ভারতের রক্তচাপ বাড়িয়ে এ বার পাকিস্তানের সঙ্গে খনিজ তেলের চুক্তি সারবে রাশিয়া? ‘বন্ধু’ মস্কোর এ-হেন ইসলামাবাদ-প্রেম প্রকাশ্যে আসতেই নয়াদিল্লির বিদেশনীতি নিয়ে ফের উঠল প্রশ্ন। সম্প্রতি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড)। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৃপাদৃষ্টির দৌলতে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ডলার-বৃষ্টি চলছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। ফলে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রকট হচ্ছে এ দেশের চরম ব্যর্থতা।
চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর রুশ-পাক সম্ভাব্য খনিজ তেলের চুক্তি নিয়ে সংবাদ সংস্থা আরআইএ-র কাছে মুখ খোলেন ইসলামাবাদের অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ ঔরঙ্গজ়েব। তাঁর কথায়, ‘‘তরল সোনার ভান্ডারের নিরিখে মস্কোকে বিশ্বশক্তি বলা যেতে পারে। ক্রেমলিন যদি আমাদের সঙ্গে এই খাতে সমঝোতা করে তা হলে আমরা খুশিই হব।’’ বর্তমানে এ ব্যাপারে দু’পক্ষের জ্বালানি মন্ত্রকের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেন পাক অর্থমন্ত্রী ঔরঙ্গজ়েব।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায় ভারতীয় ফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈনিক। ওই ঘটনার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে তৃতীয় ভারত-পাক যুদ্ধের। পাশাপাশি, পূর্ব দিকের ভূমিখণ্ড ইসলামাবাদের থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই লড়াইতে খোলাখুলি ভাবে নয়াদিল্লির পাশে ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। ৫৪ বছর পর ঠিক সেই দিনেই মস্কোর সঙ্গে সম্ভাব্য খনিজ তেলের চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা চলছে বলে জানাল পাক সরকার।
সংবাদসংস্থা আরআইএ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঔরঙ্গজ়েব জানিয়েছেন, ক্রেমলিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তরল সোনার অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং পরিশোধনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর সহযোগিতা পেতে চাইছে ইসলামাবাদ। এ বছরের নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন রুশ জ্বালানি মন্ত্রী সের্গেই সিভিলেভ। তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান একটি খনিজ তেল পরিশোধনাগারকে উন্নত করার ব্যাপারে ক্রেমলিনের একাধিক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। যদিও তাতে লগ্নির মাত্রা কেমন হবে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
খনিজ তেলকে নিয়ে রুশ-পাক ঘনিষ্ঠতাকে ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে দেখতে নারাজ বিশ্লেষকদের একাংশ। তাদের দাবি, গত পৌনে চার বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মস্কোর ‘তরল সোনা’র উপর যে ভাবে আমেরিকা-সহ পশ্চিম দুনিয়া নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে চলেছে, তাতে বিকল্প বাজার খোঁজা ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনও রাস্তা নেই। অন্য দিকে, বর্তমানে ৮৫ শতাংশের বেশি খনিজ তেল আমদানি করে থাকে ইসলামাবাদ। এই খাতে খরচ কমানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমের প্রতিবেশী।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, নিজেদের স্বার্থেই কাছাকাছি এসেছে রাশিয়া এবং পাকিস্তান। ২০২৩ সাল থেকে মস্কোর অপরিশোধিত তেল কেনা শুরু করে ইসলামাবাদ। গত অগস্ট-সেপ্টেম্বরে চিনে হওয়া ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেটিভ অর্গানাইজ়েশন) সম্মেলন চলাকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি পার্শ্ববৈঠক করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। সেখানে দিল্লি-মস্কো ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘‘তার পরেও ক্রেমলিনের সঙ্গে বাণিজ্যবৃদ্ধিতে কোনও সমস্যা নেই ইসলামাবাদের।’’
তবে জ্বালানি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রুশ-পাক ‘কৌশলগত অংশীদারি’ কতটা মজবুত হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, আর্থিক দিক থেকে ‘সীমাহীন’ মার্কিন প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া ইসলামাবাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। উদাহরণ হিসাবে ২০২২ সালের কথা বলা যেতে পারে। ওই বছর জ্বালানি চুক্তি করতে ক্রেমলিন সফরে যান তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। দেখা করেন পুতিনের সঙ্গে। ওই সাক্ষাতের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান শুরু করে রুশ ফৌজ। ফলে ইমরানের সফরকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি ওয়াশিংটন।
ওই ঘটনার কয়েক মাসের মাথাতেই কুর্সি হারান ইমরান। এ বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উঠেপড়ে লাগেন পাকিস্তানের সেনা সর্বাধিনায়ক বা সিডিএফ (চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্স) ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ঘন ঘন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখা যায় তাঁকে। বর্তমানে তাঁর নির্দেশমতোই পরিচালিত হচ্ছে ইসলামাবাদের বিদেশনীতি। ফলে মস্কোর সঙ্গে বড় কোনও চুক্তি করে নিশ্চয়ই সমস্যা বাড়াতে চাইবেন না মুনির, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা বা ডিএসসিএ-র (ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি) একটি চিঠিকে উদ্ধৃত করে বিস্ফোরক রিপোর্ট প্রকাশ করে করাচির জনপ্রিয় পাক গণমাধ্যম ‘দ্য ডন’। সেখানে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর এফ-১৬ লড়াকু জেটের বহরকে অত্যাধুনিক করে তুলতে ৬৮ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার মূল্যের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রাওয়ালপিন্ডিকে বিক্রি করবে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিমানের সংস্কারের পাশাপাশি ক্রিপ্টোগ্রাফিক-সহ বিপুল সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ এই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
‘দ্য ডন’-এ প্রকাশিত ডিএসসিএ-র চিঠি অনুযায়ী, আগামী দিনে রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনীর জেট পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেবে মার্কিন বায়ুসেনা। এ-হেন প্রতিরক্ষা চুক্তিটিকে বাদ দিলে আমদানি-রফতানি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে ১২৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই অর্থ দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তানের খনিসমৃদ্ধ রেকো-ডিক এলাকায় লগ্নির নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তামা ও সোনার পাশাপাশি সেখানকার কথিত বিরল খনিজ দীর্ঘ দিন ধরেই কব্জা করতে চাইছেন তিনি।
গত ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জন্য ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফের কার্যনির্বাহী বোর্ড। ভারতীয় মুদ্রায় যেটা প্রায় ১০ হাজার ৭৯৯ কোটি রুপি। পরে এই নিয়ে বিবৃতি দেয় ওই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে বলা হয়েছে, অনিশ্চিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদকে সার্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও দৃঢ় করতে সঠিক নীতি বজায় রাখতে হবে। এর জন্য শাহবাজ় শরিফ সরকারকে বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রকে মজবুত করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি খনিজ তেল নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ‘মেগা ডিল’ সেরে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারে ইসলামাবাদ। বিরক্ত ওয়াশিংটন কোনও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপালে সেটা সহ্য করা দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে অন্ধকারে রেখে মস্কোর সঙ্গে শাহবাজ় সরকার কোনও চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন বলে মনে করেন না কেউই।
তা ছাড়া কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের কাছে বিরাট খনিজ তেলের ভান্ডার আছে বলে ঘোষণা করেন ট্রাম্প। সেখান থেকে ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের জন্য বিপুল লগ্নির কথাও বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, এ ব্যাপারে এখনও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ‘কুমিরছানা’র মতো একই কথা বলে রাশিয়ার থেকে ইসলামাবাদে বিনিয়োগ টানার ছক কষা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। শাহবাজ় সরকারের সেই চালাকি ক্রেমলিনের সামনে ধোপে টিকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সংবাদসংস্থা আরআইএ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইস্পাতশিল্পের কথাও বলেছেন পাক অর্থমন্ত্রী ঔরঙ্গজ়েব। ঠিক মাস ছ’য়েক আগে (পড়ুন জুনে) ইসলামাবাদকে একই রকমের কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। ওই সময় বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা একটি ইস্পাত কারখানাকে কেন্দ্র পাক গণমাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেদনগুলিতে দাবি করা হয় যে, কারখানাটির পুনরুজ্জীবনের জন্য কয়েক কোটি টাকা লগ্নি করবে রাশিয়া। এই মর্মে ইসলামাবাদ ও মস্কোর চুক্তিও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রকাশিত হতেই সমাজমাধ্যমের কল্যাণে রকেট গতিতে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট ইস্পাত কারখানাটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পুতিন প্রশাসন ২৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে বলে দাবি করে পাক গণমাধ্যম। এর পরই ভুয়ো খবর ঠেকাতে আসরে নামে মস্কো। ক্রেমলিনের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামাবাদের সঙ্গে এ রকম কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট খবরগুলিকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে বলে স্পষ্ট করে তারা। অন্য দিকে, এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি।
ভুয়ো খবর প্রচার করা পাক গণমাধ্যমের মুখোশ টেনে খুলতে বড় ভূমিকা নিয়েছে রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’। তাদের দাবি, মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে ২৬০ কোটি ডলারের চুক্তি সংক্রান্ত খবরের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই খবর প্রথম প্রকাশ করে ‘নিক্কেই এশিয়া’। প্রতিবেদনটির লেখক ইসলামাবাদের বাসিন্দা আদনান আমির। ২০২২ সালে ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমটির খবর রাশিয়ায় বন্ধ করে দেয় পুতিন প্রশাসন।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে রাশিয়ার থেকে ব্যাপক সস্তায় তেল কিনে আসছিল ভারত। কিন্তু, এ বছরের চাপ বাড়াতে নয়াদিল্লির দু’টি সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। তা ছাড়া এ দেশের পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ডিসেম্বরে নয়াদিল্লি সফরে এসে এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন পুতিন। বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের থেকে জ্বালানি কিনতে পারলে, ভারতের ক্ষেত্রে অসুবিধা কেন?’’ ফলে মস্কো যে তেল সরবরাহ বন্ধ করছে না, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে পুতিন মুখে যা-ই বলুন না কেন, নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে রুশ খনিজ তেল আমদানি কিছুটা কমিয়েছে ভারত। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেই ঘাটতি পূরণ করতেই ইসলামাবাদের দিকে নজর ঘোরাতে বাধ্য হয়েছে ক্রেমলিন। মস্কোর এই মনোভাব আগামী দিনে ভারতের জাতীয় স্বার্থের আদৌ কোনও ক্ষতি করবে কি না, সেটাই এখন দেখার।