সিরিয়াল কিলিং। অর্থাৎ, একই কায়দায় একের পর এক খুন। পৃথিবীজোড়া এমন কিছু সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা রয়েছে যা শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পুলিশের চোখের সামনেই শহর জুড়ে একের পর এক খুন। আর তার জেরে আতঙ্কের হিমশীতল ছায়া গোটা এলাকায়। তেমনটাই ঘটেছে আমেরিকার টেক্সাসের একটি শহর অস্টিনে।
গত আড়াই বছরে স্থানীয় একটি হ্রদ ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩৮টি মৃতদেহ উদ্ধারের পর সিরিয়াল কিলারের আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ২০২২ সাল থেকে টেক্সাসের অস্টিনের লেডি বার্ড লেক এবং এর আশপাশে তিন ডজনেরও বেশি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
পর পর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সিরিয়াল কিলারের ভয়ে কাঁটা হয়ে পড়েছে গোটা শহর। স্থানীয়েরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, সেখানে এক জন সিরিয়াল কিলার রয়েছে এবং সে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
গত সপ্তাহে নতুন করে আরও একটি মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে। তিন ডজন মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর অন্তত ৬টি মৃত্যুর কারণ এখনও অজানা। নিহতদের বেশির ভাগই ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সি পুরুষ। নতুন করে একটি মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর নতুন করে ‘রেনি স্ট্রিট রিপার’-এর গুজব আন্দোলিত হতে শুরু করেছে।
রেনি স্ট্রিট হল অস্টিনের একটি প্রাণবন্ত এলাকা। লেডি বার্ড নামের হ্রদটি এই এলাকাতেই অবস্থিত। হ্রদটি অস্টিনের কলোরাডো নদীর তীরে অবস্থিত একটি বেশ বড় জলাধার। রেনি স্ট্রিটে শহরের অধিকাংশ বার, রেস্তরাঁ ও নাইট ক্লাবগুলি অবস্থিত। সেখানেই পর পর এতগুলি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যাওয়ায় ‘সিরিয়াল কিলারের’ নামকরণ করা হয়েছে ‘রেনি স্ট্রিট রিপার’।
২০২৪ সালে বস্টন থেকে অস্টিনে উড়ে এসেছিলেন জেফ জোন্স নামের ৩৮ বছরের তরুণ। উদ্দেশ্য, বন্ধুদের সঙ্গে ব্যাচেলর পার্টিতে যোগ দেওয়া। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর তাঁরা সকলে ওয়েস্ট সিক্সথ স্ট্রিটের একটি বারে চলে যান। সেখানে রাত ১টা নাগাদ তিনি বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
তার পরের ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে যায় জেফের। দু’সপ্তাহ পরে নিজেকে একটি হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করেন তিনি। পিঠে লোহার খাঁচা দেওয়া। সেই রাতের কোনও ঘটনাই আর মনে করতে পারেননি তিনি।
চিকিৎসকেরা তাঁর শরীরে ‘রোহিপনল’ নামের নিষিদ্ধ মাদক খুঁজে পান। তাঁকে বলা হয়েছিল একটি সেতু থেকে ২৫ ফুট নীচে পড়ে যাওয়ার পর জল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। জেফ এখানে আসার পর সিরিয়াল কিলারের রটনা তাঁর কানেও এসেছিল। এই ঘটনার পর জেফ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, তিনিও ভয়ঙ্কর এক খুনির হাতে পড়েছিলেন।
তাঁকে মাদকাসক্ত করে জলে ঠেলে ফেলে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশ্বাস করতে শুরু করেন ভীত-সন্ত্রস্ত জেফ। কারণ আগে যে মৃতদেহগুলি উদ্ধার করা হয় তাদের শরীরেও উচ্চমাত্রায় মাদক বা ওষুধের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল। ৩৮টি দেহের মধ্যে ১৯টিকে জল থেকে তোলা হয়েছিল। বাকি দেহ রাস্তা বা শুকনো জমি থেকে পায় পুলিশ।
গত ৩ জুন সকাল ৭টা নাগাদ ১৭ বছরের এক কিশোরের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এক নৌকাচালকের নজরে পড়ে ভেসে ওঠা দেহ। যদিও উদ্ধার হওয়া দেহটির পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিশোরের গায়ে লাইফ জ্যাকেট ছিল না। পুলিশের ধারণা, কিশোর তার পরিবারের সঙ্গে কায়াকিং করতে হ্রদে নামে। অসাবধানতাবশত সে হ্রদের জলে পড়ে গিয়ে ডুবে যায়। কিশোরের দেহে কোনও আঘাতের চিহ্নও মেলেনি। পুলিশের ধারণা, সে হয়তো গভীর জলে পড়ে ডুবে মারা গিয়েছে।
২০২২-এর পর মাত্র এক বছরের মধ্যে পর পর একই ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার সঠিক কিনারা না হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে অস্টিন পুলিশ বিভাগ। ২০২৩ সালের এক বিবৃতিতে তারা জানায়, লেডি বার্ডে ডুবে যাওয়ার ঘটনার জল্পনা সম্পর্কে অস্টিন পুলিশ বিভাগ ওয়াকিবহাল।
পুলিশ জানিয়েছে, এই মামলাগুলির কোনওটিতেই খুন বা সিরিয়াল কিলিংয়ের অভিযোগ সমর্থন করার মতো কোনও প্রমাণ নেই। যদিও প্রতিটি ঘটনা হ্রদ ও তার আশপাশেই ঘটেছে। উদ্ধার হওয়া প্রতিটি দেহই ময়নাতদন্ত করে দেখা হয়েছে। মৃতদের গায়ে কোনও আঘাত বা অস্বাভাবিক বিকৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তদন্তকারীদের মতে, অস্টিনের হ্রদে ডুবে যাওয়ার ঘটনাগুলির একটি সাধারণ বিষয় হল মদ খেয়ে হ্রদে ঘুরতে আসা। কারণ লেডি বার্ডে খুব সহজেই প্রবেশ করা সম্ভব। বিশেষ করে রাতের দিকে অনেক প্রবেশপথ রয়েছে যেগুলিতে পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। আশপাশের পানশালা থেকে অনেকেই মদ্যপ অবস্থায় জলে পড়ে ডুবে যান।
অস্টিন পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট নাথান সেক্সটন মৃত্যুগুলি সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘এই মৃত্যুগুলি কোনও ভাবেই সন্দেহজনক বলে মনে করার কোনও প্রমাণ নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃতেরা হয় মানসিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত মাদকদ্রব্য সেবন অথবা কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন এমন প্রমাণই পাওয়া গিয়েছে।”
পুলিশের এই যুক্তি মানতে নারাজ মৃতের পরিবারে সদস্যেরা। রাতের দিকে বেরিয়ে একের পর এক তরুণের উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। ২০২২ সালেও একই সময়ে একই রকম ভাবে মারা গিয়েছেন এমন ছ’জন পুরুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে আরও পাঁচটি মৃতদেহ উদ্ধার হয় অকুস্থল থেকে।
এঁরা সকলেই গভীর রাতে রেনি স্ট্রিটে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে থাকার পর নিখোঁজ হয়েছিলেন। এঁদের বেশির ভাগই দুর্ঘটনাক্রমে ডুবে মারা গিয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। কয়েক জনের মৃত্যুর কারণ কিনারা করতে পারেনি পুলিশও। তাই বেশির ভাগ বাসিন্দাই পুলিশের দাবির উপর ভরসা করতে চাইছেন না। আড়াই বছর ধরে শহর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিরিয়াল কিলারের আতঙ্ক।