পৃথিবীর শীতলতম ও শুষ্কতম স্থান। দূর থেকে দেখলে অপরূপ সুন্দর। কাছে গেলেই মৃত্যুর হাতছানি লুকিয়ে শ্বেতশুভ্র বরফের পরতে পরতে। নীরব, প্রাণহীন এই মহাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বার বার মুগ্ধ হয়েছে পথিবী। পুরু বরফের আস্তরণের গভীরে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে, যা খুঁজে বার করতে বার বার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রীরা সেখানে ছুটে গিয়েছেন।
আন্টার্কটিকার ৯০ শতাংশই পুরু বরফের আস্তরণে ঢাকা। মাইলের পর মাইল তুষারের চাদর। সবুজের প্রায় কোনও চিহ্ন মেলে না সেখানে। এ-হেন আন্টার্কটিকায় হদিস মিলল কোটি কোটি টন ব্যারেল তেলের। অনুসন্ধানের কৃতিত্ব মস্কোর। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি অনুযায়ী আন্টার্কটিকার হিমায়িত ভূপৃষ্ঠের নীচে বৃহত্তম অপ্রকাশিত তেলের মজুতের সন্ধান পেয়েছেন রুশ গবেষকেরা।
ইংল্যান্ডের হাউস অফ কমন্সের পরিবেশগত নিরীক্ষা কমিটির সাম্প্রতিক নথিতেও প্রকাশিত হয়েছে যে, রাশিয়ার ভূতাত্ত্বিকরা ওয়েডেল সাগর অঞ্চলে ‘ব্রিটিশ অধিকৃত’ আন্টার্কটিকায় বিশাল তেলের ভান্ডার খুঁজে পেয়েছেন। আর তাই নিয়েই ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে ‘তেলের যুদ্ধে’ নামতে পারে ব্রিটেন। কারণ সাগরের যে অংশটিতে খনিজ তেলের ভান্ডার রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে সেটি ব্রিটেনের অধীকৃত বলে দাবি উঠেছে। একই অঞ্চলের দাবি নিয়ে সরব হয়েছে চিলি ও আর্জেন্টিনাও।
বরফের চাদরের নীচে আনুমানিক ৫৫ হাজার ১১০ কোটি ব্যারেল তেলের খোঁজ মিলেছে বলে দাবি করেছে মস্কো। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫০ বছরে উত্তর সাগর থেকে যে পরিমাণ তেল উত্তোলন করা হয়েছে, তার প্রায় ১০ গুণ তেল জমা রয়েছে বরফের মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।
এই তেলের উত্তোলনপর্ব শুরু হলে তা সৌদি আরবের মজুত তেলের পরিমাণকেও টেক্কা দিতে পারবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। কারণ বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির তেলের ভান্ডারের তুলনায় দ্বিগুণ তেল চাপা পড়ে রয়েছে বরফের নীচে, এমনটাই জানিয়েছেন খনিজ বিজ্ঞানীরা। বিপুল তেলের অধিকার কোন দেশ কুক্ষিগত করবে তা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৯৫৯ সালের আন্টার্কটিক চুক্তি। মহাদেশটিকে সুরক্ষাকবচ পরাতে আমেরিকা, ইংল্যান্ড-সহ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজ়িয়াম, চিলি, ফ্রান্স, জাপান, নিউ জ়িল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এই চুক্তি করে। ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে ১ আগস্ট ১৯৮৩ সালে আন্টার্কটিক চুক্তিতে যোগ দেয়। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে দেশটি আন্টার্কটিক চুক্তির পঞ্চদশ পরামর্শদাতা সদস্য হয়ে ওঠে।
এই মহাদেশটিতে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে সমস্ত রকম সামরিক কার্যকলাপ বা সেখানকার সম্পদ শোষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে চুক্তিতে। মূলত অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও শোষণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য দেশগুলি একজোট হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চুক্তি অনুসারে, আন্টার্কটিকায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থের নিষ্কাশন নিষিদ্ধ। একই ভাবে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য খনিজ পদার্থ ও খনিজ তেল অনুসন্ধানের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে সেখানে।
আন্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থা একটি জটিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এটি আন্টার্কটিকায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া ইতিমধ্যেই মহাদেশটিতে পাঁচটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছে। তারই মাঝে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে চিন হাত মেলানোয়। বেজিং এবং মস্কো সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কৌশলগত চুক্তিতে একত্রিত হয়ে পশ্চিমের দেশগুলির দখলীকৃত অঞ্চলগুলি সম্প্রসারণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে।
অন্য দিকে আবার চিলি এবং আর্জেন্টিনা ইতিমধ্যেই আন্টার্কটিকার ভূখণ্ডের দাবিকে জোরদার করে তুলতে সেখানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতকলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। গবেষকদের জন্য স্থায়ী বসতি স্থাপনও করেছে বলে জানা গিয়েছে। চিলিও রাশিয়ার ‘অনৈতিক অনুসন্ধান পর্ব’ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। আন্টার্কটিকার ঘাঁটিগুলির নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশও এসেছে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকেই রাশিয়ার এই কৌশল ক্রমবর্ধমান বলে দাবি করেছে পশ্চিমি দেশগুলি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। রাশিয়াকে আর বিশ্বাস করা যায় না বলে সে সময়ই সতর্ক করেছিলেন পশ্চিমি দেশগুলির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, ওই অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার আড়ালে পুতিনের দেশ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তেল ও গ্যাস খোঁজার দিকেই বেশি মনোযোগী।
সাধারণত ভূকম্পন, ভূতাত্ত্বিক এবং খনিজ অনুসন্ধান বিষয়গুলি নিয়ে গবেষণা করে থাকে রাশিয়ান অনুসন্ধান সংস্থা রসজিও। এই সংস্থার গবেষকরাই বরফের নীচে তেলের অস্তিত্ব খুঁজে বার করেছেন। তার পর থেকে এই সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ সরকার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকা ও বিরোধী দেশগুলির সঙ্গে মস্কোর দ্বন্দ্ব সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পশ্চিমি বিশ্বের দাবি, আন্টার্কটিকার গোপন সম্পদ তুলে বিশ্বব্যাপী তা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইছে ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার। ভবিষ্যতের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়া আন্টার্কটিকাকে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা বিরোধী দেশগুলির। তেলের ভান্ডার কব্জা করতে পারলে রাশিয়ার শক্তি যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুদ্ধের সময়ে সামরিক এবং আর্থিক দিক থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জ্বালানির। পেট্রল-ডিজ়েলের জোগান ঠিকমতো না হলে রণাঙ্গনে এক চুলও এগোতে-পিছোতে পারবে না ফৌজ। সেটা বুঝতে পেরেই বর্তমান সময়ে অপরিশোধিত তেল মজুতের বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলতে চাইছে বিশ্বের অন্যতম ‘সুপার পাওয়ার’ এই দেশটি।
বর্তমানে খনিজ তেলের সর্বাধিক মজুত ভান্ডার রয়েছে আমেরিকার। প্রায় ১০০ দিনের বেশি জ্বালানি সংরক্ষিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় স্থানে আছে চিন। বেজিঙের জ্বালানি ভান্ডারে মজুত আছে ৯০ দিনের তেল। রাশিয়ার তেলের মজুত প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি ব্যারেল, যা বিশ্বের মোট মজুতের প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ।
সাম্প্রতিক ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের আবহে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা ছড়িয়েছে সারা বিশ্বেই। চলতি বছরের ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত চলা ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের মধ্যে পারস্য উপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দেয় তেহরান। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ওই জলপথের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া থেকে বহির্বিশ্বে রফতানি করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, ইজ়রায়েলকে কেন্দ্র করে যে ভাবে অস্থিরতা বাড়ছে তাতে ফের আকাশছোঁয়া হতে পারে তেলের দাম। সেই পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে খনিজ তেলের মজুত ভান্ডারের আরও শ্রীবৃদ্ধি করতে চাইছে রাশিয়া। আর তাই আন্টার্কটিকার মজুত তেল হাতের মুঠোয় আনতে চাইছে মস্কো।
অনুসন্ধানের ছদ্মবেশে আন্টার্কটিকার মাটিতে নিজেদের ঘাঁটি ও কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করার অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছে মস্কো। তারা স্পষ্ট জানিয়েছে, তেলের সন্ধানের এই কার্যক্রমের ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক। পুতিনের সরকারের বিবৃতি অনুসারে এই তেলের মজুতকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কাজে লাগানোর জন্য কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।