প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসতেন পোষ্যকে। সন্তানস্নেহে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিলেন তাঁকে। এমনকি নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতেন পরিচিতদের কাছে। সেই প্রিয় পোষ্যই সাক্ষাৎ ‘মৃত্যুর দূত’ হয়ে নেমে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাবাহিনীর এক মেজরের জীবনে।
একদা মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে তোলা প্রাণীটিই যে খোদ নিজের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি ৪০ বছর বয়সি সেনাকর্তা মারিয়াস এলস। নদী থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ।
মৃতদেহ উদ্ধারের পর তাঁর দেহে কোনও বিশাল প্রাণীর কামড় ও আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পান চিকিৎসকেরা। সেই আঘাত দেখে তাঁরা নিশ্চিত হন, পোষা প্রাণীটিই নির্মম ভাবে হত্যা করেছে মালিককে। পোষ্য ঘাতকের নাম হামফ্রে। প্রায় দেড় টন ওজনের একটি জলহস্তী। ২০০৫ সালে বন্যার জলে ভেসে যাওয়া এই বন্যপ্রাণীটিকে উদ্ধার করে এনেছিলেন মারিয়াস। ২০১১ সালে তার আক্রমণে মৃত্যু হয় মারিয়াসের।
উদ্ধার করে আনার পর তিনি জলহস্তীটির নাম দেন হামফ্রে। তখন জলহস্তীটির বয়স মাত্র পাঁচ মাস। খরচ করে আইনি প্রক্রিয়ায় হামফ্রেকে দত্তকও নিয়েছিলেন মারিয়াস। ছ’বছর ধরে তাঁর ৪০০ একরের কৃষিখামারে বড় হচ্ছিল হামফ্রে। মালিকের সঙ্গে ধীরে ধীরে সখ্যও তৈরি হয়েছিল।
পোষা প্রাণী না ভেবে হামফ্রেকে পরিবারের সদস্য বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন মারিয়াস। প্রায়শই তার সঙ্গে নদীর পারে বেড়াতে চলে যেতেন। নদীর জলে চলত জলকেলি। জলহস্তীটিকে মানুষের সঙ্গে সাঁতার কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই সংক্রান্ত ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পাঁচ বছর বয়সি জলহস্তীর পিঠে চড়ে মারিয়াসের ছবিটি খুঁজলে এখনও পাওয়া যায়।
বিশাল বপুর জলহস্তীটির পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন নির্ভীক সেনাধিনায়ক। মারিয়াসের সঙ্গে হামফ্রের এই সখ্য দেখে অবশ্য আতঙ্কিত হতেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা। শেষমেশ তাঁদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। মারিয়াসের মৃতদেহ নদীতে ডুবে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই নদী থেকেই তিনি মারা যাওয়ার ছ’বছর আগে বন্যার সময় জলহস্তীটিকে উদ্ধার করেছিলেন।
বন্য জন্তুর সঙ্গে এই মাখামাখি দেখে স্ত্রী ও আত্মীয়-বন্ধুরা তাঁকে অনেক বার সতর্ক করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তবে সেই সমস্ত সাবধানবাণীকে তেমন আমল দিতেন না মারিয়াস। তাঁকে বলতে শোনা যেত, ‘‘হামফ্রে আমার ছেলের মতো। ও একজন মানুষের মতোই আচরণ করে। আমার এবং হামফ্রের মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক রয়েছে যা অনেকেই বুঝতে পারেন না।’’
মারিয়াস মনে করতেন, কেবল কুকুর, বিড়াল এবং গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা যায় এমনটা নয়। আফ্রিকার অন্যতম বিপজ্জনক প্রাণীটির সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক আছে, এটা ভেবে আত্মতৃপ্তি অনুভব করতেন তিনি।
মারিয়াসের স্ত্রী লুইস, পেশায় এক ফার্মাসিস্ট। তাঁর স্বামীর এই আদরের পোষ্য সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করতেন তিনিও। জলহস্তীটির আচরণ সম্পর্কে তিনি প্রায়ই সন্দেহ প্রকাশ করতেন। কারণ এই বিশাল প্রাণীটি আগেও সমস্যা বয়ে এনেছিল। মারিয়াসের কাছে ‘বাধ্য ছেলে’র মতো আচরণ করলেও এলাকার মানুষ বিশাল বপুর এই প্রাণীটিকে খানিকটা সমঝেই চলতেন।
২০১১ সালের গোড়ার দিকে হামফ্রের তাড়া খেয়ে ৫২ বছর বয়সি এক ব্যক্তি এবং তাঁর সাত বছরের নাতিকে দু’ঘণ্টা একটি গাছের উপরে উঠে বসে থাকতে হয়েছিল। অবশেষে জলহস্তীটিকে একটি আপেলের লোভ দেখিয়ে সেখান থেকে টেনে আনেন মারিয়াস।
হামফ্রের বিরুদ্ধে মারিয়াসের কাছে আরও অভিযোগ জমা পড়ত। কয়েকটি বাছুরকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল হামফ্রের বিরুদ্ধে। প্রাণীটি অধিকাংশ সময় বেড়া ভেঙে বেরিয়ে আসত। প্রায়শই স্থানীয় গল্ফ ক্লাবে গল্ফারদের তাড়া করে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ জমা হত মারিয়াসের কাছে।
এর মধ্যেই মারিয়াসের জীবনে নেমে আসে সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনটি। মারিয়াসকে নদীতে আঘাত করে এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে জলে ডুবিয়ে রেখে তাঁর মৃত্যু ঘটায় পোষ্যটি। মারিয়াসের শরীরে কিছু কামড়ের চিহ্নও ছিল।
ঠিক একই ধরনের আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। লিওন ভ্যান বিলজন নামের এক ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন তাঁর তিনটি পোষ্য সিংহের কামড়ে। ‘লায়ন ম্যান’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ৭০-এর লিওন। যাদের তিনি ছোট থেকে কোলেপিঠে করে বড় করে তুলেছিলেন তাদের কাছ থেকেই এসেছিল মৃত্যুর পরোয়ানা।
২০১৯ সালের অগস্ট মাসে লিওনের ‘মহলা ভিউ লায়ন গেম লজে’ ঘটেছিল এই মারাত্মক ঘটনাটি। সিংহের থাকার জায়গার বেড়াটি আরও সুরক্ষিত করার জন্য মেরামত করেছিলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি সিংহ এসে পিছন থেকে তাঁকে আক্রমণ করে ঘাড় কামড়ে দেয়। এর পর একে একে বাকি সিংহগুলি আক্রমণ করে পালকপিতাকে। বাধা দেওয়ার কোনও সুযোগই পাননি লিওন।
বন্যপ্রাণীদের যতই প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন তাদের পাশবিক প্রবৃত্তি হঠাৎ করে জেগে উঠতেই পারে। ফলে পরিণতি মারাত্মক হতে পারে বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থার কর্মীরা। অনেকেই মনে করছেন, লিওন ও মারিয়াস দু’জনেই মারাত্মক ভুল করেছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বন্যপ্রাণীদের পোষ্য হিসাবে রাখা উচিত নয়। বন্য পশুর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সখ্য না করলে এই প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব ছিল বলে মনে করছেন তাঁরা।