চৈত্রের গরমে পুড়ছে কলকাতা-সহ গোটা বাংলা। বৈশাখ যত এগোচ্ছে, ততই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রার পারদ। সেই সঙ্গে হাটেবাজারে হু-হু করে বিকোচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার ঠান্ডা পানীয়। জনপ্রিয়তার নিরিখে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল পেপসি। ১৩২ বছরের ‘তরুণ’ নরম পানীয়টির জন্মের ইতিবৃত্ত চমকে ওঠার মতো। বিতর্ককে সঙ্গী করেই সাবালক হয়েছে সে।
সালটা ১৮৯৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার নিউ বার্নে ওষুধের দোকান চালাতেন ক্যালেব ব্র্যাডহ্যাম নামের এক মেডিসিনের ছাত্র। এক দিন কোলা স্বাদের কার্বোনেটেড নরম পানীয় তৈরি করেন তিনি। নাম দেন ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্ক’, যা তাঁর ওষুধের দোকানেই বিক্রি হত।
১৮৯৮ সালে নরম পানীয়টির নাম বদলে পেপসি কোলা রাখা হয়। তত দিনে অবশ্য আমেরিকার বাজারে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্ক’। এটির সেবনে হজমের গোলমাল দূর হবে বলে ব্যাপক প্রচারও করা হয়েছিল। নামবদলের পর পানীয়টির বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এর নেপথ্যে অবশ্য সুনির্দিষ্ট একটি কারণ ছিল।
আমেরিকার বাসিন্দারা মনে করেছিলেন, পেপসিন থেকে পেপসি কোলা নামটি নেওয়া হয়েছে। মানবদেহের অন্যতম একটি পাচকরস হল পেপসিন। ফলে আমজনতার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, এটি সেবনে দূর হবে অম্ল ও অজীর্ণের সমস্যা। মজার বিষয় হল, পেপসি কোলার উপাদান হিসাবে কখনওই পেপসিন ব্যবহার হয়নি।
পেপসি কোলার বিক্রি দিন দিন বাড়তে থাকায় ১৯০২ সালে নর্থ ক্যারোলিনায় নরম পানীয়টির নামেই গড়ে ওঠে একটি সংস্থা, যার মাথা ছিলেন ব্র্যাডহ্যাম। পরের বছরের (পড়ুন ১৯০৩ সাল) ১৬ জুন পেপসি-কোলার ট্রেডমার্কের নথিভুক্তিকরণ হয়। ওই বছরই নিজের ওষুধের দোকান থেকে পানীয়টির উৎপাদন সরঞ্জাম কাছের একটি ভাড়াবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলেন ক্যালেব।
পেপসি কোলার দ্বিতীয় পরিবর্তন হয় ১৯০৫ সালে। ওই বছর থেকে ছ’আউন্সের বোতলে ঠান্ডা পানীয়টি বিক্রি শুরু করেন ব্র্যাডহ্যাম। ফলে সেটি পাওয়ার জন্য আমেরিকাবাসীদের মধ্যে পাগলামি শুরু হয়ে যায়। কিছু দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি স্টেটে পেপসি কোলার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দিয়ে দেন ব্র্যাডহাম। তাঁর সংস্থার তখন তুঙ্গে বৃহস্পতি।
কিন্তু, সময়ের চাকা ঘুরতেই পেপসি কোলাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে নিজের পুরনো ছোট্ট ওষুধের দোকানে ফিরতে হয় ক্যালেবকে। সালটা ছিল ১৯২৩, মে মাসের ৩১ তারিখ। ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্ক’ তৈরিতে মূলত দু’টি উপাদান ব্যবহার করেছিলেন তিনি। সেগুলি হল, চিনি এবং ভ্যানিলা। এর মধ্যে প্রথমটির জন্য ব্যবসা লাটে ওঠে তাঁর।
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে চিনি অগ্নিমূল্য হয়। বিপাকে পড়েন ক্যালেব। যুদ্ধের আগে প্রতি পাউন্ড চিনির দাম ছিল তিন সেন্ট। লড়াই-পরবর্তী বছরগুলিতে সেটাই বেড়ে ২৮ সেন্টে পৌঁছে যায়। ব্র্যাডহ্যাম বর্ধিত দামে চিনি কিনেছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে দর কমে যাওয়ায় পানীয় তৈরি করে মারাত্মক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েন তিনি।
পেপসি কোলার যখন ফুটো পকেট দশা, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভাব ঘটে চার্লস গডফ্রে গুথের। মার্কিন এই শিল্পপতি ছিলেন লফ্ট ক্যান্ডি কোম্পানির মালিক। মাত্র ৩০ হাজার ডলারে পেপসি কোলার ব্র্যান্ড, ফর্মুলা-সহ যাবতীয় স্বত্ব কিনে নেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়ায় এই ঠান্ডা পানীয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে মহামন্দার সময় ১৯৩৪ সালে ১২ আউন্সের বোতল বাজারে এনে সবাইকে চমকে দেয় পেপসি কোলা। ওই সময় রেডিয়োয় এই পানীয়ের একটি বিজ্ঞাপন চলত। এর ‘নিকেল নিকেল’ জিঙ্গলটি তরুণ প্রজন্মের মনে ধরেছিল।
১৯৫৫ সালে ডাকসাইটে সুন্দরী তথা হলিউড অভিনেত্রী জোয়ান ক্রফোর্ডের সঙ্গে সংসার পাতেন পেপসি কোলার তৎকালীন সভাপতি অ্যালফ্রেড স্টিল। পরবর্তী বছরগুলিতে টিভির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্বামীর সংস্থার ঠান্ডা পানীয়টিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে স্টিলের মৃত্যু হলে পেপসি কোলার পরিচালন পর্ষদে সর্বসম্মতিতে স্থান পান ক্রফোর্ড।
১৯৬১ সালে ফের নাম বদল হয় পেপসি কোলার। এ বার আরও ছোট করে নাম রাখা হয় পেপসি। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে ঠান্ডা পানীয়টির বিক্রি বৃদ্ধি করতে চেষ্টার কসুর করেনি এর নির্মাণকারী সংস্থা। অন্য দিকে প্রথম দিন থেকেই খেলোয়াড়দের মধ্যে আলাদা কদর পেয়েছিল এককালের ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্কস’।
পেপসির সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন মার্কিন অটোমোবাইল রেসার বার্নি ওল্ডফিল্ড। খেলতে নেমে স্টিয়ারিংয়ে বসার আগে পানীয়টি খেতেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি ছিল, ‘‘ট্র্যাকে গাড়ি ছোটানোর আগে এটা গলায় গেলে একটা সুক্ষ্ম অনুভূতির জন্ম হয়।’’ ১৯০৯ সাল থেকে নিজেকে পেপসিপ্রেমী হিসাবে জাহির করতে থাকেন ওল্ডফিল্ড। এতে নরম পানীয়টির ব্র্যান্ডিংয়ে সুবিধা হয়েছিল।
এ হেন পেপসিকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। এক বার নরম পানীয়টির বিজ্ঞাপনে অংশ নেন পপ গানের রানি হিসাবে পরিচিত ম্যাডোনা। তাঁর গাওয়া ‘লাইক আ প্রেয়ার’ গানটিকে প্রচারের হাতিয়ার করে পেপসির নির্মাণকারী সংস্থা। কিন্তু গানটির বিষয়বস্তু ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানায় বিজ্ঞাপনটি বন্ধ করতে বাধ্য হয় তারা। সাল ছিল ১৯৮৯।
১৯৯২ সালে ফিলিপিন্সে পানীয়টির সংস্থার আয়োজন করা একটি প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে অশান্তি বেধে যায়। পেপসির ছিপিতে এক থেকে ৯৯৯ পর্যন্ত লিখতে পারলে বিপুল আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। একে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘর্ষে অন্তত পাঁচ জনের প্রাণ গিয়েছিল। এই ঘটনা ‘পেপসি নম্বর ফিভার’ নামে পরিচিত।
ফিলিপিন্সের ঘটনার রেশ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তাতে অবশ্য পেপসির জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। নরম পানীয়টির জনপ্রিয়তার নেপথ্যে হলিউডের হাত কম নয়। একাধিক সিনেমায় ফলাও করে এর প্রচার চালানো হয়েছে। তালিকায় আছে ১৯৮৯ সালের ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার পার্ট টু’, ১৯৯০ সালের ‘হোম অ্যালোন‘, ১৯৯২ সালের ‘ওয়েইন'স ওয়ার্ল্ড’, ১৯৯৯ সালের ‘ফাইট ক্লাব’ এবং ২০১৩ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জ়েড’-এর মতো বাণিজ্যসফল সিনেমা।
বর্তমানে কোকা কোলা এবং পেপসির মধ্যে রয়েছে তীব্র বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। নরম পানীয় দু’টির ভক্তদের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। পেপসির দাবি, তারা তারুণ্যের প্রতীক। আর তাই এর বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে কোলা অনেক বেশি শান্ত-স্নিগ্ধ। এই প্রতিযোগিতার নামেও মিশে আছে যুদ্ধ। আর সেটা হল ‘কোলা-ওয়ার’।
রাজস্বের নিরিখে কোকা কোলার থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে পেপসি। কিন্তু নিট মুনাফায় আবার জর্জিয়ার নরম পানীয় সংস্থাটির জয়জয়কার। গত শতাব্দীতে দুই বহুজাতিকের যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সুযোগ এসেছিল। ১৯২২ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে অন্তত তিন বার পেপসি সংস্থাটিকে কেনার প্রস্তাব পায় কোকা কোলা। কিন্তু কোনও বারই তাতে সিলমোহর দেয়নি আটলান্টার সাবেক মেয়রের পানীয় সংস্থা।