এক সময়ে কমবয়সিদের মুখে মুখে একটাই নাম ঘুরত, ‘এমটিভি’। ৪০ বছরের সফর! তবে এ বার কি তা বন্ধ হওয়ার মুখে? সম্প্রতি এমনই ঝড় বয়ে যাচ্ছে নেটদুনিয়ায়।
৯০ দশকে এত মুঠোফোন ছিল না। না ছিল ‘ইউটিউব’, ‘স্পটিফাই’, ‘জিওসাভন’, ‘অ্যাপ্ল মিউজ়িক’-এর মতো ডিজিটাল অ্যাপ। গান শুনতে ইচ্ছে করলেই খুলে ফেললাম কোনও একটি অ্যাপ, তা হত না। তখন ছিল এমটিভির মতো কিছু টিভি চ্যানেল। সেখানে চলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গান, তা-ও আবার ভিডিয়োর মাধ্যমে চোখে দেখা যেত।
ইংরেজি হোক কি হিন্দি, সদ্য প্রকাশিত কিংবা একটু পুরনো— সব ধরনের গানের সাধ মেটাত এমটিভি। অনেকেরই ছোটবেলার নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে এমটিভি-র সঙ্গে। ৯০ দশকের ছেলেপুলের কাছে এমটিভি হল ‘নস্টালজিয়া’! প্রায় ৪০ বছর পর, সেই চ্যানেলই এ বার পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে— এমন খবর শুনতেই মনখারাপ দর্শকের।
ধীরে ধীরে পুরনো দিনের সব ভাল থাকার রসদই মুছে যাচ্ছে সমাজমাধ্যমের দাপটে। আর ভারতে তো টিকে রয়েছে এমটিভির দু’টি মাত্র চ্যানেল, সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে! এ যেন সত্যিই একরাশ মনখারাপ ডেকে আনার মতো খবর। কিন্তু না, ভারতে বন্ধ হচ্ছে না। এমনটা ঘটছে ব্রিটেনে। সম্প্রতি ব্রিটেনে এমটিভি-র মালিক প্যারামাউন্ট গ্লোবালের পক্ষ থেকে এমনটাই ঘোষণা করা হয়েছে।
‘এমটিভি মিউজ়িক’, ‘এমটিভি ৮০’, ‘এমটিভি ৯০’, ‘ক্লাব এমটিভি’ এবং ‘এমটিভি লাইভ’— এই পাঁচটি চ্যানেলের কোনও অনুষ্ঠানই আর দেখতে পারবেন না দর্শক। যদিও এই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে এমটিভি-র প্রধান চ্যানেল ‘এমটিভি ইউকে’ এবং ‘এমটিভি এইচডি’।
চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর থেকে বন্ধ যাবে এমটিভির এই পাঁচটি চ্যানেল। প্যারামাউন্ট গ্লোবালের তরফে জানানো হয়েছে, মূলত চ্যানেলের নেটওয়ার্ক পুনর্গঠন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য মিউজ়িক চ্যানেলগুলি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৮১ সালে ‘আই ওয়ান্ট মাই এমটিভি’ স্লোগান নিয়ে আমেরিকায় যাত্রা শুরু করেছিল এমটিভি। এর পর ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এমটিভি। বিশ্ব জুড়ে একে একে নানা প্রান্তে এমটিভি নিজেদের শাখা বিস্তার করতে থাকে।
১ অগস্ট ১৯৯৭ সালে ব্রিটেনে প্রথম বার এমটিভির সম্প্রচার শুরু হয়। যদিও এই চ্যানেলের সঙ্গে আমেরিকার এমটিভি-র কোনও যোগই ছিল না। প্যারামাউন্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে চালু করেছিল তাঁদের চ্যানেলটি।
প্রথমে সম্পূর্ণ মিউজ়িকভিত্তিক ভিডিয়ো চ্যানেল হিসাবে শুরু হয় এমটিভি-র যাত্রা। ২৪ ঘণ্টা ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক পপ, রক গান সম্প্রচারিত হত সেখানে। ‘এমটিভি বেস চার্ট’, ‘এমটিভি ডান্স’-এর মতো বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান রাতারাতি দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে এমটিভি-র দর্শকসংখ্যায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। ডিজিটাল মিডিয়ার দাপটকেই এর জন্য দীয়া করেছেন কর্তৃপক্ষ। নতুন প্রজন্মকে এমটিভিমুখী করে তুলতেই এই পদক্ষেপ।
বন্ধ হওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বিশ্বের অগণিত দর্শকের মনখারাপ। এমটিভি-র প্রাক্তন ভিডিয়ো জকি সিমোন অ্যাঙ্গেল দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন এমটিভির সঙ্গে। তাঁরও বেশ মনখারাপ।
একটি প্রতিবেদন সূত্রে সিমোন বলেছেন, “আমি সত্যিই দুঃখিত, বিষয়টা আমার কাছে অনেকটা অবিশ্বাস্যও। আমাদের এখনকার শিল্পীদের একটু সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এমটিভি এমনই জায়গা ছিল, যেখানে নাচ, গান-সহ বিনোদনের সব কিছু একসঙ্গে পাওয়া যেত। তাই এই খবর সত্যিই আমার মন ভেঙে দিয়েছে।”
ভারতে ১৯৯৬ সালে এমটিভি-র যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে সময়ে পুরনো হিন্দি গানের রিমিক্স, সদ্য মুক্তি পাওয়া সব গান দেখানো হত মিউজ়িক চ্যানেলগুলিতে। তা দেখতেই টিভির পর্দায় চোখ রাখতেন দর্শক।
রাতারাতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে যায় এমটিভি। কমবয়সিদের ঘরে ঘরে চলতে থাকে এই চ্যানেলের নানান অনুষ্ঠান। মলাইকা অরোরা, নিখিল চিনাপা, রণবিজয় সিংহের মতো তারকাদের উত্থান এই এমটিভি থেকেই।
৯০ দশকে সমাজমাধ্যমের নেশা ছিল না। সে সময় ভারতীয়দেরও আন্তর্জাতিক গানের ভিডিয়ো দেখতে হলেও ভরসা করতে হত টেলিভিশনের উপরেই। আর সেই সাধও পূরণ করত এমটিভির গানের চ্যানেলগুলি।
কিন্তু সে সব আর কই! ২০২৫ সালের ১৫ মার্চ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ‘এমটিভি বিটস’ এবং ভিএইচ ওয়ান ইন্ডিয়া। তবে, এমটিভি ইন্ডিয়া এখনও স্বমহিমায় বিনোদন দিয়ে চলেছে। এই চ্যানেলের বেশ কয়েকটি ‘রিয়্যালিটি শো’ বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
চলতি বছরে বিশ্ব জুড়ে এমটিভি-র একের পর এক অনেকগুলি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে চারিদিকে। এর পর কি বিনোদনমূলক চ্যানেলগুলি সম্পূর্ণ ভাবে সমাজমাধ্যমের গ্রাসে চলে যাবে? আর কি ফিরে পাওয়া যাবে না ছোটবেলা!