ক্ষমতায় এসেই জনগণের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করল দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন সরকার। কোরীয় সংবাদমাধ্যম ‘কোরিয়া হেরাল্ড’ জানিয়েছে, সে দেশের সরকার চাইছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কোরীয় জনগণের হাতে টাকার জোগান বজায় রাখতে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকে পুনরুজ্জীবিত করতেই এই প্রচেষ্টা সরকারের।
আগামী ২১ জুলাই থেকে দেশের সকল স্তরের নাগরিকের মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ শুরু করবে সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত লি জে মিয়ং প্রশাসন। দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যয় বৃদ্ধি করা এবং মন্থর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা এই দাওয়াইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ।
এই আর্থিক সহায়তা প্রকল্পটিকে ‘কনসাম্পসন কুপন’ বলে বর্ণনা করেছে সোল। অর্থাৎ, কোরীয়দের গৃহকার্যের খরচ বাড়াতে সরকারের তরফে বিশেষ সহায়তা।
গত শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদে এই অর্থনৈতিক প্রকল্পের অনুমোদন মেলে বলে সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের বাজেট বরাদ্দ থেকে ২ লক্ষ ৫২ কোটি টাকা বা ৩১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি ওন (দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা) ধার্য করা হয়েছে বিশেষ এই সহায়তা প্রকল্পে। প্রথম ধাপে ২১ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় আট সপ্তাহ ধরে চলবে এটি।
প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ জুন থেকে দেশে বসবাসকারী প্রতিটি দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক এককালীন ১ লক্ষ ৫০ হাজার ওন বা ১১০ ডলার করে অর্থসাহায্য পাবেন। ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ন’হাজার টাকা। ডেবিট, ক্রেডিট, প্রিপেড কার্ড কিংবা স্থানীয় সরকারের অনুমোদিত ভাউচারের মাধ্যমে টাকা পাবেন জনতা।
হতদরিদ্র পরিবারগুলির দিকে সরকার অতিরিক্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদাগুলি কোনওক্রমে মিটিয়ে যে সব মানুষ দিনাতিপাত করছেন, সেই পরিবারগুলিকে পৃথক ভাবে অর্থসাহায্য করবে লি জে মিয়ঙের সরকার।
দারিদ্র-পীড়িত পরিবার ও একক ভাবে সন্তানদের দায়িত্ব পালন করেন এমন বাবা-মাকে ৩ লক্ষ ওন বা ২২০ ডলার করে অর্থসাহায্য করা হবে। জীবনযাত্রা নির্বাহ করার জন্য যে সব পরিবার সরকারি ভাতার উপর নির্ভর করে থাকে, তারা ৪ লক্ষ ওন বা ২৯০ ডলার করে সাহায্য পাবে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারীরা অতিরিক্ত ৫০ হাজার ওন পাবেন।
আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং জনসংখ্যা ধরে রাখার জন্য সোলের মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে বসবাসকারী নাগরিকেরা (গিওংগি প্রদেশ এবং ইনচিওন-সহ) অতিরিক্ত ৩০ হাজার ওন পাবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এমন কয়েকটি গ্রাম ও জনপদ রয়েছে, যেখানে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। সেই সমস্যার সম্মুখীন গ্রামের মধ্যে ৮৪টি মনোনীত গ্রামকে এবং মৎস্যজীবীদের গ্রামগুলিকে অতিরিক্ত ৫০ হাজার ওন দেওয়া হবে।
সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে প্রথম দফার সাহায্য শেষ হবে। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার অর্থ প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সর্বনিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশ কোরীয় ১ লক্ষ ওন (৭৩ ডলার) পাবেন। জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা প্রিমিয়ামের উপর ভিত্তি করে এঁদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হবে এবং সেপ্টেম্বরে বিস্তারিত ঘোষণা করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলির তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া দ্বাদশ স্থানে রয়েছে। এশিয়ায় চতুর্থ। বিত্তশালীই বলা যায় এই দেশটিকে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে সমৃদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে অর্থনীতির দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষিণ কোরিয়া।
দেশটির জিডিপি ১৯৬০ সালে ছিল প্রায় ১৫৮ ডলার। সেই জায়গা থেকে ২০২১ সালে জিডিপির পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়, ৩৫ হাজার ডলারে পৌঁছোয়। তা হলে কেন এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হল দক্ষিণ কোরিয়ায়?
অতিমারি পরবর্তী পর্যায়ে সেখানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে প্রযুক্তিখাত থেকে দেশের আর্থিক অগ্রগতি তেজি হলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে পড়ে দ্বীপরাষ্ট্রটি। এই আর্থিক মন্দার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই দায়ী করেছেন দেশের আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত বছর (২০২৪ সালে) ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক (মার্শাল) আইন জারি করেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইওল। এর ফলে দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। ইওলের যুক্তি ছিল, উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের মদতে ক্ষমতাদখলের ছক কষছেন বিরোধীরা। সেই ঘটনার পর দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে।
উচ্চ সুদের হার এবং লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে খুচরো বিক্রি এবং রেস্তরাঁয় মানুষের ব্যয়ের ওপর, যা অসংখ্য ব্যবসাকে বন্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশীয় ছোট ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে ও অর্থনীতির পালে হাওয়া জোগাতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণকে নগদ সহায়তা, ডিজিটাল ভাউচার এবং এআই খাতে বিনিয়োগের মতো কর্মসূচি চালু করেছে পীত সাগরের এই দেশটি।
মনে করা হচ্ছে, প্রান্তিক মানুষের হাতে সরাসরি কিছু টাকা পৌঁছে দেওয়ার পর গ্রহীতা এই টাকা ভোগ্যপণ্যের ওপর সরাসরি খরচ করে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়াবেন। দেশে যে শুধু জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়বে তা-ই নয়, জনগণ যে টাকা খরচ করবেন তাতে ব্যবসা চাঙ্গা হবে। সরকারের আয় বাড়বে। তাতে দেশের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটবে। পরিকাঠামোর উন্নতি হলে বিনিয়োগও খানিকটা বাড়তে পারে। তাতে দেশের অর্থনীতি তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ত্বরান্বিত করবে বলে মত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।