মৃত্যুকে জয় করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন? রুশ প্রেসিডেন্টের ‘অমরত্ব’ প্রাপ্তির জল্পনায় দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল হইচই! বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা। সেখানে অবশ্য ‘যৌবন ধরে রাখার’ রহস্য ফাঁস করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। ব্যাখ্যা করছেন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুফল। পাশাপাশি, সরাসরি ‘অমর’ শব্দটিও উচ্চারণ করেন তিনি। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট মৃত্যুকে পুরোপুরি ফাঁকি দিতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় দিবস’ উপলক্ষে বেজিঙের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে বিশেষ কুচকাওয়াজের আয়োজন করে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ)। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে একগুচ্ছ রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ছিলেন পুতিনও। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্ট কথোপকথনের অনুবাদ মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে, যা থেকে জন্ম হয় ‘অমরত্ব’ সংক্রান্ত প্রশ্নের। পরে গণমাধ্যমের সামনে এসে এর ব্যাখ্যা দেন স্বয়ং পুতিন।
কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে মান্দারিন ভাষায় রুশ প্রেসিডেন্টকে শি বলেন, ‘‘অতীতে খুব কম ব্যক্তিই ৭০ বছর বয়সে পৌঁছোতে পারতেন। কিন্তু, ৭০-এ পৌঁছে আপনি তো এখনও শিশুই রয়ে গিয়েছেন!’’ দোভাষীর মুখে এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ রুশ ভাষায় তাঁর জবাব দেন পুতিন, যার অনুবাদ দাঁড়ায়, ‘‘বর্তমানে জৈবপ্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ফলে মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ক্রমাগত প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। এতে একজন ব্যক্তি ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারেন।’’
রুশ প্রেসিডেন্টের দোভাষী এখানেই চুপ করেননি। পুতিনের কথা অনুবাদ করে তিনি বলেন, ‘‘আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই একজন ব্যক্তি যৌবনকে ধরে রাখতে পারেন। এমনকি এটা তাঁকে অমরও করতে পারে।’’ ওই দিনই বিকেলে বেজিঙে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা। সেখানে ‘অমরত্ব’ নিয়ে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেন এক সাংবাদিক। তখনই প্রকাশ্যে বিস্ফোরক মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে মস্কোর রাষ্ট্রপ্রধানকে।
বেজিঙের সাংবাদিক সম্মেলনে একজন পুতিনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে মানুষের পক্ষে ১৫০ বছর বেঁচে থাকা সম্ভব?’’ জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট শি এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। হ্যাঁ, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যে রকম উন্নতি হয়েছে, তাতে ওষুধ, অস্ত্রোপচার এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করে মানুষ আগের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকার আশা করতেই পারে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বার আর ‘অমরত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেননি তিনি।
বছর ৭২-এর পুতিন কিছু দিন আগে সংবিধান সংশোধন করে নিজের কার্যকালের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) এক ঘনিষ্ঠ রুশ বিজ্ঞানীকে বয়স কমানোর ব্যাপারে গবেষণার নির্দেশ দেন তিনি। এর পরই শুরু হয় স্নায়ু ও জিনকে কাজে লাগিয়ে বয়স আটকানোর গবেষণা। মস্কোর এই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্পের নাম ‘নিউ হেল্থ প্রিজ়ারভেশন টেকনোলজ়ি’। তবে এতে কতটা সাফল্য এসেছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে যথাসম্ভব গোপন রেখেছে ক্রেমলিন।
এর পাশাপাশি ক্রেমলিনের সরকারি উদ্যোগে জিন সংক্রান্ত গবেষণা চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ মিখাইল কোভালচুক। মস্কোর গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, ‘অমরত্ব’ প্রাপ্তির উপায়ের খোঁজ করছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে তাঁর সঙ্গে রয়েছে হরমোন বিশেষজ্ঞ তথা পুতিন-কন্যা মারিয়া ভোরন্তসোভা। তাঁরা এ ব্যাপারে কত দূর অগ্রসর হয়েছেন, সেটাও জানা যায়নি।
বার্ধক্য আটকে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির গবেষণায় রাশিয়া সফল হলে, তার প্রভাব যে বিশ্ব জুড়ে পড়বে, বেজিঙের সাংবাদিক বৈঠকে তা স্বীকার করে নেন পুতিন। বলেন, ‘‘২০৫০ সালের মধ্যে পাঁচ থেকে ছ’বছর বয়সিদের তুলনায় ৬৫ বছরের মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। এটা দুনিয়ার সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে।’’ সূত্রের খবর, মস্কোর পাশাপাশি এ ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেছে চিনও।
চৈনিক গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে ‘অমরত্ব’ প্রাপ্তির ওষুধ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ড্রাগনভূমির গবেষকেরা। কারণ, প্রেসিডেন্ট শি নাকি আয়ু বাড়িয়ে ১০০ বছর বাঁচতে চেয়েছেন। পুতিনের মতো তাঁর বয়সও ৭২। রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি ‘চিনা কমিউনিস্ট পার্টি’ বা সিপিসির (কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না) চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন তিনি। কিংবদন্তি মাও জ়ে-দঙের পর জিনপিংই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাঁকে সর্বাধিক ক্ষমতা দিয়েছে বেজিঙের সমাজতান্ত্রিক সরকার।
২১ শতকে মানুষ সত্যিই ‘অমরত্ব’ পেতে পারে কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রচুর সংশয় রয়েছে। তবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের দাবি, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অবশ্যই জীবন বাঁচানো সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, প্রতিস্থাপিত অঙ্গ দীর্ঘ সময় ধরে ঠিকমতো কাজ করার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে ব্রিটেনের কথা বলা যেতে পারে। যেখানে গত ৩০ বছরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন এক লাখের বেশি রোগী।
বিশ্লেষকদের দাবি, অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সর্বাধিক ভাল ফল দিয়েছে কিডনি। প্রতিস্থাপিত শরীরে যা ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ঠিকমতো কাজ করে গিয়েছে। তবে এই বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করবে দাতা ও গ্রহীতার শারীরিক অবস্থার উপর। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, জীবিত কোনও ব্যক্তির থেকে কিডনি সংগ্রহ করলে সেটি সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে। আর মৃত বা ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া শরীর থেকে সংগ্রহ করা কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে তার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ বছর হয়ে থাকে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিস্থাপিত যকৃৎ গড়ে ২০ বছর, হৃৎপিণ্ড ১৫ বছর এবং ফুসফুস প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে। শি-র সঙ্গে কথোপকথোনে পুতিন বার বার অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথা বলেছেন। চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের কথায়, এটা মোটেই সহজ নয়। মানবদেহে একাধিক বার অস্ত্রোপচার অন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এমনকি অস্ত্রোপচারের সময় মৃত্যুও হতে পারে তাঁর।
দ্বিতীয়ত, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আজীবন নিতে হয় ‘ইমিউনোসপ্রেজ়েন্টস’ নামের একটি শক্তিশালী ‘অ্যান্টি-রিজেকশান’ ওষুধ। এরও মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য। আবার ওষুধটি নেওয়া বন্ধ করে দিলে শরীরে দেখা দেয় অন্য অসুবিধা। সেগুলিকে কাটিয়ে উঠে বার্ধক্যকে ‘বাইপাস’ করে লম্বা সময় বেঁচে থাকা বেশ কঠিন।
তৃতীয়ত, এখনও পর্যন্ত এক জন ব্যক্তির দেহে একাধিক অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নজির প্রায় নেই বললেই চলে। ‘অমরত্ব’-এর জন্য সেটা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া কিডনি, যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের মতো মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পদ্ধতি এখনও আবিষ্কার হয়নি। ফলে শরীরের বয়স কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা গেলেও চিন্তাশক্তি যে বার্ধক্যের দিকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
জনপ্রিয় ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা ‘বিবিসি’-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে জিনগত বদল ঘটিয়ে শূকরের অঙ্গ মানবদেহে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের একাংশ। চতুষ্পদ প্রাণীটির অঙ্গগুলির আকার মানুষের অঙ্গের প্রায় সমান। আর তাই এতে সাফল্য পেতে ‘ক্রিস্পার’ নামের একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করছেন তাঁরা। অঙ্গের পুরোপুরি জিনগত বদল না হলে অবশ্য এই গবেষণা যে মাঠে মারা যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কয়েক বছর আগে দু’জন মানুষের দেহে জিনগত বদল ঘটিয়ে শূকরের হৃৎপিণ্ড এবং কিডনি অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের একটি দল। কিন্তু সেখানে সাফল্য পাননি তাঁরা। অস্ত্রোপচারের সময়েই মৃত্যু হয় ওই দুই রোগীর। তবে জীবন্ত কোষ এবং কলার ক্ষেত্রে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে বদলে যাওয়ার সামান্য একটা ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন গবেষকেরা।
অন্য দিকে, ব্রিটিশ চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরা আবার নিজস্ব মানবকোষ ব্যবহার করে নতুন অঙ্গ তৈরির চেষ্টা করছেন। ২০২০ সালে এ ব্যাপারে ইঁদুরের উপরে একটি পরীক্ষা চালান তাঁরা। তাতে আংশিক সাফল্য মিলেছিল। কিছু ইঁদুর মারা গেলেও কয়েকটা বেঁচে গিয়েছিল।
তবে এই গবেষণাগুলির সবই চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত। এগুলির উদ্দেশ্য মানুষের আয়ুকে ১৫০ বছরে নিয়ে যাওয়া নয়। মানবজাতিকে ‘অমরত্ব’ও দিতে চাইছেন না তাঁরা। শুধু অসুস্থতার সময় যন্ত্রণা লাঘব করতে চাইছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা। ফলে রাশিয়া এবং চিনের বার্ধক্য ঠেকানোর বিশেষ প্রকল্পকে এর চেয়ে অনেকটাই আলাদা বলে মনে করা হচ্ছে।