ইন্ডাস্ট্রিতে এসে নিজের নাম বদলে ফেলেছিলেন। বহু নায়িকার প্রেমে পড়েছিলেন। বিয়েও করতে চেয়েছিলেন একাধিক নায়িকাকে। মহিলা অনুরাগীদের সংখ্যা কোনও অংশে কম ছিল না। তবুও সংসার করার স্বপ্ন পূরণ হল না বলি অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ‘শোলে’র ঠাকুর।
১৯৩৮ সালের ৯ জুলাই গুজরাতের সুরতে জন্ম হয় সঞ্জীবের। তাঁর আসল নাম ছিল হরিহর জেঠালাল জরীওয়ালা। ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার পর নিজের নাম পরিবর্তন করে সঞ্জীব কুমার রাখেন তিনি। সুরতে বাবা-মা, দুই ভাই এবং এক বোনের সঙ্গে থাকতেন। অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়তে চান বলে মুম্বই চলে যান।
ছোটবেলা থেকে মঞ্চে অভিনয় করতেন সঞ্জীব। পরে মুম্বই গিয়েও নাটকের দলের সদস্য হিসাবে যোগ দেন তিনি। মঞ্চে তাঁর নজরকাড়া অভিনয় থেকে বলিউডে ‘হম হিন্দুস্থানি’ ছবিতে ডাক পান সঞ্জীব। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে খুব ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও দর্শকের মন জিতে ফেলেন তিনি। তার পর একাধিক ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করেন।
কেরিয়ারের শুরুর দিকে পরিচিতি পেলেও বেশ কয়েকটি নিম্নমানের ছবিতেও কাজ করতে বাধ্য হন সঞ্জীব। এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা জানিয়েছিলেন, কেবল টাকাপয়সা জমানোর জন্য এবং অভিনয়ের মাঠে টিকে থাকার জন্য অনেক সময় চিত্রনাট্য পছন্দ না হলেও কাজ করতে রাজি হয়ে যেতেন ‘শোলে’ ছবির ‘ঠাকুর বলদেও সিংহ’।
নায়কোচিত চেহারা না হলেও সঞ্জীবের মহিলা অনুরাগীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। সঞ্জীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অঞ্জু মহেন্দ্রু নায়কের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সঞ্জীবের জীবনে এত নারী ছিল যে, তাঁদের নাম ধরে ডাকত না। সংখ্যা দিয়ে বোঝাত। তাঁদের প্রসঙ্গে কথা বললে এ ভাবে বলত, ‘৩ নম্বর আজ আমায় ফোন করেছিল। ৯ নম্বর আজ আমার সঙ্গে কী রকম একটা করেছে।’’’
১৯৭২ সালে ‘সীতা অউর গীতা’ ছবির সেটে বলি অভিনেত্রী হেমা মালিনীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সঞ্জীবের। কানাঘুষো শোনা যায়, হেমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন নায়ক। হেমাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু নায়কের প্রস্তাব নাকি ফিরিয়ে দেন হেমা।
বলিপাড়ার জনশ্রুতি, হেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সময় একটি শর্ত রাখেন সঞ্জীব। অভিনেতার দাবি, বিয়ের পর হেমাকে অভিনয়জগৎ থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন নায়ক। সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় হেমার সঙ্গে সংসার করার স্বপ্ন চিরতরে ভেঙে যায় সঞ্জীবের।
বলিউডের একাংশের দাবি, পেশাগত সূত্রে পরিচয় হলেও বলি অভিনেত্রী সুলক্ষ্মণা পণ্ডিত নাকি সঞ্জীবের প্রেমে পড়ে যান। নায়ককে বিয়ে করতে চান বলে সরাসরি প্রস্তাবও দেন সুলক্ষ্মণা। কিন্তু সেই সময় সঞ্জীব নাকি হেমার প্রেমে ডুবেছিলেন। তাই সুলক্ষ্মণার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। ভালবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী করতে না পারায় সারাজীবন অবিবাহিতা থাকার সিদ্ধান্ত নেন নায়িকা।
অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, বলি অভিনেত্রী শাবানা আজ়মির প্রতিও ভাল লাগা ছিল সঞ্জীবের। শাবানাও নাকি অভিনেতাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়। সঞ্জীব এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, শাবানাকে পুত্রবধূ হিসাবে পছন্দ হয়নি তাঁর মায়ের। মায়ের অমতে অভিনেত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক পাতাতে চাননি সঞ্জীব।
অঞ্জু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘নারীদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল সঞ্জীব। ওর মন এত বার ভেঙেছে যে, বাস্তবটাই অন্য রকম ভাবে দেখা শুরু করে দিয়েছিল। সঞ্জীবের মনে হত, দুনিয়ার সব মেয়েই ওর সঙ্গে টাকার জন্য মিশছে। এটা ঠিক যে, অনেকেই সঞ্জীবের কাছে অকারণে ঘোরাফেরা করত। এমনকি, ও খেতে ভালবাসত বলে বাড়িতে রান্না করেও পাঠিয়ে দিত। কিন্তু কেউ কেউ সঞ্জীবকে সত্যিই ভালবাসত। সঞ্জীব তা বুঝতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আর সংসার-সুখ ওর ভাগ্যে জুটল না।’’
সঞ্জীবের পরিবার ছিল নিরামিষাশী। বাড়ির অন্দরে কোনও রকমের মাংস খাওয়া বা কিনে নিয়ে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। কিন্তু সঞ্জীব এত কিছু মানতেন না। মাছ-মাংস সবই খেতেন তিনি। কিন্তু নিজের বাড়িতে আমিষ খাওয়ার উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে অন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, মুম্বইয়ের পালি হিলে একটি এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন সঞ্জীব। আমিষ খাবারের সঙ্গে মাঝেমধ্যে মদ্যপানও করতেন তিনি। এমনও দিন গিয়েছে, যখন ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত মদ-মাংসে ডুবে থেকেছেন।
কানাঘুষো শোনা যায়, সঞ্জীবের সঙ্গে মদ-মাংসের আসরে মাঝেমধ্যে উপস্থিত থাকতেন শাম্মি কপূর, শত্রুঘ্ন সিংহ, রণধীর কপূর এবং সচিন পিলগাঁওকরের মতো বলি তারকা। তবে অধিক মদ্যপান সহ্য হয়নি অভিনেতার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে তাঁর।
প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর আমেরিকায় অস্ত্রোপচারও করানো হয় সঞ্জীবের। কিন্তু দ্বিতীয় বারের ধাক্কা আর সামলাতে পারেননি তিনি। ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় এই জনপ্রিয় অভিনেতার। সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তাঁর আরও দশটি ছবি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।
চলচ্চিত্রে সঞ্জীবের অবদানের কথা স্মরণ করে তাঁকে বিশেষ সম্মান জানাতে ভারতীয় ডাক বিভাগের তরফে ২০১৩ সালে অভিনেতার সচিত্র ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। সংসার করা ছাড়াও আরও একটি ইচ্ছাপূরণ হয়নি অভিনেতার। নিজের বাড়ি করতে চেয়েছিলেন তিনি। বহু বছর ধরে চেষ্টা করার পর একটি সম্পত্তি কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখেননি তিনি। তাই প্রচুর খরচ করে সম্পত্তি কিনলেও তার মালিকানা পাননি অভিনেতা।