মুক্তির পর থেকেই বক্সঅফিসে ঝড় তুলেছে বলিউডের ছবি ‘ধুরন্ধর’। আয়ের দিক থেকে ইতিমধ্যেই একাধিক রেকর্ড ভেঙেছে রণবীর সিংহ, অক্ষয় খন্না, আর মাধবন অভিনীত ছবিটি। গোলাগুলি, বিস্ফোরণ, মারপিট, রক্ত, ভয়ঙ্কর সব চরিত্র— আদিত্য ধর পরিচালিত এই ‘ধুরন্ধর’ই এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত ছবি।
‘ধুরন্ধর’ ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করছেন রণবীর। রণবীর ছাড়াও ‘ধুরন্ধর’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সঞ্জয় দত্ত, আর মাধবন, অক্ষয় খন্না এবং অর্জুন রামপাল। তাঁদের প্রত্যেকেরই ‘লুক’ সাড়া ফেলেছে। ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় রয়েছেন সারা অর্জুন। ৫ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। ‘ধুরন্ধর’ ছিল এই বছরের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমাগুলির মধ্যে একটি। ছবিটি তৈরি হয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
তবে ছবিমুক্তির পর থেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি পরিণত হয়েছেন তিনি অক্ষয় খন্না। ভয় ধরিয়েছে তাঁর অভনীত চরিত্র রেহমান ডাকাতের বলা ডায়লগ এবং মারপিটের দৃশ্য। করাচির এককালের সন্ত্রাস তথা কুখ্যাত মাফিয়া ছিলেন রেহমান ডাকাত। তাঁর জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত ‘ধুরন্ধর’ ছবিতে অক্ষয়ের চরিত্র।
রেহমান ডাকাত়ের আসল নাম ছিল সর্দার আব্দুল রেহমান বালোচ। খুব কম বয়সেই অপরাধজগতে হাতেখড়ি হয় রেহমানের। ধীরে ধীরে ক্ষমতাবৃদ্ধি করে পাক আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন গ্যাংস্টার হিসাবে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে লিয়ারি শহরে রেহমানের জন্ম। বাবা মহম্মদ এবং মা খাদিজা বিবি। রেহমানের বাবা এবং কাকা ছিলেন কুখ্যাত মাদক পাচারকারী। ১৯৬৪ সাল থেকে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। অল্প বয়স থেকে মাদক ব্যবসায় হাত পাকাতে শুরু করেন রেহমানও।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ছুরি মেরে খুনের অভিযোগ উঠেছিল রেহমানের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ দাবি করেন, ১৯৯৫ সালে নিজের মাকেও গলা টিপে খুন করেছিলেন তিনি। প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সন্দেহেই নাকি মাকে মেরে ফেলেছিলেন রেহমান।
২০০১ সাল নাগাদ রেহমানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে করাচি এবং আশপাশের এলাকায়। তাঁর মূল ঘাঁটি ছিল করাচির কাছে লিয়ারি শহরে। তবে করাচি এবং সংলগ্ন এলাকাতেও তাঁর ভয়ে কাঁপত সাধারণ মানুষ।
শোনা যায়, রেহমান এতটাই নির্মম ছিলেন যে, করাচির মানুষ তাঁর নাম মুখে আনতেও ভয় পেতেন। আবার করাচি এবং আশপাশের এলাকায় প্রচলিত ছিল, রেহমান মানুষ ছিলেন না, ছিলেন সাক্ষাৎ শয়তান। শত্রুদের শিরশ্ছেদ করা এবং প্রকাশ্যে মৃতদেহ টাঙিয়ে রাখা নাকি ছিল রহমানের রোজকার কাজ।
বলা হয় অপরাধের দিক থেকে নাকি কুখ্যাত গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিমের ‘বাবা’ ছিলেন রেহমান ডাকাত। শুধু তা-ই নয়, দাউদও নাকি ভয় পেতেন লিয়ারির এই পাগলাটে গ্যাংস্টারকে। শোনা যায়, এক বার দাউদের রাতের ঘুম উড়িয়েছিলেন রেহমান। খুন করেছিলেন দাউদের ভাইকে।
পাকিস্তানে রেহমানের মূল প্রতিপক্ষ ছিলেন আরশাদ পাপ্পু নামে অন্য এক গ্যাংস্টার। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে, মাদক, তোলাবাজি এবং এলাকা দখল নিয়ে আরশাদের সঙ্গে রেহমানের বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে লিয়ারি।
পাকিস্তানে রাজনীতিতে প্রবেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও দেখেছিলেন রেহমান। তার জন্য অনেক চেষ্টাও করেছিলেন। তবে সে ভাবে সফল হননি। সেই সূত্রে অনেক তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নাকি ওঠাবসা ছিল তাঁর।
প্রতাপ বাড়িয়ে ২০০৮ সালে ‘পিপল্স আমান কমিটি (পিএসি)’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন রেহমান। বলা হয় ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’র সঙ্গে সরাসরি যোগ ছিল এই গোষ্ঠীর।
করাচিতে সংগঠিত অপরাধ এবং গ্যাং যুদ্ধে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল পিএসি-র বিরুদ্ধে। সংগঠনটির কার্যকলাপ প্রথমে লিয়ারিতে সীমাবদ্ধ ছিল। শীঘ্রই করাচির অন্যান্য বালোচ জনবহুল এলাকা, যেমন ডালমিয়া, মালির, গদাপ, মাওয়াচ গোথ, এমনকি সিন্ধ ও বালোচিস্তানের কিছু নিকটবর্তী শহর এবং গ্রামেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে পিএসি।
২০০৮ থেকে অপরাধজগতে রেহমানের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময়ই নাকি দাউদ গ্যাংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়েছিলেন রেহমান। ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ গ্যাংস্টার দাউদ তখন পাকিস্তানে।
বলা হয়, করাচিতে রেহমানের সঙ্গে দাউদের দেখা হয়েছিল। করাচিতে বিতর্কিত একটি জমি নিয়ে নাকি দ্বন্দ্ব শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেহমানের সহযোগীদের কাছ থেকে ১২০০ কোটির একটি জমি জোর করে দখল করেছিল দাউদ গ্যাং। এর পরেই সংঘর্ষ বাধে দু’জনের মধ্যে।
শোনা যায়, প্রথমে রেহমান নাকি ভাল মুখে জমির দখল ছেড়ে দিতে বলেছিলেন দাউদকে। কিন্তু রাজি হননি দাউদ। এর পরেই দাউদের ভাই নুর উল হক ওরফে নুরাকে অপহরণ করেন রেহমান।
বলা হয়, নুরার উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়। নুরার শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে তাঁর চিৎকার দাউদকে নাকি শুনিয়েছিলেন রেহমান। দাউদ তাঁর ভাইকে ছেড়ে দিতে বললেও শোনেননি রেহমান। এমনকি, দাউদ ওই জমিও ছেড়ে দেবেন বলেছিলেন। তবুও নুরাকে ছাড়েননি রেহমান। এর পর নুরার গুলিবিদ্ধ দেহ ফেলে আসা হয় দাউদের করাচির বাড়ির বাইরে।
ওই একটি কাজ অপরাধজগতে রেহমানের কুখ্যাতি আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে রেহমানের অসীম ক্ষমতা দেখে তাঁকে দমন করতে উঠেপড়ে লাগে প্রশাসন। ২০০৯ সালে করাচি পুলিশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন রেহমান এবং তাঁর গ্যাং।
২০০৯ সালের ৯ অগস্ট পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় রেহমানের। রেহমানের মৃত্যুর পর, পিএসি-র মাথায় বসেন উজাইর বালোচ নামে এক প্রভাবশালী সদস্য। বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত পাকিস্তান পিপল্স পার্টির সমর্থক গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করেছিল পিএসি। ২০১১ সালে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।