সমরাস্ত্র থেকে জ্বালানি নিরাপত্তা। কিংবা কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নয়াদিল্লিকে সমর্থন। বিপদে-আপদে সব সময় ‘বন্ধু’ রাশিয়াকে পাশে পেয়েছে ভারত। কিন্তু সেই মিত্রতা ভুলে এ বার নয়াদিল্লির পিঠে ছুরি বসাচ্ছে মস্কো? গোপনে গোপনে পাকিস্তানকে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন সরবরাহে রাজি হয়েছে ক্রেমলিন? এই প্রশ্নেই এখন সরগরম এ দেশের ঘরোয়া রাজনীতি। বিষয়টিতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ করেই পাকিস্তানকে ‘আরডি-৯৩এমএ’ নামের লড়াকু জেটের একটি ইঞ্জিন রাশিয়া সরবরাহ করতে চলেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি’ নামের সাড়ে চার প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে ইসলামাবাদ। মস্কোর ইঞ্জিনকে নাকি ওই লড়াকু জেটে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টিতে নয়াদিল্লির উদ্বেগ বেড়েছে।
গত ৪ অক্টোবর এ ব্যাপারে মোদী সরকারকে নিশানা করে লোকসভার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। ওই দিন একে কেন্দ্রের ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতা’ বলে তোপ দাগেন দেশের শতাব্দীপ্রাচীন দলটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ। সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে রাশিয়ার দিক থেকে দু’রকমের প্রতিক্রিয়া মেলায় ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ভারত সরকারও।
পাকিস্তানকে জেট ইঞ্জিন বিক্রি নিয়ে প্রকাশ্যে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি মস্কো। তবে পরিচয় গোপন রেখে এই ইস্যুতে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন এক রুশ শীর্ষকর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা এখন ভারতের সঙ্গে বড় চুক্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছি। নয়াদিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলবে, এই ধরনের কোনও সমঝোতা পাকিস্তানের সঙ্গে কখনওই করা হয়নি। কিছু ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘ভিত্তিহীন’ খবর ছড়ানো হচ্ছে।’’
রুশ আধিকারিকের এই মন্তব্যের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই উল্টো কথা শোনা গিয়েছে সেখানকার সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রিমাকভ ইনস্টিটিউট’-এর কর্তা পিয়েত্র টপিচকানভের গলায়। সংবাদসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানকে মস্কো জেট ইঞ্জিন বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে দু’দিক থেকে লাভ হবে ভারতের।’’ তার কারণও অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে ক্রেমলিন ঠিক কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্পষ্ট করতে পারেননি পিয়েত্র।
সাক্ষাৎকারে টপিচাকানভ বলেন, ‘‘মস্কো পাকিস্তানকে জেট ইঞ্জিন সরবরাহ করলে এটা প্রমাণ হবে যে এ ব্যাপারে ইসলামাবাদ এবং বেজিং এখনও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। তারা আরডি-৯৩-এর উপযুক্ত বিকল্প নির্মাণে সক্ষম হয়নি। দ্বিতীয়ত, তাদের তৈরি যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে ভারত। কারণ, ক্রেমলিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে লড়াকু জেট তৈরি করেছে নয়াদিল্লিও।’’
গত শতাব্দীতে আমেরিকার সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলাকালীন ‘আরডি-৩৩’ নামের একটি টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন তৈরি করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর নির্মাণকারী সংস্থা ক্লিমভ। ১৯৭৪ সালে জন্মের পর বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধবিমানে এই ইঞ্জিনটির বহুল ব্যবহার করতে থাকে মস্কো। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন নির্মাণের লাইসেন্স পায় ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থা ‘হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল। বর্তমানে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ‘আরডি-৯৩এমএ’ পুরনো ইঞ্জিনের উন্নত সংস্করণ বলে জানা গিয়েছে।
রুশ লড়াকু জেট মিগ-২৯, মিগ-৩৩ এবং মিগ ৩৫-এর মতো ‘মাল্টিরোল’ যুদ্ধবিমানগুলিতে রয়েছে ক্লিমভের ‘আরডি-৯৩এমএ’ ইঞ্জিন। এর মধ্যে প্রথম লড়াকু জেটটি ব্যবহার করছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং নৌসেনা। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটি চিনকে সরবরাহ করেছে মস্কো, যা শেনইয়াং এফসি-৩১ নামের যুদ্ধবিমান নির্মাণে কাজে লাগিয়েছে বেজিং। সূত্রের খবর, লড়াকু জেটকে বিদ্যুৎগতি দিতে ৯১.২ কিলো নিউটনের শক্তি জোগানোর ক্ষমতার রয়েছে ‘আরডি-৯৩এমএ’-র।
যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটিকে সামরিক ড্রোনে ব্যবহার করার সুবিধা হয়েছে। রুশ ফৌজ যে ‘মিগ স্ক্যাট’ মানববিহীন হামলাকারী উড়ুক্কু যান ব্যবহার করে, তাতে আছে ক্লিমভের তৈরি ‘আরডি-৯৩এমএ’। তবে ইঞ্জিনটির ‘ড্রাই’ সংস্করণ সেখানে লাগিয়েছেন মস্কোর প্রতিরক্ষা গবেষকেরা, যার শক্তি ৫০ কিলো নিউটনের সামান্য বেশি বলে জানা গিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনটি হাতে পেলে পাক সেনার শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তবে ‘আরডি-৩৩’ ইঞ্জিনটির উন্নত সংস্করণের কিছু সমস্যা রয়েছে। লড়াকু জেট ওড়ানোর জন্য বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারলেও কম সময়ের জন্য পরিষেবা দিয়ে থাকে ‘আরডি-৯৩এমএ’। এর জীবন মাত্র ২,২০০ ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায় বলে জানা গিয়েছে। সেখানে পুরনো ইঞ্জিনটির চার হাজারের বেশি ঘণ্টা ধরে কর্মক্ষম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, বর্তমানে ঘুরপথে এটি পাক সরকারের হাত তুলে দিচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে লড়াকু জেটের ইঞ্জিনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে চিন। তখনই ‘আরডি-৯৩’ ইঞ্জিনের ব্যাপারে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি হয় বেজিঙের। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। পরবর্তী কালে মনমোহন সিংহের আমলেও একই অবস্থান নিয়েছিল নয়াদিল্লি। যদিও তাতে কান দেয়নি মস্কো। একে সাধারণ বাণিজ্যিক চুক্তি হিসাবে বর্ণনা করে অন্য যুক্তি দেয় ক্রেমলিন। তাদের বক্তব্য, কোনও রকম প্রযুক্তি হস্তান্তর ছাড়াই লড়াকু জেটের ইঞ্জিন ড্রাগনকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, ২০০০ সালের গোড়া থেকে চিনকে ক্লিমভের কারখানায় তৈরি জেট ইঞ্জিন পাঠানো শুরু করে রাশিয়া। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে ঘরের মাটিতে একের পর এক যুদ্ধবিমান নির্মাণে বেজিঙের কোনও অসুবিধা হয়নি। বিশ্লেষকদের দাবি, ‘জেএফ-১৭’ যৌথ উদ্যোগে তৈরি লড়াকু জেট হওয়ায় সেখানে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে ড্রাগনের। ফলে ওই রাস্তায় মস্কোর ‘আরডি-৯৩এমএ’ হাতে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে ইসলামাবাদের।
২০১৮ সাল নাগাদ অবশ্য রাশিয়ার সঙ্গে অত্যাধুনিক জেট ইঞ্জিন সংক্রান্ত একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু মস্কো তাতে ‘না’ বলে দেওয়ায় ফের চিনের দ্বারস্থ হয় ইসলামাবাদ। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের গর্বের একাধিক ‘জেএফ-১৭’কে ধ্বংস করে ভারতীয় বায়ুসেনা। ফলে যুদ্ধবিমানটিতে ক্রেমলিনের ইঞ্জিন আদৌ ব্যবহার হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আবার পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআই মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে বলেও একটি তত্ত্ব সামনে এসেছে। রাশিয়া যে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন সরবরাহ করছে, এই খবর প্রথম সমাজমাধ্যমে ভাইরাল করে ইসলামাবাদের একটি ইউটিউব চ্যানেল। পরে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলিতেও এই খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারি ভাবে এই নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। এত বড় সাফল্যেও তাঁরা কেন চুপ? উঠছে প্রশ্ন।
এ বছরের ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। দু’পক্ষে একাধিক প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য চুক্তি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, যা নয়াদিল্লি এবং মস্কোর কাছে ‘মাইলফলক’ হতে চলেছে বলে ইতিমধ্যেই মিলেছে ইঙ্গিত। এ-হেন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে আইএসআই মরিয়া হয়ে উঠেছে, বলছেন এ দেশের সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
পুতিনের ভারত সফরে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির পঞ্চম প্রজন্মের রুশ লড়াকু জেট ‘এসইউ-৫৭’, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ বা ‘এস-৫০০’ এবং ভোরোনেজ় রেডার নিয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যাবতীয় হাতিয়ার নয়াদিল্লিকে ঘরের মাটিতে তৈরির সুযোগ দিতে পারে মস্কো। এ ছাড়া দু’পক্ষের মধ্যে ড্রোন, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ, সামরিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির ব্যবহার, গুপ্তচর কৃত্রিম উপগ্রহ, গোয়েন্দা তথ্যের আদানপ্রদান এবং মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত একাধিক সমঝোতা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ৯ অক্টোবর একটি অনুষ্ঠানে নিজের মুখেই ভারত সফরের কথা জানিয়ে দেন পুতিন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু বলে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের থেকে কৃষিপণ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং তথ্যপ্রযুক্তি লগ্নি ঘরের মাটিতে টানার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। শেষের ক্ষেত্রটিতে আমেরিকার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে রাশিয়া। এ দেশের মেধাবীদের ব্যবহার করে সেই ফাঁক পূরণ করতে চাইছেন ক্রেমলিনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার ব্যবহার করতে পারছে না মস্কো। অন্য দিকে, ভারতীয় টাকায় আমদানি-রফতানি চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ডিসেম্বরে মোদীর সঙ্গে সাক্ষাতে এই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পুতিন। এ দেশের ব্যাঙ্কে থাকা রুশ অর্থ ‘রুবেল’ বিভিন্ন খাতে কী ভাবে লগ্নি করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা মুখ্য হতে চলেছে বলে খবর সূত্রের। এই অবস্থায় জেট ইঞ্জিন পাকিস্তানকে সরবরাহ করার ভুল ক্রেমলিন করবে, এই ধারণা যথেষ্টই কষ্টকল্পিত।
এর আগেও রুশ-ভারত সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করতে একাধিক মিথ্যা প্রচার চালিয়েছে আইএসআই। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ইসলামাবাদের ইস্পাত শিল্পে মস্কোর বিপুল লগ্নি আসতে চলেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, পরে সেটা পুরোপুরি ভুয়ো বলে উড়িয়ে দেন ক্রেমলিনের কর্তাব্যক্তিরা। বছরশেষের মুখে ফের এক বার দেখা যাচ্ছে তারই পুনরাবৃত্তি, বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
ভারতের ঘরোয়া রাজনীতিতে এই নিয়ে কংগ্রেস সুর চড়ানোয় জবাব দিয়েছে কেন্দ্রের এনডিএ শাসক জোটের মূল রাজনৈতিক দল বিজেপি। ৫ অক্টোবর পদ্মশিবিরের নেতারা বিবৃতি দিয়ে বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজমাধ্যমে বিকৃত তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আর সেটা দেখে প্রশ্ন তুলছেন জয়রাম রমেশের মতো নেতারা। নয়াদিল্লি ও মস্কোর সম্পর্ক যথেষ্ট দৃঢ় বলে দাবি করেছেন তাঁরা।