What Is Mayday Call

দুর্ঘটনার মুখে বাঁচার আকুতি! কেন তিন বার ‘মেডে কল’ করা হয় অভিশপ্ত বিমান থেকে? কী এই বিপদসঙ্কেত?

অহমদাবাদ বিমান দুর্ঘটনাকাণ্ডে প্রকাশ্যে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। শেষ মুহূর্তে যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন পাইলট। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসিকে ‘মেডে কল’ দেন তিনি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫ ১৪:৪৮
Share:
০১ ১৯

গুজরাতের অহমদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। মাটি ছাড়ার ২-৩ মিনিটের মধ্যেই চিকিৎসক-পড়ুয়াদের হস্টেলে ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘এআই১৭১’ উড়োজাহাজ। সঙ্গে সঙ্গেই বোয়িং ‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’ মডেলের ওই বিমানে আগুন ধরে যায়। দুর্ঘটনার আগে অবশ্য সাহায্য চেয়ে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসির কাছে ‘মেডে কল’ পাঠান পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাভারওয়াল। বিমানটির সহকারী পাইলটের আসনে ছিলেন ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দার।

০২ ১৯

এখন প্রশ্ন হল, কী এই ‘মেডে কল’? কী ভাবেই বা সেটা এটিসির কাছে পাঠান অভিশপ্ত ‘ড্রিমলাইনার’-এর পাইলট? এটি প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বেতারে পাঠানো বিপদসঙ্কেত। ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ত্রুটি, উড়োজাহাজে অগ্নিকাণ্ড বা বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি হলে এই ‘মেডে কল’ দিয়ে থাকেন পাইলট। জাহাজের ক্যাপ্টনদেরও এই রেডিয়ো সিগন্যাল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।

Advertisement
০৩ ১৯

বিমান বা জাহাজের চালক এক বার ‘মেডে কল’ দেন, এমনটা কিন্তু নয়। নিয়ম অনুযায়ী, তাঁকে পর পর তিন বার বেতারে এই বিপদসঙ্কেত পাঠাতে হয়। ট্রান্সমিশনে ত্রুটির কারণে যাতে সেই সঙ্কেত পেতে কোনও সমস্যা না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। উড়োজাহাজ থেকে ‘মেডে সঙ্কেত’ এলে সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে এর যাত্রীদের রক্ষা করার জন্য তৎপর হয় এটিসি। এ ক্ষেত্রে পাইলট, বিমানটির পরিচয়, তার জরুরি অবতরণের জায়গা এবং বিমানে থাকা যাত্রীসংখ্যা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করার নিয়ম চালু রয়েছে।

০৪ ১৯

১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে ‘মেডে কলে’র সূচনা করেন লন্ডনের ক্রয়ডন বিমানবন্দরের বেতার আধিকারিক ফ্রেডেরিক স্ট্যানলি মকফোর্ড। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, ফরাসি শব্দ ‘মেডর’ থেকে এটিকে তৈরি করেন তিনি। ফরাসি শব্দটির অর্থ হল, ‘আমাকে সাহায্য করুন’। মকফোর্ডের যুক্তি ছিল, বেতারে এই সঙ্কেত ভেসে এলে বিমান যে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, তা সহজেই বোঝা যাবে।

০৫ ১৯

১৯২৩ সালের মধ্যে উড়োজাহাজের পাইলট এবং জাহাজের ক্যাপ্টেনদের কাছে দুর্ঘটনার সময়ে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বেতারসঙ্কেত আদর্শ হয়ে ওঠে। ১৯২৭ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ‘মেডে কল’। ১৯০৬ সাল থেকে অবশ্য জাহাজে মোর্স কোড বেতার সঙ্কেত ব্যবহার হচ্ছিল। এর পোশাকি নাম ‘এসওএস’ বা সেভ আওয়ার সোলস। এর পাশাপাশি ‘মেডে কল’কে আলাদা করে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিমানচালক ও নাবিকদের যে বাড়তি সুবিধা হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

০৬ ১৯

এ হেন ‘মেডে কল’-এর বিপদসঙ্কেত দেওয়ার নিয়মটিও ভারি অদ্ভুত। জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে বেতারে পাইলট পর পর তিন বার বলেন, ‘মেডে-মেডে-মেডে’। এর পরই এটিসি থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত অবতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাঝে পাইলটের সঙ্গে কথা বলে বিমানবন্দরের আধিকারিকেরা জেনে নেন সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজে কত জন যাত্রী রয়েছেন এবং সেটি কী অবস্থায় ও মাটি থেকে কতটা উঁচুতে রয়েছে।

০৭ ১৯

অহমদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার সময়ে পাইলট সাভারওয়াল যে ‘মেডে কল’ দিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অসামরিক উড়ান পরিবহণ মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ বা ডিজিসিএ। সেখানে বলা হয়, ১২ জুন বিমানবন্দরের ২৩ নম্বর রানওয়ে থেকে দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে মাটি থেকে ওড়া শুরু করে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘এআই১৭১’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এটিসিতে ‘মেডে কল’ দেন এর চালক ক্যাপ্টেন সাভারওয়াল। এটিসি পাল্টা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

০৮ ১৯

ডিজিসিএ-র দাবি, ‘মেডে কল’ দেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজটি বিমানবন্দর সংলগ্ন চিকিৎসক-পড়ুয়াদের হস্টেলে ভেঙে পড়ে। এর পাইলট ক্যাপ্টেন সাভারওয়ালের ৮,২০০ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল। সহকারী চালক ফার্স্ট অফিসার কুন্ডার ১,১০০ ঘণ্টার বেশি সময় মাঝ-আকাশে থেকেছেন বলে জানা গিয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বার করতে ইতিমধ্যেই তদন্তে নেমেছে ডিজিসিএ।

০৯ ১৯

অহমদাবাদের অভিশপ্ত বিমানে ছিলেন গুজরাতের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী-সহ মোট ২৪২ জন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে এখনও পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে। বাকিরা সকলেই প্রাণ হারিয়েছেন। উড়ান যাত্রীদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, সাত জন পর্তুগিজ এবং এক জন কানাডার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া।

১০ ১৯

এই বিমান দুর্ঘটনায় একমাত্র জীবিত যাত্রী হলেন বিশ্বাস কুমার রমেশ। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বছর ৪০-এর এই ব্রিটিশ নাগরিক বর্তমানে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ১৩ জুন, শুক্রবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে এসেছিলেন। অভিশপ্ত বিমানে ছিলেন তাঁর ভাইও। রমেশের স্ত্রী এবং সন্তানেরা রয়েছেন ব্রিটেনে। তাঁদের কাছে ফেরার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়েন এই ব্যক্তি।

১১ ১৯

অভিশপ্ত বিমানে সওয়ার হয়ে কী ভাবে প্রাণে বাঁচলেন, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তা জানিয়েছেন রমেশ। তাঁর কথায়, ‘‘বিমান ওড়ার মাত্র ৩০ সেকেন্ড পর একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। এর পরই বিমান ভেঙে পড়ে। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনিতে আমার সিটটা খুলে এসেছিল। তাই হয়তো আমি বেঁচে গেলাম। যখন উঠে দাঁড়াই, আমার চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই দৌড়তে শুরু করি। কেউ আমাকে টেনে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলেছিল।’’

১২ ১৯

এয়ার ইন্ডিয়ার ‘এআই১৭১’ বিমানের ইকোনমি ক্লাসের ১১এ আসনে বসেছিলেন রমেশ। তাঁর আসনটি ছিল আপৎকালীন দরজার কাছেই। কিন্তু, কী ভাবে বিমান থেকে বাইরে বেরিয়েছেন বলতে পারেননি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওই ব্রিটিশ নাগরিক। বর্তমানে অহমদাবাদ সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁর।

১৩ ১৯

অন্য দিকে, দুর্ঘটনার পর অভিশপ্ত বিমানের সহকারী চালক ক্লাইভ কুন্দর অভিনেতা বিক্রান্ত ম্যাসির খুড়তুতো ভাই বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিক্রান্তের শোকবার্তা থেকে তেমনই ধারণা হয়েছিল। কিন্তু পরে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন অভিনেতা। তিনি জানিয়েছেন ক্লাইভ তুতো ভাই নন, দীর্ঘ দিনের পারিবারিক বন্ধু। যাঁর অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ বিক্রান্ত।

১৪ ১৯

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই প্রথম বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও অতীতে ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’র কারণে বেশ কয়েক বার খবরের শিরোনামে এসেছে মার্কিন বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা বোয়িংয়ের তৈরি এই মডেল। গত বছর মার্কিন সংস্থাটির সাবেক ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেফোর অভিযোগ করেন যে, দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ‘ড্রিমলাইনার’ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা বজায় রাখা হয়নি।

১৫ ১৯

২০২৪ সালের গোড়ায় সংবাদ সংস্থা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং সিএনএনকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন বোয়িংয়ের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার স্যাম। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘তাড়াহুড়ো করে উৎপাদনের জন্য ড্রিমলাইনার মডেলগুলিতে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। উড়োজাহাজগুলি পুরনো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপদ টের পাওয়া যাবে। কিন্তু, তখন হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।’’ স্যামের দাবি, এই নিয়ে আমেরিকার ‘ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা এফএএ-র কাছে অভিযোগও দায়ের করেন তিনি। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

১৬ ১৯

সাক্ষাৎকারে স্যাম আরও বলেন, ‘‘ড্রিমলাইনার উৎপাদনে শর্টকাট নিয়েছে বোয়িং। মডেলটির বডির ভুল জায়গায় ড্রিলিং করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘ফিউজ়েলেজ’ অংশে ছোট ছোট ফাঁকগুলিকে ভুল ভাবে পূরণ করেছে তারা। ফলে লম্বা পথ পাড়ি দিলে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজে ফাটল তৈরি হবে।’’ তাঁর দাবি, হাজারের বেশি ড্রিমলাইনার মডেলে এই সমস্যা রয়েছে। বোয়িংয়ের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার সালেফোরের বক্তব্য ছিল, এই বিমান ওড়ানো মানে টাইম বোমা নিয়ে আকাশে যাচ্ছেন পাইলট।

১৭ ১৯

বোয়িংয়ের এ হেন কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মাসুলও তাঁকে দিতে হয়েছিল বলে অভিযোগ স্যামের। তাঁর দাবি, দু’দশক ধরে কাজ করা সত্ত্বেও ড্রিমলাইনারের অ্যাসেম্বলিং নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তড়িঘড়ি তাঁকে ৭৭৭ প্রকল্পে (বোয়িংয়ের আর একটি যাত্রিবাহী বিমানের মডেল) বদলি করে এই জনপ্রিয় মার্কিন সংস্থা। এই পদক্ষেপকে ‘প্রতিশোধমূলক’ বলে উল্লেখ করেন তাঁর আইনজীবী।

১৮ ১৯

তবে স্যাম একা নন। গত বছরের জুন মাসে একই রকমের অভিযোগ করেন রিচার্ড কিউভাস নামের এক ঠিকাদার কর্মী। তাঁর আইনজীবী কাট্‌জ় ব্যাঙ্কস কুমিনের দাবি, এর জন্য নাকি তাঁর মক্কেলকে বরখাস্ত করেন বোয়িং কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ফরোয়ার্ড প্রেশার বাল্কহেড উৎপাদনে বিচ্যুতি নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করে মুখ খোলেন রিচার্ড। উড়োজাহাজ আকাশে থাকাকালীন বায়ুমণ্ডলের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

১৯ ১৯

অহমদাবাদকাণ্ডের পর বোয়িং জানিয়েছে, ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনার জন্য উড়ান পরিষেবা সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে সব ধরনের সাহায্য করবে তারা। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রুটির কথা স্বীকার করেনি এই মার্কিন সংস্থা। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, দুর্ঘটনার কারণ বিমানটির ভার এবং সেই সংক্রান্ত গণনায় ত্রুটি। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, অভিশপ্ত বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি ছিল। ডিজিসিএ-র তদন্ত রিপোর্টে মিলবে এর জবাব।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement