‘এ মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’— আজও দেশাত্মবোধক গানের তালিকায় একেবারে উপরে স্থান পায় এই গান। ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রথম বার বেজে ওঠে গানটি। গানটি শুনে চোখ ভিজেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুরও।
গানটি লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সুর বেঁধেছিলেন সি রামচন্দ্র বা রামচন্দ্র নারায়ণ দুঘলকর। রামচন্দ্র তত দিনে বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবির গানে সুর দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন।
একের পর এক সিনেমায় কাজ করছিলেন তিনি। ১৯৪০-এর দশক থেকে কাজ শুরু করেছিলেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত এক ভাবে কাজ করে গিয়েছেন। বহু গানে সুর দিয়েছেন রামচন্দ্র।
বলিউডে চুটিয়ে রাজত্ব করলেও, তাঁকে শুনতে হয়েছিল নানা অপবাদ। তাঁর কাজ নিয়ে উঠেছিল বহু প্রশ্ন। সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সুরকারকে।
১৯৫০ সালে মুক্তি পায় ‘সমাধি’ ছবিটি। রমেশ সায়গল পরিচালিত এই সিনেমার একটি গান ছিল ‘গোরে গোরে ও বাঁকে ছোরে’। লতা মঙ্গেশকর এবং মনোরমা গানটি গেয়েছিলেন। সুর দিয়েছিলেন রামচন্দ্র।
এই সিনেমার এই গানটি নিয়েই শুরু হয় সমালোচনা। বেশ কিছু সমালোচক বলতে শুরু করেন, তিনি চলচ্চিত্রের মৌলিক ভারতীয় সঙ্গীতের ধারাকে বিকৃত করেছেন।
ওই গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ছোঁয়া ছিল যা অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এমনকি বেশ কিছু সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজকও তাঁর সমালোচনা করেন।
সমালোচকেরা বলতে শুরু করেন, ‘গোরে গোরে ও বাঁকে ছোরে’ গানটি মূলত লাতিন একটি গান (‘চিকো চিকো ফ্রম পুয়ের্তো রিকো’)-এর অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে।
যদিও অনেকেই রামচন্দ্রের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধনকে সৃজনশীলতার আখ্যা দেন। এর মাধ্যমে গানের নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল বলেও মনে করেছেন অনেকে।
১৯১৮ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম হয় রামচন্দ্রের। মহারাষ্ট্রের আহমদনগরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ছোট থেকেই পড়াশোনার চেয়ে সঙ্গীতের প্রতি বেশি মন ছিল তাঁর।
পড়াশোনা শেষের পর তিনি সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। পুণের গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে পণ্ডিত বিনায়কবুয়া পটবর্ধনের কাছে সঙ্গীতচর্চা শুরু করেন। তার পর নাগপুরের শঙ্কররাও সাপ্রের কাছে বেশ কিছু দিন সঙ্গীত শেখেন।
অসাধারণ গান গাইতে পারতেন রামচন্দ্র। বেশ কিছু সিনেমায় গান গেয়েছেনও। গান শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন রামচন্দ্র।
গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত তাঁর আসল নাম ব্যবহার করতেন না। গায়ক হিসাবে চিতলকর ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন রামচন্দ্র।
রামচন্দ্র শুধু যে গান গেয়ে এবং সুর দিয়েই থেমে গিয়েছেন এমনটা নয়। তিনি চলচ্চিত্র জগতে সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে একজন অভিনেতা ছিলেন। বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন রামচন্দ্র।
১৯৩৫ সালে মারাঠি ছবি ‘নাগানন্দ’-এ অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এর পর সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে হিন্দি ছবিতে তাঁর প্রথম কাজ ‘নয়া সংসার’ এবং ‘সুখী জীবন’। ‘নয়া সংসার’ সিনেমায় সহকারী পদে থাকলেও ‘সুখী জীবন’-এ একক ভাবে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলেন রামচন্দ্র।
১৯৫০-এর দশকে হিন্দি সঙ্গীতের সেরা জুটিগুলির মধ্যে একটি ছিল রামচন্দ্র এবং লতা মঙ্গেশকরের জুটি। অনেকেই বলতেন এই জুটি প্রেম করছেন। যদিও ১৯৫৮ সালে ব্যক্তিগত ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই জুটি ভেঙে যায়।
প্রায় সাত বছর ধরে লতা মঙ্গেশকর তাঁর সুরে কোনও গান গাননি। ১৯৬৫ সালে রামচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় লতা মঙ্গেশকর তাঁকে দেখতে যান এবং তাঁদের মধ্যে পুরনো তিক্ততা দূর হয়। এই পুনর্মিলনের পর তাঁরা আবারও একসঙ্গে কাজ করেন।
রামচন্দ্র বিয়ে করেছেন দু’বার। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন চপলা, কর্মজীবনের শুরুতেই তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। যদিও পরে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন এসওয়াই দুর্গাকে। তবে রামচন্দ্র এবং লতার প্রেমের গুঞ্জন আকৃষ্ট করেছিল দর্শককে।
রামচন্দ্রের কাজ নিয়ে হাজার সমালোচনা থাকলেও, হিন্দি চলচ্চিত্রজগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ‘কিসমত কী হাওয়া কভী নরম’, ‘শোলা জো ভড়কে দিল মেরা ধড়কে’, ‘ইনা মীনা ডীকা’, ‘সান্ডে হো ইয়া মান্ডে রোজ খাও আন্ডে’র মতো আরও অনেক গান রয়েছে যেগুলি আজও দাগ কেটে রয়েছে দর্শকের মনে।