বেক সিহি, তরতাজা একটি প্রাণ। মাত্র ৩৫ বছরেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। এ যেন ‘ডিয়ার জ়িন্দেগি’র গল্পের মতো। যদিও বেকের জীবনে সিনেমার মতো আর ‘হ্যাপি এন্ডিং’ হল না!
বেক দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় লেখক। যিনি মনের অসুখ সারাতে সাহায্য নিয়েছিলেন চিকিৎসকের। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব দুঃখ-কষ্টের কথা ভাগ করে নিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে। তবে ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। শত শত মানুষকে বাঁচার অনুপ্রেরণা দিতে লিখে গিয়েছেন বইও।
বেকের বইয়ের নামটিই সকলের মনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। তাঁর বইয়ের নাম, ‘আই ওয়ান্ট টু ডাই বাট আই ওয়ান্ট টু ইট তকবোওকি’। অর্থাৎ ‘আমি মৃত্যু চাই, কিন্তু তকবোওকি খেতেও চাই’। বইয়ের ভেতরেও রয়েছে এই বিশেষ বাক্যটি।
কোরিয়ান একটি পদ তকবোওকির কথা উল্লেখ করেছেন বেক। তবে বেকের এই লেখা থেকে সাহিত্যপ্রেমীরা উপলব্ধি করেন, তিনি এক দিকে যেমন আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন, তেমনই অন্য দিকে ভাল থাকার রসদগুলিও খুঁজে পেতে চাইতেন।
বইয়ের প্রতিটি লাইন বলে দেয় কী ভাবে এক জন মানুষ প্রতি দিন বিষণ্ণতার সঙ্গে লড়াই করছেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এই বইটি এখনও পর্যন্ত ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ব জুড়ে বইটি নাকি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কিনেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যজগতে বেশ আলোচিত নাম বেক সিহি। তাঁর আত্মজীবনীর সুবাদেই এই পরিচিতি। এটি শুধু একটি বই-ই নয়, এটি সেই সব বিষণ্ণ মানুষদের জন্য আশার আলো, যারা ক্রমশ একাকিত্বের গহ্বরে তলিয়ো যাচ্ছেন।
এক বছর আগে পর্যন্তও বেক সমাজমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যেই নানা রকম ছবি পোস্ট করতেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর শেষ পোস্ট নিজের বইকে নিয়েই।
বইটির ইংরেজি সংস্করণের প্রচ্ছদে দু’ভাগে রয়েছে সবুজ এবং হালকা গোলাপি রং। প্রচ্ছদটি এমন ভাবে আঁকা যেন মনে হচ্ছে নীচের গোলাপি অংশটি খাবার টেবিল। সেখানে রাখা আছে খাবার। সেই খাবারের সামনে চপস্টিক হাতে মাথা এলিয়ে বসে রয়েছে একটি মেয়ে। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে খাবারের দিকে। মেয়েটির ছবি যেন বেকের মনের অবস্থাই জানান দিচ্ছে।
প্রচ্ছদের উপরে সবুজ অংশে লেখা বইয়ের নাম। লেখিকা এবং অনুবাদকের নামও আছে সেখানেই। পাশে রয়েছে একটি গোলাপিরঙা বৃত্ত। তার ভেতরে লেখা, ‘মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরবর্তী কথোপকথন’। এই ছবিটি পোস্ট করার বছরখানেক পরই এল সবচেয়ে খারাপ খবরটি।
চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর মৃত্যু হয়েছে বেকের। জীবনের ৩৫ বছর অতিক্রম করলেও আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেন না। কোরিয়া অর্গান অ্যান্ড টিস্যু ডোনেশান এজেন্সির তরফে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
বেক তাঁর হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার ও দু’টি কিডনি দান করেছেন। তা দিয়ে আরও পাঁচ জনের প্রাণ বাঁচবে বলেই মনে করছে ওই এজেন্সি। দীর্ঘ দিন বিষণ্ণতার রোগে ভুগলেও বেকের মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ উল্লেখ করেনি এই সংস্থা।
বেকের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এনে সংস্থার পরিচালক লি সাম ইয়ল বলেন, “জীবনের শেষ মুহূর্তেও বেক যে ভালবাসা ও আশার বার্তা ছড়িয়েছেন, তা অন্যদের জীবনে নতুন আলো জ্বালিয়েছে।”
১৯৯০ সালে গিয়ংগি প্রদেশের গোইয়াং শহরে বেকের জন্ম। ছোট থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিলেন বেক। লেখালিখি তাঁর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল। পড়াশোনা শেষের পর এক প্রকাশনা সংস্থায় কাজও করেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর।
চাকরি করাকালীন ধীরে ধীরে মনের অসুখ গ্রাস করতে থাকে বেককে। ‘ডিসথাইমিয়া’ নামক দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতার অসুখ ধরা পড়ে তাঁর। এই রোগের ফলে মানুষের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা বাসা বাঁধে।
তিনি যে ‘ডিসথাইমিয়া’র শিকার, সে কথা বেক নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই খুব একটা দেরি করেননি আর। ছুটে গিয়েছিলেন মনের ডাক্তারের কাছে। দীর্ঘ দিন চিকিৎসা চলেছিল।
চিকিৎসাধীন থাকাকালীন চলা জীবন সংগ্রাম নিয়ে বইটি লেখা। সমাজমাধ্যমেও টুকটাক ভাগ করতেন সে সব কথা। ইংরেজি সংস্করণেটির ছবি সমাজমাধ্যমে বেক প্রকাশ করেছিলেন ২০২৪ সালের ১৮ মে। নিজের ভাষায় শিরোনামে লিখেছিলেন ‘বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হবে ৬ জুন! সবাই ভালবাসবেন আশা করি।’ লেখার সঙ্গে ‘ইমোজি’ও দিয়েছিলেন তিনি।
ওটিই সমাজমাধ্যমে তাঁর শেষ পোস্ট। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই মনখারাপ অনুরাগীদের।
কেউ লিখেছেন, ‘‘প্রতি বার আপনার আত্মজীবনী পড়লে গভীর শান্তি পেতাম এবং বাঁচার কারণ খুঁজে পেতাম।’’ আবার কেউ লেখেন, ‘‘এই এক বছর তোমার বই পড়েই ভাল আছি, জীবনকে অন্য ভাবে দেখা শুরু করেছি।’’ অনুরাগীদের লেখাগুলি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, বেক শুধু এক জন লেখিকাই নন, তিনি বহু মানুষের বেঁচে থাকার কারণ।