চিরসবুজ, চিরতরুণ এবং চিররোম্যান্টিক— এই তিনটি শব্দবন্ধ সহজাত ভাবেই জুড়ে যায় তাঁর নামের সঙ্গে। তিনি দেব আনন্দ। ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেগরি পেক’। প্রযোজক-পরিচালক দেবের ছিল আবিষ্কারের নেশা। সেই নেশা তাঁকে আজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে।
তাঁর জহুরির চোখ একের পর না-কাটা ‘হিরে’ খুঁজে উপহার দিয়েছে বলিউডকে। জ়ীনত অমন থেকে শুরু করে টিনা মুনিম, তব্বু, রিচা শর্মা, অনেকেই তাঁর আবিষ্কার।
শুধু দেশের নয়, পড়শি দেশের এক উঠতি মডেলকেও নিজের ছবিতে সুযোগ করে দেন দেব। ১৯৯৩ সালে একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের জন্য ভারতে এসেছিলেন সেই মডেল। দেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর সেই পাকিস্তানি মডেলের ঝুলিতে চলে আসে দেবের প্রযোজনা সংস্থা ‘নবকেতন ফিল্মস’-এর আসন্ন ছবিটি। কারণ দেবও তাঁর আগামী ছবির জন্য নতুন মুখের সন্ধান করছিলেন।
দেবের পরিচালনায় ১৯৯৩ সালে ‘পেয়ার কা তরানা’ চলচ্চিত্রে নায়িকার ভূমিকায় বলিউ়ডে আত্মপ্রকাশ করেন পাকিস্তানি মডেল অনীতা অয়ুব। অনীতার সেই বিজ্ঞাপনটি দেখে তাঁকে পছন্দ করে ফেলেন দেব। প্রথম ছবিটি দর্শকের মন জয় করতে পারেনি। ফ্লপ হয় সেটি। তাতেও দমেননি দেব।
১৯৯৫ সালে দেবেরই দ্বিতীয় ছবি ‘গ্যাংস্টার’-এ আবার কাজ করেন অনীতা। এই ছবিটি অবশ্য বক্স অফিসে সাফল্যের মুখ দেখতে পায়। আজন্ম রোম্যান্টিক দেবের সঙ্গে অনীতা পর পর দু’টি ছবি করায় তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল বলিপাড়ায়।
সেই কানাঘুষোয় সিলমোহর দেন স্বয়ং অনীতাই। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এই নায়িকার একটি পুরনো সাক্ষাৎকার আবারও সমাজমাধ্যমের পাতায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে।
দেব ও তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ কেমন ছিল তা জানাতে গিয়ে অনীতা বলেন, বন্ধনহীন, খোলামেলা ছিল তাঁদের রসায়ন। এমন কোনও সম্পর্ক ছিল না যা তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়নি। এক জন স্নেহশীল দাদা, দায়িত্ববান বাবা যেমন হন, তেমনই ছিলেন দেব। প্রেমিকের ভূমিকাতেই দেব ছিলেন অনবদ্য। প্রতিটি সম্পর্কের গভীরতা তাঁকে অনুভব করিয়েছিলেন পরিচালক। অনীতা খোলসা করেন তাঁদের সম্পর্কের গল্প।
ডেনমার্কে তাঁরা চার সপ্তাহ একসঙ্গে ছিলেন। সেই সময়ে পরিচালককে আরও ভাল ভাবে ও ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনাজানার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি থাকতেন দোতলায় আর দেব আনন্দ থাকতেন ঠিক তার উপরের তলায়। একসঙ্গে প্রতি দিন সময় কাটানোর ফলে তাঁদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছিল, এমনটাই জানিয়েছেন অনীতা।
বলিউডের অন্দরমহলে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল অনীতা-দেবের সম্পর্কের গুঞ্জন। অনীতার বয়স তখন পঁচিশের কোঠায়। আর দেব প্রৌঢ়ত্বের উপান্তে। বাহাত্তুরে দেবকে যে কোনও ভূমিকাতেই গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ ছিল না, খোলাখুলি সেই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন অনীতা। নায়িকার কথায়, ‘‘দেব আনন্দকে আমি যে কোনও ভূমিকায় গ্রহণ করতে পারতাম— প্রেমিক, মা, বাবা বা ভাই। মানুষ যে ভাবেই দেখুক, কোনও কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।”
পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম অনীতার। একটি বেসরকারি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। এর পরে, অভিনয় প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে আসেন। মুম্বইয়ের রোশন তানেজা স্কুল অফ অ্যাক্টিং-এ অভিনয় শেখা আরম্ভ করেন।
দেবের সঙ্গে সম্পর্ক, ধীরে ধীরে বলিউডে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠার মাঝেই হঠাৎ করে অনীতার নাম জড়ায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। একটি ভুল তাঁর সমগ্র কেরিয়ার ডুবিয়ে দেয়। বলিউডের নানা দিকে চর্চা শুরু হয়। দাউদ-অনীতাকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেত বিভিন্ন জায়গায়। শোনা যায় দাউদ সেই সময় অনীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন।
১৯৯৫ সালে, চলচ্চিত্র প্রযোজক জাভেদ সিদ্দিকী অনীতাকে তাঁর ছবিতে নিতে অস্বীকৃত হন। এর পর পরই জাভেদকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং সন্দেহের তির সরাসরি দাউদের অনুসারীদের দিকে চলে যায়। বলিউড জুড়ে গুঞ্জন শুরু হয়, অনীতার হয়ে প্রতিশোধ নিতেই দাউদ জাভেদকে হত্যা করেছেন।
অনীতা এবং দাউদের সম্পর্কের গুজব যখন তুঙ্গে, তখন ‘ফ্যাশন সেন্ট্রাল’ নামে একটি পাকিস্তানি ফ্যাশন ম্যাগাজ়িন চমকপ্রদ দাবি তোলে। অনীতার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছিল তারা। লিখেছিল যে, মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ভেবেছিলেন যে অনীতা এক জন পাকিস্তানি গুপ্তচর। তাই তাঁকে বলিউডে বয়কট করা হয়েছিল।
একাধিক অভিযোগ এবং বিতর্কের পর বলিউডে অভিনেত্রীর কেরিয়ার সম্পূর্ণ রূপে শেষ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে অনীতার ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বলিউড থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকিস্তানে চলে যান তিনি।
১৯৯৫ সালে তিনি ভারতীয় ব্যবসায়ী সৌমিল পটেলকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি নিউ ইয়র্কে উড়ে যান সংসার করতে। সেখানে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়। তবে পরে এই সম্পর্কও ভেঙে বেরিয়ে আসেন অনীতা, বিয়ে করেন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সুবাক মাজ়িদকে।
এক সময় বলিউডের ‘সেনসেশন’ বলা হত অনীতাকে। দেব আনন্দের ছবির নায়িকা আজ প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে। নেই ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানি, কোনও সাক্ষাৎকার, অনুরাগীও। সমাজমাধ্যমে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না তাঁকে। সাদামাঠা জীবনযাপন করছেন অনীতা। ভারতে আসার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর।