবিলা করতে নেমে দিশাহারা হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। ভারত সিন্ধুর জল বন্ধ করলে তাকে ‘যুদ্ধ’ বলে বিবেচনা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসলামাবাদ। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে এই নিয়ে ফের যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হতে পারে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
বর্তমানে সমরাস্ত্রের ব্যাপারে চিনের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইসলামাবাদ। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে সেগুলির পারফরম্যান্স খুব খারাপ হওয়ায় যথেষ্ট হতাশ পাক ফৌজ। উদাহরণ হিসাবে বেজিঙের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এইচকিউ-৯পি এবং এইচকিউ-১৬র কথা বলা যেতে পারে। ইজ়রায়েলি আত্মঘাতী ‘হারোপ’ ড্রোনের সাহায্যে অনায়াসে সেগুলিকে ধ্বংস করে ভারতীয় সেনা। ফলে ‘যুদ্ধে’র সময় এক রকম অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সেই কারণেই চিনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফের ইউরোপ বা আমেরিকার হাতিয়ার বাহিনীকে মজবুত করার পরিকল্পনা করছে ইসলামাবাদ। বর্তমানে রুশ আগ্রাসনের ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে জার্মান সরকার। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, আত্মরক্ষার জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বার্লিন। সেই কারণে এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স তারা আদৌ সরবরাহ করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত থাকা সত্ত্বেও ভারতের হাতে বাজে ভাবে পর্যুদস্ত হয় পাক ফৌজ। জার্মান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হাতে পেলেও ‘ব্রহ্মস’কে আটকানো ইসলামাবাদের পক্ষে একেবারেই সহজ নয়। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটির নতুন সংস্করণটি ‘হাইপারসোনিক’ শ্রেণির হতে পারে। অর্থাৎ, শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল হতে পারে ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। যা চিহ্নিত করা আইআরআইএস-টি পক্ষে অসম্ভব, বলছেন বিশ্লেষকেরা।