পঠানভূমিতে কুরুক্ষেত্র! এক ইঞ্চি জমিও যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না বলে এ বার হুঙ্কার ছাড়ল তালিবান। ফলে হিন্দুকুশের কোলের দেশটি ফের এক বার মার্কিন সামরিক অভিযানের মুখে পড়তে পারে বলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে মধ্য এশিয়ার পরিস্থিতি যে অস্থির হবে, তা বলাই বাহুল্য। আর এর আঁচ এসে লাগবে ভারতের গায়েও।
‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি। আমু দরিয়ার তীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের মাত্র চার বছরের মাথায় ফের ওই ছাউনি ফেরত চেয়ে গোঁ ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে মুখ খোলেন পঠানভূমির তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের চিফ অফ স্টাফ ফাসিহুদ্দিন ফিতরত। ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকাকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। বিশ্লেষকদের ভাষায় তাঁর কথার সারমর্ম হল, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’।
গণমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে ফাসিহুদ্দিন বলেন, ‘‘কিছু লোক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাইছেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও বিদেশি শক্তির হাতে সমর্পণ করা হবে না। এখানে ওদের কোনও প্রয়োজন নেই।’’ তবে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে বাগরাম ছাউনি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছে, নাম না করে তা স্পষ্ট করেছেন তিনি। তালিবানের এ-হেন ‘শরীরী ভাষা’ ট্রাম্পের ক্ষোভের আগুনে যে ঘি ঢেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বাগরাম বিমানঘাঁটিতে মার্কিন ‘অনুপ্রবেশ’ মানতে না চাওয়ার কারণ অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তালিবানের মন্ত্রী ফাসিহুদ্দিন। তাঁর যুক্তি, এতে বিঘ্নিত হবে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা। তা ছাড়া ওই বিমান ছাউনির ‘কৌশলগত অবস্থান’-এর গুরুত্ব ভালই জানে কাবুল। অন্য দিকে পঠানভূমির ‘জঙ্গি সংগঠন’ পরিচালিত সরকারকে এই নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লেখেন, ‘‘বাগরাম বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে আমেরিকা। ওরা যদি সেটা ফিরিয়ে না দেয়, তা হলে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।’’
এখানে ‘খারাপ কিছু’ শব্দবন্ধের অর্থ কী, তা অবশ্য খোলসা করেননি ৭৯ বছরের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। পরে এই নিয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। ‘‘আমেরিকা কি আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালাবে?’’ সরাসরি এই কথা জানতে চাওয়া হলে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে নিজের দফতরে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘এটা নিয়ে এখনই কিছু বলব না। আমরা কাবুলের সঙ্গে কথা বলছি। খুব দ্রুত বাগরাম ঘাঁটি ফিরে পেতে চাই। ওরা যদি সেটা না দেয়, তা হলে জানতে পারবেন আমরা কী করতে যাচ্ছি।’’
৯/১১ জঙ্গি হামলার বদলা নিতে ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে আমেরিকা। মার্কিন সেনা অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডম’। অল্প দিনের মধ্যেই কাবুলের তখ্ত থেকে তালিবানকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। পরবর্তী ২০ বছর হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে নিজেদের দখলে রেখেছিল আমেরিকার বাহিনী। সেখানে তাঁদের যাবতীয় সৈনিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগরাম সেনাঘাঁটি।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হলে আফগানিস্তানে বাড়তে থাকে কমিউনিস্ট প্রভাব। ওই সময় মস্কোর অর্থানুকূল্যে বাগরাম বিমানঘাঁটিকে সাজিয়ে তোলে তৎকালীন কাবুল সরকার। ১৯৭৯ সালে আমু দরিয়া পেরিয়ে কাবুল দখল করে সোভিয়েত ফৌজ। হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে ওই বায়ুসেনা ছাউনিকে আরও অত্যাধুনিক করে তোলে ক্রেমলিন।
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ত্যাগ করে সোভিয়েত সেনা। পরবর্তী ১২ বছর বাগরাম বিমানঘাঁটির কোনও সংস্কার হয়নি। ২০০১ সালে মার্কিন ফৌজ হিন্দুকুশের কোলের দেশটি দখল করার পর ফের সেটিকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ওয়াশিংটন। সেই লক্ষ্যে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে পিছপা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সেই খরচের বহর অবশ্য কত, তা আজও গোপন রেখেছে আমেরিকা।
উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের অন্তর্গত বাগরাম বিমানঘাঁটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১,৪৯২ মিটার। রাজধানী কাবুল থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ৬০ কিলোমিটার। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ছাউনিতে রয়েছে দু’টি কংক্রিটের রানওয়ে। সেখানে অনায়াসে অবতরণ করতে পারে ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ বা ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’-এর মতো বিশালবপু সামরিক মালবাহী বিমান। এ ছাড়াও ঘাঁটিটিতে রয়েছে লড়াকু জেট রাখার কমপক্ষে তিনটে বড় হ্যাঙ্গার। বিশ্লেষকদের দাবি, ওখান থেকে ড্রোন হামলাও পরিচালনা করতে পারবে বিশ্বের যে কোনও বাহিনী।
২০১০ সাল নাগাদ মার্কিন নিয়ন্ত্রণে থাকা বাগরাম বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি ছোট শহর। সেখানে ছিল ‘ডেয়ারি কুইন’ এবং ‘বার্গার কিং’-এর মতো আউটলেট-সহ বেশ বড় একটা সুপারমার্কেট। এ ছাড়া আছে ছোট একটি হাসপাতাল। সেটির নির্মাণেও যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অবদান ছিল বলে জানা গিয়েছে। ২০১২ সালে বাগরামে অবতরণ করেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা। ২০১৯ সালে প্রথম বার ক্ষমতায় থাকাকালীন সেখানে পা পড়েছিল ট্রাম্পেরও।
‘কাবুলিওয়ালার দেশ’টির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়। ১৯৬০ সালে আফগানিস্তান সফরে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজ়েনহাওয়ার। তাঁর বিমানও থেমেছিল বাগরাম বায়ুসেনা ঘাঁটিতে। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান পঠানভূমির রাজা জ়াহির খান এবং প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান। দু’তরফে সম্পর্ক আরও মজবুত হয় গত শতাব্দীর ৮০-এর দশকে। এর জন্য সোভিয়েত আগ্রাসনকেই দায়ী করে থাকেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
২০১১ সালের ২ মে কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী অল কায়দার শীর্ষনেতা তথা ৯/১১ হামলার মূল চক্রী ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে নিকেশ করে মার্কিন কমান্ডোবাহিনী। ২০১৭-’২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রাম্প। লাদেন অধ্যায় শেষ হওয়ায় আফগানিস্তানে বাহিনী রাখার আর কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি তিনি। ফলে কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে তাঁর সরকার।
সংশ্লিষ্ট সমঝোতার পর ২০২০ সাল থেকে ধীরে ধীরে কাবুল ত্যাগ করতে থাকে মার্কিন বাহিনী। এই প্রক্রিয়া পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ও অব্যাহত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ মে-র মধ্যে আমেরিকার সৈনিকদের হিন্দুকুশের কোলের দেশটি ছাড়ার কথা ছিল। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে অগস্ট কেটে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ফৌজ সরাতেই আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরে তালিবান।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আমু দরিয়ার পার থেকে দেশে ফেরার সময় সেখানে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার ফেলে আসে মার্কিন বাহিনী। ক্ষমতায় ফিরেই সেগুলি হস্তগত করে তালিবান। এই নিয়ে পূর্বসূরি বাইডেনের কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘যাবতীয় সামরিক সরঞ্জাম ওখানে ফেলে আসা ভুল সিদ্ধান্ত। সমস্ত হাতিয়ার নিয়ে ঘরে ফেরা উচিত ছিল।’’ এর পরই বাগরাম পুনরুদ্ধারের কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রথম বার বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনর্দখলের ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘হিন্দুকুশের কোলের দেশটির বাগরাম বায়ুসেনা ছাউনি ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের জন্য খুবই জরুরি।’’ ট্রাম্পের এ-হেন মন্তব্যের সময় তাঁর পাশেই ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। ফলে ওয়াশিংটনের ‘অপারেশন বাগরাম’-এ ইংরেজ সামরিক শক্তি শামিল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটির উপর কেন হঠাৎ নজর পড়েছে ট্রাম্পের? প্রকাশ্যেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। তাঁর দাবি, ওই বায়ুসেনা ছাউনি থেকে সরাসরি চিনের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজর রাখতে পারবে আমেরিকা। কারণ, হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সীমান্ত লাগোয়া এলাকাতেই নাকি রয়েছে ড্রাগনের আণবিক অস্ত্রের কারখানা। এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, ‘‘বেজিঙের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির জায়গাটার দূরত্ব বাগরামের থেকে এক ঘণ্টারও কম।’’ কৌশলগত দিক থেকে এ-হেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তাই ফেরত পেতে চাইছেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, ট্রাম্পের পক্ষে বাগরাম ফেরত পাওয়া মোটেই সহজ নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকে আটকাতে এ বার রাশিয়া এবং চিন— দু’টি ‘মহাশক্তিধর’ দেশের থেকে সাহায্য পেতে পারেন তালিবান নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই কাবুলের শাসকদের নাম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে মস্কো। অন্য দিকে তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে চিন। হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে তাদের উপর ওয়াশিংটন নজরদারি চালাক, তা বেজিঙের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
সম্পূর্ণ ভাবে স্থলবেষ্টিত হওয়ায় আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালানোর রাস্তা পাওয়া কঠিন। আর তাই সাবেক সেনাকর্তারা মনে করেন, বাগরাম ফেরত পেতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইসলামাবাদের বর্তমান সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। পাকিস্তানে ক্রিপ্টো ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বিনিময়ে সেখানকার নৌ ও বিমানঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ যে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেল দেবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
গত কয়েক দশকে আফগানিস্তানে বিপুল লগ্নি করেছে ভারত। বর্তমান তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। পঠানভূমিতে ফের মার্কিন সামরিক আগ্রাসন শুরু হলে সেই বিনিয়োগ জলে যেতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে থাকাকালীন সেখানে বাণিজ্যিক লেনদেন বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা হয়নি কেন্দ্রের।
আফগানিস্তানকে বলা হয় ‘সাম্রাজ্যের সমাধিক্ষেত্র’। ১৯৮৯ সালে সেখান থেকে বাহিনী প্রত্যাহারের মাত্র দু’বছরের মাথাতেই ভেঙে যায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া মিলিয়ে গড়ে ওঠে ১৫টি স্বাধীন দেশ। সেই একই পরিণতির দিকে কি পা বাড়াচ্ছে আমেরিকা? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়।