বাড়ছে গরম। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকায় সকলের ঘেমেনেয়ে একশা দশা। এই অবস্থায় ঠান্ডা পানীয়ে গলা ভিজিয়ে একটু স্বস্তি পেতে চাইছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে এক এক জনের পছন্দ এক এক রকমের। কারও কাছে নরম পানীয় বলতে শুধুই কোকা কোলা ও পেপসি। কেউ আবার মজে থাকেন ফ্যান্টায়। শেষেরটির উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাডল্ফ হিটলার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
নরম পানীয় ফ্যান্টার জন্ম জার্মানিতে। ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে একে তৈরি করেন ম্যাক্স কিথ নামের এক ব্যক্তি। ফ্যান্টার উৎপত্তিকালে ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়েছিল হিটলারের আতঙ্ক। আগ্রাসী ফুয়েরার তখন ফ্রান্স দখল করে পূর্ব দিকে মন দিয়েছেন। লক্ষ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে হঠাৎ করেই তাঁর বাহিনী কমিউনিস্ট শাসিত দেশটিকে আক্রমণ করে বসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সন্ধিক্ষণে বাজারে আসে ফ্যান্টা। সালটা ছিল ১৯৪১। জার্মানিতে তখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে বহুজাতিক মার্কিন নরম পানীয় সংস্থা কোকা কোলার একটি শাখা সংস্থা কোকা কোলা ডয়চল্যান্ড। সেখানকার পদস্থ আধিকারিক ছিলেন কিথ। লড়াইয়ের বাজারে ভারী বিপাকে পড়ে জার্মান সংস্থাটি।
১৯৪১ সালে জাপানি হামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবার। এর পর সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বছর জাপানের পাশাপাশি জার্মানির উপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ওয়াশিংটন। ফলে বার্লিনে নরম পানীয় পাঠানো কোকা কোলার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো রঙ্গমঞ্চে ঢুকে পড়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনী। আটলান্টিকে অবরোধ গড়ে তোলে তারা। ফলে আমেরিকা থেকে নরম পানীয় কোকা কোলার বার্লিনে আসার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এতে জার্মান সংস্থাটির বাড়তে থাকে লোকসান।
এ হেন দুর্দিনে এগিয়ে আসেন কিথ। ঠিক করেন, একেবারে নতুন ধরনের একটি পানীয় বাজারে নিয়ে আসবেন তিনি। আর তাতে স্থানীয় উপাদানগুলি ব্যবহার করা হবে। কোকা কোলা ডয়চল্যান্ডের কর্মীদের নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়লেন তিনি। ফলও মেলে হাতেনাতে।
নতুন পানীয়টি তৈরি করতে চিনি, পনির, আপেল, আঙুর এবং জলপাইয়ের রস ব্যবহার করেন কিথ। নিজেই সেগুলি উচ্ছিষ্ট খাবার হিসাবে মনে করতেন তিনি। অল্প দিনের মধ্যে কম খরচে নতুন পানীয় তৈরি করতে সক্ষম হন ম্যাক্স। স্বাদে-গন্ধে কোকা কোলাকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার।
এর পর গোল বাধল নতুন পানীয়টির নামকে কেন্দ্র করে। কিথ বুঝলেন, শুধুমাত্র কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এটিকে তৈরি করেছেন তাঁরা। আর তাই নামটাও জুতসই হওয়া চাই। জার্মান ভাষায় ফ্যান্টাসি শব্দের অর্থ হল মজা বা কল্পনা। সেটাই এখানে ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেন তিনি।
কিন্তু, এ ব্যাপারে আপত্তি জানান বিক্রয়কর্মী জো নিপ। তিনি নরম পানীয়টির নাম ছোট করে ফ্যান্টা করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিথের ব্যাপারটা মনে ধরেছিল। নিপের পরামর্শমতো ওই নামেই পানীয়টিকে বাজারজাত করেন তিনি। স্বাদে-গন্ধে একেবারে অন্য রকম হওয়ায় হু-হু করে বাড়তে থাকে এর বিক্রি।
জন্মের মাত্র দু’বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৪৩ সাল) জার্মানিতে ৩০ লক্ষ ফ্যান্টার বোতল বিক্রি হয়েছিল। সেই সময়ে নরম পানীয় হিসাবে অনেকে এটি ব্যবহার করতেন না। বরং সুপ ও স্টিউতে মিষ্টি স্বাদ আনার জন্য মেশানো হত ফ্যান্টা। পানীয়টিতে চিনির পরিমাণ কিন্তু ছিল বেশ কম।
বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির মতো একই সমস্যায় পড়ে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামের কোকা কোলার সংস্থা। কিথ ফ্যান্টার ব্র্যান্ডটি তাদের হাতে তুলে দেন। ডাচরা আবার নরম পানীয়টির উপাদানে বদল আনেন। এতে মেশানো হয় এল্ডারবেরি। ফলে দুই দেশে দু’ধরনের ফ্যান্টা বিক্রি হচ্ছিল।
ইউরোপে লড়াই থামার চার বছরের মাথায় ফ্যান্টার উৎপাদন বন্ধ করে দেয় কোকা কোলা। সালটা ছিল ১৯৪৯। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বেশি দিন টেকেনি। ১৯৫৫ সালে নতুন রূপে বাজারে ফেরে ফ্যান্টা। এ বার ইটালির হাত ঘুরে নয়া স্বাদ ও গন্ধ নিয়ে ভক্তদের সামনে আসে এই নরম পানীয়।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নতুন ধরনের বেশ কয়েকটি পানীয় বাজারে আনে কোকা কোলার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী পেপসি। ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে ফ্যান্টার পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন ছিল। নরম পানীয়টি নবজীবন লাভ করে ইটালির নেপল্স শহরে। বড় বদল আসে এর উপাদানে।
নেপল্সে নতুন করে যে ফ্যান্টা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে মেশানো হয় কমলালেবুর রস। প্রাথমিক ভাবে সেটি তৈরি করে স্থানীয় একটি সংস্থা, নাম সোসায়েট নেপোলেটানা ইম্বোটিগ্লিয়ামেন্টো বেভান্ডে গ্যাসেট। ১৯৬০ সালে ফর্মুলাটি কিনে নিয়ে ব্যাপক হারে ফ্যান্টার উৎপাদন শুরু করে কোকা কোলা।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে ফ্যান্টা কিন্তু আমেরিকায় পাওয়া যেত না। এর মূল বাজার ছিল ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা। কোম্পানির পদস্থ কর্তারা মনে করেছিলেন, ফ্যান্টা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এলে কোলা কোলার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। আর তাই এই সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
২১ শতকের গোড়ায় ল্যাটিন আমেরিকাবাসীদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে বৃদ্ধি পেলে ফ্যান্টাকে আর ব্রাত্য করে রাখতে পারেনি কোকা কোলা। এ বার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই পানীয়টিকে ঢালাও বিক্রি করতে থাকে তারা। বর্তমানে সারা বিশ্বে ২০০-র বেশি স্বাদে পাওয়া যায় ফ্যান্টা। তবে সর্বাধিক জনপ্রিয় ইটালির নেপল্সে তৈরি কমলালেবুর রসযুক্ত নরম পানীয়টি।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্যান্টার ৭৫তম বার্ষিকীতে জার্মানিতে ফের নতুন করে বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পানীয়টিকে তৈরি করে বাজারে আনে কোকা কোলা। এর জন্য ঢালাও বিজ্ঞাপন করেছিল তারা। সেখানে বলা হয়, পুরনো সময়ের অনুভূতি অনুভব করুন। নরম পানীয়ের সেই বোতলগুলি বিক্রি হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
কোকা কোলা জানিয়েছে, নতুন করে তৈরি হওয়া ৭৫ বছর আগের পানীয়ে ৩০ শতাংশ পনিরের উপকরণ ব্যবহার করেছে তারা। এ ছাড়া এতে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ফলের রস আর অতি অল্প পরিমাণে চিনি। এটিকে বাজারে আনার সময়ে টিভির বিজ্ঞাপনে পানীয়টির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে হিটলারের আমলের নাৎসি শাসনের একটা আলাদা ব্যাখ্যা দিয়েছিল কোকা কোলা।