South Indian Industry

বিন্ধ্য পর্বত পেরোলেই ‘শিল্প বিপ্লব’! পণ্য তৈরিতে পয়লা নম্বরে থাকা চিনকে মাটি ধরাবে দক্ষিণী ‘পঞ্চপাণ্ডব’?

শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্রুত গতিতে উত্থান ঘটছে দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্যের। আগামী দিনে চিনকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাদের, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ১০:১৬
Share:
০১ ২০

বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম থেকে গাড়ি। যন্ত্রাংশ হোক বা লোহা-ইস্পাত শিল্প। পণ্য উৎপাদনের নিরিখে সারা দুনিয়াকে টেক্কা দিয়েছে চিন। আজকের ড্রাগনভূমিকে তাই বিশ্বের কারখানা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে এ ব্যাপারে পয়লা নম্বর জায়গা ধরে রেখেছে বেজিং। এ বার কি সেখানেই থাবা বসাবে দক্ষিণ ভারত? বিন্ধ্য পর্বতের নীচের পাঁচ রাজ্যে ধীরে ধীরে শিল্পবিকাশের লক্ষণ স্পষ্ট হওয়ায় এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।

০২ ২০

কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা। বিশ্লেষকদের দাবি, দক্ষিণী এই ‘প়ঞ্চপাণ্ডব’-এর হাত ধরে ধীরে ধীরে দেশের শিল্প অর্থনীতির পালে লাগতে শুরু করেছে নতুন হাওয়া। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম থেকে অ্যাভিয়েশন, এমনকি পরিষেবামূলক তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে এই পাঁচ রাজ্য। সূচকের এই ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলে অচিরেই তারা চিনকে ছুঁয়ে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Advertisement
০৩ ২০

শিল্পোৎপাদনের নিরিখে দাক্ষিণাত্য গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললেও কেন পিছিয়ে উত্তর ভারত? বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সেখানকার রাজ্যগুলির একাধিক নীতির কারণে তৈরি হয়েছে এই তফাত। অর্থনীতির তত্ত্ব বলছে, যেখানে সরকার বা প্রশাসন ক্লাস্টার তৈরি করতে সক্ষম হবে, সেখানে শিল্পবিকাশের সম্ভাবনা থাকবে ষোলো আনা। কারণ, ক্লাস্টারের হাত ধরেই তৈরি হয় উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পরিকাঠামো।

০৪ ২০

এখন প্রশ্ন হল, কী এই ক্লাস্টার? যখন কোনও সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে কোনও একটি শিল্পোৎপাদক সংস্থা এবং তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহকারী কোম্পানিগুলি গড়ে ওঠে তখনই তাকে বলে ক্লাস্টার। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকাটিতে থাকে পরিষেবা প্রদানকারী এবং অন্যান্য সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সমাহার। ভারী শিল্পের মাধ্যমে বিপুল উৎপাদনের জন্য এই ক্লাস্টারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

০৫ ২০

বিশেষজ্ঞদের দাবি, আধুনিক শিল্পের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য অনেক জায়গার চেয়ে এগিয়ে আছে দাক্ষিণাত্য। আর তাই সেখানে ক্লাস্টার গড়ে তোলা গিয়েছে। রেল এবং সড়কপথের মাধ্যমে ওই এলাকাটি সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণের পাঁচটির মধ্যে চারটি রাজ্যেরই একাংশ সমুদ্রঘেরা হওয়ায় সেখানে রয়েছে একাধিক বন্দর। ফলে বিদেশে পণ্য আমদানি-রফতানির ভাল সুযোগ পেয়ে থাকেন সেখানকার উদ্যোগপতিরা।

০৬ ২০

উদাহরণ হিসাবে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুম্বুদুর, হোসুর এবং কৃষ্ণগিরির কথা বলা যেতে পারে। এই তিন জায়গায় যথাক্রমে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, অ্যারোস্পেস এবং বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভির (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। তেলঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদে আবার এক দিকে যেমন আছে তথ্যপ্রযুক্তি হাব, অন্য দিকে তেমনই বিপুল পরিমাণে তৈরি হচ্ছে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।

০৭ ২০

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে পণ্য রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে হায়দরাবাদের যাবতীয় ফার্মা সংস্থা। তাদের তৈরি ওষুধ মূলত কিনেছে পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। বর্তমানে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের বাজারেও পা জমানোর চেষ্টা করছে ওই সমস্ত কোম্পানি।

০৮ ২০

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পোৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি ভারত। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য। ১৯৯১ সালে এই চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আনেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। দেশের অর্থনীতিতে উদারীকরণ নিয়ে আসেন তিনি। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত গতিতে আসতে শুরু করে বিদেশি লগ্নি।

০৯ ২০

আর্থিক উদারীকরণের প্রথম সুফল দেখা যায় পরিষেবা ক্ষেত্রে। কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে গড়ে ওঠে ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’। সেখানকার একের পর এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ঘরের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও কাজ করতে শুরু করে। তাতে অবশ্য দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) সূচকের বিরাট উন্নতি হয়েছিল, এমনটা নয়। তবে প্রযুক্তিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায় ভারতে।

১০ ২০

২১ শতকের প্রথম দশকের পর শিল্পোৎপাদনের দিকে বেশি করে নজর দেওয়া শুরু করে কেন্দ্র। আর তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর মতো স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছে। প্রশাসনের দেওয়া তথ্যে দেখা গিয়েছে, ২০২৪ সালে জিডিপির ১৭ শতাংশ এসেছে ঘরের মাটিতে উৎপাদিত সামগ্রী থেকে। চলতি বছরের শেষে এই সূচককে ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার।

১১ ২০

কেন্দ্র শিল্পমুখী মনোভাব নিতেই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাক্ষিণাত্য। বিশ্লেষকদের দাবি, আজকের দিনে তারই সুফল পাচ্ছে সেখানকার পাঁচটি রাজ্য। তবে বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের উদ্যোগপতিদের আনাগোনা বেশি হওয়ার নেপথ্যে মূলত রয়েছে একটি কারণ। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সব সময় শিল্পবান্ধব নীতি নিয়েছে তারা। ফলে সেখানে কারখানা খোলা অনেক বেশি সহজ হয়েছে।

১২ ২০

বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, দাক্ষিণাত্যের পাঁচ রাজ্যের কোথাও জমি অধিগ্রহণের সমস্যা নেই। কারখানা খোলার জন্য সব সময়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়ে থাকেন সেখানকার উদ্যোগপতিরা। শিল্পোৎপাদন শুরু করার ক্ষেত্রে ১০ বছরের জন্য ছাড় মেলে করে। এ ছাড়া অন্যান্য পরিষেবা, পরিকাঠামোগত সুযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ক্লাস্টারগত সুবিধাও পেয়ে থাকেন তাঁরা।

১৩ ২০

সেই কারণে বর্তমানে ঘরের মাটিতে তৈরি গাড়ির সরঞ্জামের ৫০ শতাংশ সরবরাহ করছে তামিলনাড়ু। ভারত থেকে রফতানি হওয়া বৈদ্যুতিন পণ্যের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চেন্নাই। ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেঙ্গালুরুতে আবার কম্পিউটার-ল্যাপটপের হার্ডঅয়্যার কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়ায় গতি আনতে জোর দিচ্ছে সরকার। অন্ধ্রের ওয়ারাঙ্গলে চলছে ই-সিটির নির্মাণকাজ। বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ক্লাস্টার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তেলঙ্গানার হায়দরাবাদের।

১৪ ২০

সস্তা শ্রমিক থাকার কারণে উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় এত দিন পর্যন্ত চিনকে শিল্পের স্বর্গরাজ্য বলে মনে করছিল ইউরোপ এবং আমেরিকা। কিন্তু, আর্থিক দিক থেকে শক্তি বাড়তেই নানা ইস্যুতে পশ্চিমি দুনিয়াকেই চোখ রাঙাতে শুরু করে বেজিং। এর জেরে ইতিমধ্যেই ড্রাগনের বিকল্প খোঁজা শুরু করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই জায়গায় ভারতকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করছে তারা।

১৫ ২০

বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, আগামী কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এ দেশে আসতে শুরু করবে চিনের শিল্পোৎপাদন। ফলে নতুন নতুন কারখানা তৈরি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেখানেও উত্তর ভারতের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে দাক্ষিণাত্য। কারণ ওই এলাকার পাঁচটি রাজ্যের শিক্ষার হার খুব বেশি। ফলে শিল্প সংস্থার পক্ষে দক্ষ শ্রমিক পাওয়া একেবারেই কঠিন হবে না।

১৬ ২০

শিল্পে অগ্রগতির জন্য দক্ষিণ ভারতে রয়েছে একাধিক ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ বা এসইজ়েড (স্পেশাল ইকোনমিক জ়োন) এবং লজিস্টিক হাব। তবে এত কিছুর পরেও চিনকে টেক্কা দিতে বিন্ধ্য পর্বতের নীচের ‘পঞ্চপাণ্ডব’-এর সামনে চ্যালেঞ্জ কিন্তু কম নেই। সংখ্যার নিরিখে সেখানে উচ্চশিক্ষিত অতি দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি। উৎপাদনের জন্য পলিটেকনিক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিতদের বিপুল সংখ্যায় নিয়োগের প্রয়োজন হয়। দক্ষিণ ভারতে ওই ধরনের কর্মীর কিছুটা অভাব রয়েছে।

১৭ ২০

এ ছাড়া কাঁচামালের নিরিখে বিদেশি নির্ভরতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারত। উদাহরণ হিসাবে সেমিকন্ডাক্টর, বিরল খনিজ এবং ইউরেনিয়ামের কথা বলা যেতে পারে। চিনকে পিছনে ফেলতে হলে এ ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে দক্ষিণ ভারতকে। এ ছাড়া দেশের শ্রম আইন সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি জমির ডিজিটাল তথ্য রাখার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

১৮ ২০

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ‘এক জেলা এক পণ্যের’ মতো শিল্প ধরে ধরে তার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে দক্ষিণ ভারতকে। বিদেশি লগ্নিকারীদের টানতে কিছু কিছু আইনের আরও সরলীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। অনেক সময়ে সরকারি লাল ফিতের ফাঁসে আটকে যাওয়ায় উৎপাদন শুরু হতেই অনেকটা দেরি হয়ে যায়।

১৯ ২০

এগুলি ছাড়া রাজনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের একটা অন্য অসন্তোষ রয়েছে। আর্থিক দিক থেকে এই এলাকা অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হওয়ায় কেন্দ্রকে অনেক বেশি কর দেয় সেখানকার পাঁচটি রাজ্য। কিন্তু রাজ্যগুলির অভিযোগ, কখনওই দিল্লিতে সে ভাবে গুরুত্ব পান না সেখানকার নেতা-নেত্রীরা। আর তাই প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার পক্ষপাতী তারা।

২০ ২০

শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে চিনের শেনজ়েন এবং ডংগুন এলাকার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে সেখানে ধীরে ধীরে বাড়ছে শ্রমিক খরচ। অন্য দিকে, উত্থান হচ্ছে বেঙ্গালুরু এবং চেন্নাইয়ের। তবে শেষ পর্যন্ত এই দৌড়ে দক্ষিণ ভারত ড্রাগনকে হারিয়ে দেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement