ক্রমাগত অত্যাধুনিক হাতিয়ার সরবরাহ করে পাকিস্তানের হাত শক্ত করছে চিন। অন্য দিকে আমেরিকার কাছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম চেয়ে আর্জি জানিয়েছে ইসলামাবাদ। ফলে ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেট থাকা যে কতটা জরুরি তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে নয়াদিল্লি। এ হেন পরিস্থিতিতে মেগা অফার নিয়ে হাজির ‘বন্ধু’ রাশিয়া। অফারের লোভে মস্কোর দিকে ঝুঁকলে কতটা লাভবান হবে ভারতের বিমানবাহিনী? এই প্রশ্নে সরগরম নেটদুনিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ মহল।
নয়াদিল্লির বায়ুসেনাকে শক্তিশালী করতে ‘এসইউ-৫৭ই’ নামের পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার ব্যাপারে আগ্রহী রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সূত্রের খবর, এর জন্য ১০০ শতাংশ প্রযুক্তি ভারতকে দিতে আপত্তি নেই মস্কোর। এগুলি পেলে ঘরের মাটিতেই অতিশক্তিশালী ওই ‘উড়ন্ত দৈত্য’কে তৈরি করতে পারবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও সরকারি ভাবে দু’তরফে এই নিয়ে কোনও ঘোষণা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হল কী এই ‘সোর্স কোড’? লড়াকু জেটের ক্ষেত্রে কেন সেটা পেতে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে নয়াদিল্লি? বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, যে কোনও সফ্টঅয়্যারের ‘প্রাণ’ হল ‘সোর্স কোড’। এর উপর ভিত্তি করে কাজ করে ওই প্রযুক্তি। প্রতিটি যুদ্ধবিমানে থাকে একাধিক সফ্টঅয়্যার। সেগুলির ভিত্তিতেই মাঝ-আকাশ থেকে লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করেন ককপিটের যোদ্ধা পাইলট। ছুড়তে পারেন ক্ষেপণাস্ত্র বা লেজ়ার গাইডেড বোমার মতো অস্ত্র।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এ হেন ‘সোর্স কোড’ হাতে পেতে যে কোনও লড়াকু জেটকে নিজের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করার সুযোগ পাবে ভারতীয় বাহিনী। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানে জুড়ে নিতে কোনও সমস্যা হবে না তাঁদের। এর আগে ফ্রান্সের কাছে ‘সোর্স কোড’ চেয়েছিল ভারত। কিন্তু নয়াদিল্লির সেই আবেদন পত্রপাঠ খারিজ করে দেয় ফরাসি সরকার।
২০১৬ সালে ফ্রান্সের থেকে সাড়ে চার প্রজন্মের ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এ ছাড়া বিমানবাহী রণতরীর জন্য আরও ২৬টি রাফাল পেতে প্যারিসের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে নয়াদিল্লি। চলতি বছরে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির ‘বডি’ ঘরের মাটিতে তৈরির জন্য এর নির্মাণকারী সংস্থা দাঁসো অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে চুক্তি সেরেছে টাটা গোষ্ঠী। কিন্তু, তার পরও রাফালের ‘সোর্স কোড’ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখিয়েছে ফ্রান্স।
‘সোর্স কোড’ হাতে না পাওয়ায় রাফাল যুদ্ধবিমানকে ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রে সাজাতে পারছে না ভারতীয় বায়ুসেনা। ফরাসি ল়ড়াকু জেটটি অবশ্য মাঝ-আকাশে শত্রু বিমান ধ্বংস করতে ‘মেটিওর’ এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র এবং আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানার ‘স্কাল্প’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। এই দুই হাতিয়ারও ফ্রান্সেরই তৈরি। অর্থাৎ, রাফাল দিয়ে হামলার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্যারিসের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে নয়াদিল্লিকে।
সেই কারণে ‘এসইউ-৫৭ই’র ক্ষেত্রে রাশিয়ার তরফে ‘সোর্স কোড’-এর মেগা অফারকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক। তাঁদের দাবি, শুধু এই কারণেই পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেট হাতে পেতে পুরোপুরি মস্কোর দিকে ঝুঁকতে পারে ভারত। অন্য দিকে নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। এ দেশের বায়ুসেনার বহরে ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ সরবরাহ করতে চায় ওয়াশিংটন। কিন্তু, ‘এসইউ-৫৭ই’র সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ‘এফ-৩৫’ পিছিয়ে পড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
‘এসইউ-৫৭ই’র মূল নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘ইউনাইটেড এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন’। তবে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানের নকশা তৈরি করেছে বিখ্যাত রুশ লড়াকু বিমান কোম্পানি ‘সুখোই’। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এই লড়াকু জেট ব্যবহার করে আসছে রুশ বায়ুসেনা। শব্দের দ্বিগুণ গতিতে (দুই ম্যাক) ছুটতে পারে ‘এসইউ-৫৭ই’। ১০ টন পর্যন্ত সমরাস্ত্র বহন করার শক্তি রয়েছে মস্কোর ‘উড়ন্ত দৈত্য’র।
স্টেল্থ ক্যাটেগরির হওয়ায় ‘এসইউ-৫৭ই’কে রেডারে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। মাঝ-আকাশে অন্য লড়াকু বিমানের সঙ্গে ‘ডগফাইট’ হোক বা আকাশপথে আক্রমণ শানিয়ে মাটির উপরে থাকা শত্রুঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া, সবেতেই এই যুদ্ধবিমানের জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া ‘ইলেকট্রনিক যুদ্ধ’-এর সুবিধাও পাবেন ‘এসইউ ৫৭ই’-এর যোদ্ধা পাইলট।
ভারতীয় বায়ুসেনা দীর্ঘ দিন ধরেই এই সংস্থার তৈরি ‘এসইউ-৩০এমকেআই’ নামের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে। এককথায়, সুখোইয়ের সঙ্গে এ দেশের ফাইটার পাইলটদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। সেই কারণে সাবেক বায়ুসেনা কর্তাদের অনেকেই ‘এসইউ-৫৭ই’কে নিয়ে গলা ফাটাতে শুরু করেছেন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটোভুক্ত (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলি পঞ্চম প্রজন্মের এই রুশ লড়াকু জেটটিকে চেনে ‘ফেলন’ নামে।
সম্প্রতি ‘এসইউ-৫৭’ যুদ্ধবিমানে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তি যোগ করে তার সফল পরীক্ষা চালায় ক্রেমলিন। গত ফেব্রুয়ারিতে বেঙ্গালুরুর ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ শো-তে রুশ লড়াকু জেটটিকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ওই সময়ে মাঝ-আকাশে কসরত দেখিয়ে সকলের নজর কাড়ে ‘এসইউ-৫৭ই’। তখনই এই যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে রুশ সরকারি প্রতিরক্ষা রফতানি সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’।
মস্কোর প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা বলেন, ‘‘ভারত এসইউ-৫৭ই কিনলে এই যুদ্ধবিমানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবে নয়াদিল্লি। প্রযুক্তির ব্যাপারে সব কিছু সরবরাহ করতে রাজি আছি আমরা।’’ তবে সূত্রের খবর, রুশ লড়াকু জেটটিকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি জায়গায় বাধা রয়েছে। প্রথমত, এর জন্য যৌথ উদ্যোগে যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী একটি সংস্থা ভারতের মাটিতে তৈরি করতে চায় ক্রেমলিন। ভারতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা নেই তাদের।
দ্বিতীয়ত, গত তিন বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চলায় একগুচ্ছ যুদ্ধবিমান হারিয়েছে রাশিয়া। ফলে ভারতের মাটিতে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হওয়া লড়াকু জেট নিজেদের বহরেও শামিল করতে পারে মস্কো। চুক্তিতে এই সংক্রান্ত বিধিনিষেধ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ান, ব্রিটেন এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে বড় ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে নয়াদিল্লির।
তৃতীয়ত, রুশ হাতিয়ার কিনলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে ভারত। ‘কাউন্টারিং আমেরিকাজ় অ্যাডভাইসরিজ় থ্রু স্যাংশনস অ্যাক্ট’ বা কাটসা প্রয়োগ করে নয়াদিল্লিকে ঝামেলায় ফেলতে পারে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক। তিনি বলেছেন, ‘‘ওদের (পড়ুন ভারতের) বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের চামড়ার নীচে জ্বলুনি তৈরি করছে। বর্তমান সময়ে নয়াদিল্লির আমাদের থেকে হাতিয়ার কেনা উচিত। কিন্তু, ওরা মস্কোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে বেশি আগ্রহী।’’
পাক গণমাধ্যম সূত্রে খবর, চলতি বছরের অগস্টের মধ্যেই চিনের থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘জে-৩৫এ’ লড়াকু জেটের প্রথম ব্যাচ হাতে পাবে প্রতিবেশী দেশটির বায়ুসেনা। বেজিঙের থেকে মোট ৪০টি এই যুদ্ধবিমান কিনেছে ইসলামাবাদ। কূটনৈতিক মহলের দাবি, ‘জে-৩৫এ’র দামে ৫০ শতাংশ ছাড় দিতে রাজি হয়েছে ড্রাগন সরকার।
এর পাশাপাশি আমেরিকার কাছে সরাসরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স) চেয়েছেন পাকিস্তানের ফেডারেলমন্ত্রী মুসাদিক মালিক। ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে কোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন দেশের থেকে নয়াদিল্লি যে হাতিয়ার কিনেছে, সেগুলি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। সেই কারণেই আমাদের আর্জি, যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক অস্ত্র-প্রযুক্তি আমাদের বিক্রি করুক। সেগুলো আমরা কিনে নেব। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আমাদের খুবই প্রয়োজন।’’
বর্তমানে মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে দু’টি অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। সেগুলি হল, থাড বা ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ এবং ‘এমআইএম-১০৪ প্যাট্রিয়ট’। এগুলির কোনওটি পাকিস্তানকে বিক্রি করা হবে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট করেনি ওয়াশিংটন। তবে ইতিহাসগত ভাবে ইসলামাবাদের সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক রেখে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ আবার সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘অ্যাডভান্স মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট’ বা অ্যামকা তৈরির দিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে লড়াকু জেটের প্রযুক্তি এখনও তৈরি করতে পারেনি এ দেশের গবেষকেরা। ফলে পঞ্চম প্রজন্মের অ্যামকার বায়ুসেনার বহরে সংযুক্তিকরণে বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ লড়াকু জেট হারিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। যদিও তার সংখ্যা এখনও প্রকাশ করেনি নয়াদিল্লি। বর্তমানে ৩১ স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহরে, যা অন্তত ৪২ স্কোয়াড্রন করতে চান তাঁরা। আর তাই বিদেশ থেকে লড়াকু জেট আমদানি করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা নেই কেন্দ্রের সামনে। এ বছর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ভারত সফরে এলে সেই বিমান ‘এসইউ-৫৭ই’ হবে কি না, মিলবে তার উত্তর।