Pakistan Economic Crisis

পাকিস্তানের সামনে ‘শেষ সুযোগ’! পড়শির সঙ্গে বন্ধুর মাখামাখিতে ‘আর্থিক বারান্দা’ ধরে ঝুলে বাঁচতে চাইছে দীর্ণ ইসলামাবাদ

সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। একে ইসলামাবাদের জন্য ‘শেষ সুযোগ’ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কেন?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:৫৮
Share:
০১ ১৯

ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে আফগান পড়শিদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে ‘বন্ধু’ চিন। বেজিঙের এ-হেন মনোভাবে পাকিস্তানের মাথায় বাজ! ইসলামাবাদের কাছে ড্রাগনভূমির সরকার অন্ধের যষ্ঠির মতো। কারণ, দেউলিয়া অবস্থা থেকে তাদের একমাত্র বাঁচাতে পারে মান্দারিনভাষী রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে খড়কুটোর মতো সিপিইসিকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

০২ ১৯

সিপিইসি অর্থাৎ ‘চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (পড়ুন চিন পাকিস্তান আর্থিক বারান্দা)। গত এক দশক ধরে চলা যে প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি ইসলামাবাদ। সেখানেই এ বার গতি আনার নির্দেশ দিতে শোনা গেল পাক প্রধানমন্ত্রীকে। নইলে গোটা দেশের কপালে যে ‘শনি নাচছে’, সেটা তাঁর কথায় একরকম স্পষ্ট। যদিও শরিফের আশা কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।

Advertisement
০৩ ১৯

চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সিপিইসি নিয়ে শরিফের ডাকা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন সরকারের শীর্ষ আধিকারিকেরা। পাক গণমাধ্যম ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে চিনকে ‘মহান বন্ধু ও ভাই’ বলে সম্বোধন করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘বেজিঙের দক্ষতা এবং লগ্নি থেকে উপকৃত হওয়ার এটাই আমাদের শেষ সুযোগ। আর তাই সিপিইসির কাজ দ্রুত শেষ করুন। এখানে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’’

০৪ ১৯

গত ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিনের তিয়েনজ়িন শহরে আয়োজিত ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। এর পর ৪ সেপ্টেম্বর বেজিঙের বাণিজ্য সম্মেলনে বেশ কয়েকটি চুক্তিতে সই করে দুই দেশ। এর মধ্যে অন্যতম হল সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এতে মোট ৮০০ কোটি ডলারের চিনা বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে ইসলামাবাদ।

০৫ ১৯

সিপিইসিকে বাদ দিলে পাকিস্তানের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আরও ৫০ কোটি ডলার লগ্নি করবে বেজিং। ইসলামাবাদের দাবি, সেই তালিকায় রয়েছে কৃষি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশ্যাল ইকোনমিক জ়োন বা এসইজ়েড), খনি ও খনিজ সম্পদ এবং কারাকোরাম মহাসড়কের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। সংশ্লিষ্ট রাস্তাটি পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর) মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ফলে এর নির্মাণ নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে ভারতের।

০৬ ১৯

চিন থেকে দেশে ফেরা ইস্তক সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায় এবং বাণিজ্যক্ষেত্রে বেজিঙের ঢালাও লগ্নিকে ব্যাপক সাফল্য বলে প্রচার চালাচ্ছেন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়’ বা পিএমএল-এন নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। সরকারের পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলিকে সতর্কতার সঙ্গে মানতে বলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা আত্মতুষ্টির সময় নয়। কাজে অযথা বিলম্ব সহ্য করব না। অতীতকে ভুলে আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।’’

০৭ ১৯

চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের আওতাধীন সিপিইসি পাকিস্তানের ভাগ্য বদলে দেবে বলে যথেষ্ট আশাবাদী শাহবাজ়। আর তাই বিভিন্ন মন্ত্রককে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়তে বলেছেন তিনি। শরিফ জানিয়েছেন, সরকারি আধিকারিকেরা এর জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ থাকবেন। ফলে কর্তব্যে গাফিলতি বা কাজে গড়িমসির অভিযোগ উঠলে যে তাঁর সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।

০৮ ১৯

ড্রাগনভূমি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর শরিফের ‘চিন প্রেম’ উথলে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, গত কয়েক বছর ধরে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে পাকিস্তান। প্রায় খালি হয়ে এসেছে ইসলামাবাদের কোষাগার। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারের অবস্থাও তথৈবচ। এই অবস্থায় ঘন ঘন ঋণ দিয়ে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির শ্বাস টিকিয়ে রেখেছে বেজিং। সিপিইসির মতো প্রকল্পের জন্যেই খুব ধীর গতিতে হলেও ঘুরছে পাক অর্থনীতির চাকা।

০৯ ১৯

দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, এ-হেন ‘অর্থনৈতিক বারান্দা’র কাজ ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামাবাদের উপর বেজায় চটেছে বেজিং। কারণ, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কর্মরত চৈনিক নাগরিকদের বার বার নিশানা করছে দক্ষিণ-পশ্চিম পাক প্রদেশ বালোচিস্তানের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। তাঁদের ফিদায়েঁ হামলায় প্রাণ গিয়েছে মান্দারিনভাষী একগুচ্ছ ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীর। পাশাপাশি, পিওকেতেও প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

১০ ১৯

এই ঘটনাগুলির পর চিনা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাক সরকারের উপর চাপ তৈরি করে বেজিং। কিন্তু, তাতে তেমন লাভ হয়নি। কারণ, সিপিইসি প্রকল্পের কাজ যত এগিয়েছে, ততই আক্রমণের ঝাঁজ বৃদ্ধি করতে দেখা গিয়েছে বালোচ বিদ্রোহীদের। ইসলামাবাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। এই পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির।

১১ ১৯

বিশ্লেষকদের অনুমান, পাক ‘সিপাহসালার’-এর এ-হেন মতিগতি দেখে যথেষ্টই আতঙ্কিত চিন। ড্রাগনের সন্দেহ, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে আমেরিকাকে সাহায্য করবেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। বিষয়টি আঁচ করে পড়শি দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ বাড়াতে থাকে বেজিং। সেখানকার তালিবান সরকারকে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। গত অগস্টে পঠানভূমির রাজধানী কাবুলে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। ছিলেন পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দারও।

১২ ১৯

ওই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শেষে ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ আফগানিস্তানে সম্প্রসারিত হবে বলে ঘোষণা করে বেজিং। এ বছরের সেপ্টেম্বরের গোড়ায় সিপিইসির অন্তর্ভুক্ত রেল প্রকল্প থেকে আচমকাই পিছু হটে চিন। এতে ড্রাগন সরকারের মোট ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ছিল। প্রেসিডেন্ট শি-র এ-হেন পদক্ষেপ ইসলামাবাদের রক্তচাপ যে কয়েক গুণ বাড়িয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

১৩ ১৯

২০০১ সাল থেকে টানা ২০ বছর আফগানিস্তান দখলে রেখেছিল আমেরিকা। ২০২১ সালে হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই সেখানে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। কিন্তু পঠানভূমি ত্যাগ করার মাত্র চার বছরের মধ্যেই উল্টো সুর শোনা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায়। সেখানকার বাগরাম বিমানঘাঁটি ফের দখল করতে চাইছেন তিনি।

১৪ ১৯

গত ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রথম বার বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনর্দখলের ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘হিন্দুকুশের কোলের দেশটির বাগরাম বায়ুসেনা ছাউনি ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের জন্য খুবই জরুরি।’’ ট্রাম্পের এ-হেন মন্তব্যের সময় তাঁর পাশেই ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। ফলে ওয়াশিংটনের ‘অপারেশন বাগরাম’-এ ইংরেজ সামরিক শক্তি শামিল হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

১৫ ১৯

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটির উপর কেন হঠাৎ নজর পড়েছে ট্রাম্পের? প্রকাশ্যেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। তাঁর দাবি, ওই বায়ুসেনা ছাউনি থেকে সরাসরি চিনের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজর রাখতে পারবে আমেরিকা। কারণ, হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সীমান্ত লাগোয়া এলাকাতেই নাকি রয়েছে ড্রাগনের আণবিক অস্ত্রের কারখানা। এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, ‘‘বেজিঙের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির জায়গাটার দূরত্ব বাগরামের থেকে এক ঘণ্টারও কম।’’ কৌশলগত দিক থেকে এ-হেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তাই ফেরত পেতে চাইছেন তিনি।

১৬ ১৯

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাগরাম দখল করা মোটেই সহজ নয়। কারণ স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান পাঠাতে হলে পাকিস্তানের উপর দিয়ে যেতে হবে তাদের। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, সেই কারণেই ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে ‘কিনে ফেলা’র চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। ইসলামাবাদে তাঁর সংস্থার ক্রিপ্টো ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব রাওয়ালপিন্ডির এই ফৌজি জেনারেলকে দিয়েছেন ট্রাম্প।

১৭ ১৯

সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে মার্কিন সৈন্য দ্বিতীয় বার আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে ঢুকলে, চিনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সেটা হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আর তাই ইসলামাবাদের বদলে কাবুলকেই বেশি ভরসা করছে বেজিং। কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম বায়ুসেনা ছাউনি যে কোনও ভাবেই আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া হবে না, ইতিমধ্যেই তা জানিয়ে দিয়েছে তালিবান। ফলে ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি।

১৮ ১৯

২০১৫ সালে ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’র কাজ শুরু করে বেজিং। ঠিক হয় চিনের শিনজ়িয়ান প্রদেশ থেকে বালোচিস্তানের গ্বদর বন্দর পর্যন্ত লম্বা রাস্তা তৈরি করবে ড্রাগন। সংশ্লিষ্ট সমুদ্র বন্দরটির আধুনিকীকরণের কথাও রয়েছে তাদের। বালোচ বিদ্রোহীদের দাবি, এর মাধ্যমে ওই এলাকা পুরোপুরি মান্দারিনভাষীদের হাতে তুলে দিচ্ছে ইসলামাবাদ। গোটা এলাকার সম্পদ লুট করছে তাঁরা, যার জেরে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে স্বাধীনতাকামী বালোচেরা।

১৯ ১৯

তবে প্রধানমন্ত্রী শরিফ চাইলেও সিপিইসির কাজে গতি আনা নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। বালোচ বিদ্রোহীদের পাশাপাশি ইসলামাবাদের দ্বিতীয় মাথাব্যথার জায়গা হল ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী। আফগানিস্তান লাগোয়া খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে তাঁরা। সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে নিয়ে স্বাধীন ‘পাশতুনিস্তান’ তৈরির লক্ষ্য রয়েছে তাঁদের। ফলে বালোচ বিদ্রোহী এবং টিটিপির হামলা সামলে আর্থিক বারান্দা প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শাহবাজ় সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement