জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে লোকসভা ও বিধানসভা আসনের হবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ (ডিলিমিটেশন)। কেন্দ্রের এ হেন সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করেছে তামিলনাড়ু। এতে দিল্লিতে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব কমবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণী রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তামিলভূমিতে জন্ম হয়েছে নতুন বিতর্কের। স্ট্যালিনের যুক্তি মানতে নারাজ কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
আগামী বছর তামিলনাড়ুতে রয়েছে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে কেন্দ্র। আর এখানেই আপত্তি রয়েছে তামিল সরকারের। শুধু তা-ই নয়, লোকসভা ও বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে যাতে রাজনৈতিক লোকসান না হয়, তার জন্য দ্রুত রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন। আর এ ব্যাপারে জনপ্রিয় অভিনেতা তথা ‘মক্কাল নিধি মাইয়ম’-এর (সেন্টার ফর পিপল্স জাস্টিস) নেতা কমল হাসনকে পাশে পেয়েছেন তিনি।
স্ট্যালিনের যুক্তি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময়ে সেই অনুপাতে তামিলনাড়ুতে বাড়বে সাংসদ এবং বিধায়কের সংখ্যা। এতে দিল্লিতে বজায় থাকবে দক্ষিণী রাজ্যটির প্রভাব। তার জন্য নবদম্পতিদের বেশি করে সন্তান উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দক্ষিণী রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী।
২০২৩ সালের ২৮ মে দিল্লিতে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর আসন সংখ্যা ১ হাজার ২৭২। এর পর থেকেই লোকসভা এবং বিধানসভার আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কথা বলতে শুরু করে বিজেপি। যদিও সরকারি ভাবে তার দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
নিয়ম অনুযায়ী, জনসংখ্যার পরিবর্তন হলে লোকসভা এবং বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। জনসংখ্যার সঙ্গে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামঞ্জস্য রাখতে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এতে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা পুনর্নির্ধারণ করে কেন্দ্র।
সংবিধানের ৮২ এবং ১৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে লোকসভা এবং বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কথা বলা রয়েছে। আইন অনুযায়ী, সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী এই সীমানা পুনঃনির্ধারণের কাজ করবে সরকার। আর গোটা প্রক্রিয়াটির তদারকি করবে সীমানা পুনর্নির্ধারণের সংসদীয় কমিশন।
লোকসভা এবং বিধানসভার সীমানা পুনর্নির্ধারণ হলে, বেশি জনসংখ্যার রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে আসন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। আবার যেখানে জনসংখ্যা কম, সেখানে কমবে আসনের সংখ্যা। আর ঠিক এই জায়গাতেই আপত্তি রয়েছে তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন সরকারের।
ডিএমকে নেতৃত্বের বক্তব্য, আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ সর্বশেষ জনগণনার উপর করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই আইনের তোয়াক্কা করছে না বিজেপি। আদমসুমারি হওয়ার আগেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার, যা বেআইনি।
দ্বিতীয়ত, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির তুলনায় আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়নি তামিলনাড়ুর জনসংখ্যা। ফলে, লোকসভা এবং বিধানসভার সীমানা পুনর্নির্ধারণ হলে দক্ষিণের রাজ্যটিতে আসন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা কমবে। সে ক্ষেত্রে দিল্লিতে গুরুত্ব হারাবেন তামিল রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা।
বর্তমানে তামিলনাড়ু বিধানসভার আসনসংখ্যা ২৩৪। দক্ষিণের রাজ্যটি থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় যেতে পারেন ৩৯ জন। লোকসভা এবং বিধানসভার সীমানা পুনর্নির্ধারণ হলেও এই আসনসংখ্যা ধরে রাখতে মরিয়া মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন। এই উদ্দেশ্যে তামিল রাজনৈতিক দলগুলিকে এককাট্টা করতে একটি সর্বদল বৈঠক ডাকেন তিনি। তাতে অবশ্য যোগ দেয়নি বিজেপি।
স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে প্রথম বার লোকসভা এবং বিধানসভার সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ করেছিল কেন্দ্র। এর পর ১৯৬১ এবং ১৯৭১ সালে ফের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনে একে স্থগিত করে কেন্দ্র। মূলত, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে উৎসাহিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
২০০১ সালে ৮৪তম সংবিধান সংশোধন করে কেন্দ্র। সেখানেও লোকসভা ও বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়। ওই সময়েই ২০২৬ সাল পর্যন্ত এটি স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০৩১ সালে ভারতে জনগণনার কথা রয়েছে। তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন সরকারের দাবি, সেই আদমসুমারির রিপোর্ট দেখে লোকসভা এবং বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করুক কেন্দ্র। কিন্তু তা মানতে নারাজ মোদী সরকার।
বর্তমানে লোকসভার আসনসংখ্যা ৫৪৩। এর মধ্যে দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন ১২৯ জন। সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর লোকসভার মোট আসন বেড়ে ৭৫৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণী রাজ্যগুলির মোট আসন দাঁড়াবে ১৪৪।
সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর তামিলনাড়ুর লোকসভা আসন ৩৯ থেকে বেড়ে ৪১ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য রাজ্যগুলির মধ্যে তেলঙ্গানায় ১৭ থেকে বেড়ে ২০, অন্ধ্রপ্রদেশে ২৫ থেকে বেড়ে ২৮ এবং কর্নাটকে ২৮ থেকে বেড়ে ৩৬ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, দক্ষিণী রাজ্যগুলির মধ্যে একমাত্র কেরলে কমতে পারে আসনসংখ্যা। বর্তমানে সেখান থেকে নির্বাচিত হন ২০ জন সাংসদ। সেই সংখ্যা ১৯ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির ২২২টি আসন রয়েছে। সেটা ৩৫৭ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক আসন বাড়তে পারে উত্তরপ্রদেশের। বর্তমানে যোগীরাজ্যের মোট সাংসদের সংখ্যা ৮০। সেটা বেড়ে ১২৮ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিহারের ৪০ আসন বেড়ে ৭০, মধ্যপ্রদেশের ২৯ বেড়ে ৪৭, মহারাষ্ট্রের ৪৮ বেড়ে ৬৮ এবং রাজস্থানের ২৫ আসন বেড়ে ৪৪ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে লোকসভায় দক্ষিণী রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বের পরিমাণ ২৩.৭ শতাংশ। সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর সেটা ১৯ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব লোকসভায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
দেশের সর্বাধিক কর প্রদানকারী রাজ্যগুলির তালিকায় নাম রয়েছে তামিলনাড়ু, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের। কিন্তু বিনিময়ে নিজেদের অবদানের মাত্র ৩০ শতাংশ টাকা কেন্দ্রের থেকে পায় এই তিন রাজ্য। সেখানে উত্তরপ্রদেশ বা বিহারকে তাদের অবদানের ২৫০ থেকে ৩৫০ শতাংশ দিয়ে থাকে কেন্দ্র। সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর আসন কমলে এই অবদান আরও হ্রাস পাবে বলে যুক্তি দিয়েছে স্ট্যালিন সরকার।
সম্প্রতি নাগাপট্টিনামের একটি জনসভায় স্ট্যালিন বলেন, ‘‘বেশি জনসংখ্যার রাজ্যগুলিই সীমানা পুনর্নির্ধারণের ফলে সুবিধা পাবে।’’ কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি, নিয়ম মেনেই আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। কম জনসংখ্যার জন্য কোনও সমস্যায় পড়বে না তামিলনাড়ু।