ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই নতুন বিপদের মুখোমুখি রাশিয়া। মস্কোর দরজায় কড়া নাড়ছে ‘মহামন্দা’। জনসমক্ষে সেই আর্থিক সঙ্কটের কথা স্বীকার করে নিয়ে এ বার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সতর্ক করলেন তাঁরই অর্থনীতি-বিষয়ক মন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেতনিকভ। ক্রেমলিন মন্দার জালে জড়িয়ে পড়লে ইউরোপে পড়বে তার প্রভাব? এর আঁচ কতটা লাগবে ভারতের গায়ে? ইতিমধ্যেই মরিয়া হয়ে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন দুনিয়ার তাবড় অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ১৯ জুন সেন্ট পিটার্সবার্গে ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরাম’-এ ভাষণ দেন রেশেতনিকভ। সেখানে ‘আর্থিক মন্দা’র কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যাবতীয় সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের দেশের ব্যবসায় কোনও গতি আসছে না। এ ক্ষেত্রে সমস্ত সূচকই নিম্নমুখী। আমাদের হাতে আসা যাবতীয় পরিসংখ্যানই পিছনে তাকানো আয়নার মতো। সব দিক বিচার করে তাই মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।’’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাঁর নির্দেশে রুশ সৈন্য পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে আক্রমণ করা ইস্তক মস্কোর উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। এতে মস্কোর অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়বে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবে তা একেবারেই হয়নি। উল্টে নিষেধাজ্ঞার চ্যালেঞ্জ টপকে গত তিন বছরে ছুটেছে মস্কোর অর্থনীতির চাকা।
ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে রাশিয়া। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এতে শাপে বর হয় মস্কোর। ক্রেমলিনের নির্দেশে সেনাবাহিনীকে লাগাতার হাতিয়ার সরবরাহের বরাত মিলতে থাকায় অচিরেই ফুলেফেঁপে ওঠে যাবতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। এর জেরে ঊর্ধ্বমুখী ছিল আর্থিক বৃদ্ধির সূচক। শুধু তা-ই নয়, প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির শ্রীবৃদ্ধির ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে কমে যায় বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতির হার। বৃদ্ধি পায় মজুরি। এক কথায় এর ফলে রুশ শ্রমিকদের সুদিন ফিরে এসেছে বলে মনে করা হয়েছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ঢালাও অস্ত্র সরবরাহ করে মোটা মুনাফা হওয়ায় মস্কোর প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি শ্রমিকদের দিয়েছে দুর্দান্ত বোনাস। মৃত্যুকালীন ভাতার আওতায় চলে এসেছেন কর্মীদের একটা বড় অংশ। এই সব কিছু দেখে বিশ্লেষকদের বড় অংশ মনে করেছিলেন, যুদ্ধে জড়ানোয় উপচে পড়ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোষাগার। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঘুরতেই সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে পরিস্থিতি। আর তাই এখন মহামন্দার আশঙ্কার কথা বলতে শোনা যাচ্ছে মস্কোর অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রীর গলায়।
সেন্ট পিটার্সবার্গের অনুষ্ঠানে রেশেতনিকভ বলেছেন, ‘‘আগামী দিনে আর্থিক ভাবে রাশিয়ার এগিয়ে যাওয়া পুরোপুরি সরকারি নীতির উপর নির্ভর করবে।’’ তবে তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন রুশ অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ। গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের অর্থনীতিতে কিছুটা শীতলতা এসেছে এটা সত্যি। কিন্তু, শীতের পর বসন্ত পেরিয়ে আসে গ্রীষ্ম।’’ এ ব্যাপারে কম ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন সিলুয়ানভ।
প্রায় একই কথা শোনা গিয়েছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনার গলায়। সেন্ট পিটার্সবার্গের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনীতি থেকে অতিরিক্ত উত্তাপ নির্গত হচ্ছে।’’ তবে বিশ্লেষকদের দাবি, এখনই সামরিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না রাশিয়া। কারণ, মুদ্রাস্ফীতি মস্কোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত কমে গিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে সেটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলিকে বাদ দিলে রাশিয়ার অন্য শিল্পক্ষেত্রগুলি নিষেধাজ্ঞার কারণে সে ভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। সেই কারণেই দেশ জুড়ে তৈরি হচ্ছে আর্থিক স্থবিরতা। হাতিয়ার নির্মাণ বাদ দিলে ভারত-সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রি করে কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে মস্কো। এ ছাড়া চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহাকাশ গবেষণার নতুন মিশন হাতে নিয়েছে ক্রেমলিনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা রসকসমস।
গত বছরের অক্টোবরে আর্থিক সঙ্কট কাটাতে সুদের হার ২০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ২০০৩ সালের পর যা সর্বোচ্চ। এতে মস্কোর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সুদ হঠাৎ করে বেড়ে দাঁড়ায় ২১ শতাংশ। প্রেসিডেন্ট পুতিন কুর্সিতে বসার পর পূর্ব ইউরোপের দেশটির সুদের হার এর আগে কখনও এতটা বৃদ্ধি পায়নি। ক্রেমলিনের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ইউরোপ, আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বের উপর পড়বে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
সুদের হারের এ-হেন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ অবশ্য ব্যাখ্যা করে মস্কো। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের যুক্তি ছিল, যুদ্ধের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে সরকারকে মোটা টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আর তাই পদক্ষেপ করা ছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না। এতে মুদ্রাস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বলে জানিয়েছিল মস্কো। গত বছর পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল।
গত বছরের ২২ এবং ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার কাজ়ান শহরে বসেছিল ‘ব্রিকস’-ভুক্ত দেশগুলির সম্মেলন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওই বৈঠক শেষ হতে না হতেই সুদের হার বৃদ্ধি করে মস্কো। ‘ব্রিকস’-ভুক্ত অন্যান্য দেশের মধ্যে (পড়ুন চিন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা) ক্রেমলিনের সুদের হার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের মে মাসে রাশিয়ার মুদ্রাস্ফীতির হার ৯.৯ শতাংশে পৌঁছে যায়। গত এপ্রিলে এই সূচক দাঁড়িয়েছিল ১০.২ শতাংশে। মস্কোর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতির হারকে চার শতাংশে নামিয়ে আনার মরিয়া চেষ্টা করছে। এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন রুশ অর্থনীতিবিদ ইভজেনি কোগান। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী এক বছরের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হারকে যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনা যাবে না, তা এক রকম স্বীকার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।’’
রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করে গত বছর বিশ্লেষকদের একাংশ সুদের হার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। ২০২৪ সালে মস্কোর মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ঘাটতি ছিল ১.৭ শতাংশ। এ বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ক্রেমলিনের আর্থিক বৃদ্ধির হারে ১.৪ শতাংশের শ্লথ গতি দেখা গিয়েছে। ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের শেষে ক্রেমলিনের অর্থনীতি ২.১৯৬ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির নেপথ্যে পুতিন প্রশাসনের শুল্ক নীতিকেও দায়ী করেছে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। গত বছর যা উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি করে মস্কো। ১৯৯৮ সালে আর্থিক মন্দার মুখে পড়েছিল রাশিয়া। ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে মন্দা কাটাতে আর্থিক সংস্কারে জোর দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন, যা পূর্ব ইউরোপের দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল।
পুতিনের আর্থিক সংস্কারের জেরে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পুনর্অর্থায়নের হার ২০ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ওই হারে কোনও বদল লক্ষ করা যায়নি।
এ-হেন পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ডলারের নিরিখে অনেকটা পড়ে গিয়েছে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের দাম। তবে গত বছর সুদের হার বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে এই নিয়ে পুতিন প্রশাসনের উপর ব়ড় বড় শিল্পপতিরা চাপ তৈরি করছিলেন। যার প্রথম সারিতে ছিলেন তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাজারের অস্থিরতা বন্ধ করতে সুদের হার বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। কিন্তু ওই বছরের এপ্রিলেই তা ১৭ শতাংশে নেমে আসে। দু’বছরের মাথায় ফের তা বৃদ্ধি করে মস্কো। কিন্তু এ বার মন্দার সতর্কবার্তা আসায় মাথায় হাত পড়েছে পূর্ব ইউরোপের দেশটির আমজনতা থেকে শুরু করে শিল্পপতিদের।
ডলারভিত্তিক অর্থনীতিতে লাগাম টানতে ব্রিকস সম্মেলনে ‘ডিজিটাল ব্রিকস মুদ্রা’ আনার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। গত বছরের ডিসেম্বরে যা আসতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু, ‘ব্রিকস’-এর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র এ ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেখায়নি। বিশ্লেষকদের দাবি, আর্থিক মন্দার পূর্বাভাস মেলায় এ বার ভারত এবং চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে মস্কো। তবে নয়াদিল্লির আখেরে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।