দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘনাচ্ছে যুদ্ধের কালো মেঘ! ‘পান্না ত্রিভুজ’কে কেন্দ্র করে মুখোমুখি সংঘাতে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ব্যাঙ্ককের রাজনীতিতে আসতে পারে বড় বদল। কুর্সি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর। শুধু তা-ই নয়, এই সংঘর্ষের আঁচ ভারতের গায়ে লাগাও আশ্চর্যের নয়, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের মে মাসে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমান্তে গুলি বিনিময় হলে হঠাৎ করেই খবরের শিরোনামে চলে আসে ‘পান্না ত্রিভুজ’। পাহাড় এবং ঘন জঙ্গলে ঘেরা এলাকাটি তিনটি দেশের অন্তর্ভুক্ত। তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার পাশাপাশি সেই তালিকায় নাম আছে লাওসের। এ-হেন বিতর্কিত ‘পান্না ত্রিভুজ’-এর উপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা রয়েছে যুযুধান দুই দেশের।
ব্যাঙ্কক ও নম পেনের মধ্যে এই সীমান্ত সংঘাতের সূত্রপাত কিন্তু আজকের নয়। ১১৮ বছর আগে এর বীজ পোঁতেন ফরাসি ঔপনিবেশিকেরা। ওই সময় কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতা দখলে রেখেছিল পশ্চিম ইউরোপের ওই দেশ। অন্য দিকে তাইল্যান্ড ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯০৭ সালে সীমান্ত নির্ধারণ করতে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন নম পেনের ফরাসি শাসকেরা। তাতে ‘পান্না ত্রিভুজ’ এলাকার প্রায় পুরোটাই কম্বোডিয়ার অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৯৫৩ সালের ৯ নভেম্বর ফরাসিদের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে কম্বোডিয়া। এর কিছু দিনের মধ্যেই ‘পান্না ত্রিভুজ’কে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী তাইল্যান্ডের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে নম পেন। কারণ, ফরাসি শাসকদের তৈরি করা মানচিত্র দেখিয়ে কম্বোডিয়া গোটা এলাকার উপর নিরঙ্কুশ দখলদারি চেয়েছিল। কিন্তু, ব্যাঙ্কক ওই মানচিত্র মানতে রাজি না হওয়ায় দু’পক্ষের মধ্যে চড়তে থাকে উত্তেজনার পারদ।
এই সংঘাত পর্বের প্রথম দিকে আলোচনার মাধ্যমে গোটা বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দু’পক্ষ। কিন্তু, তাতে সমাধানসূত্র বার না হওয়ায় ‘পান্না ত্রিভুজ’-এর ভাগ্য নির্ধারণের ভার পড়ে আন্তর্জাতিক আদালত বা আইসিজে-র উপর (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস)। ১৯৬২ সালে বিতর্কিত এলাকাটি নিয়ে একটি রায় দেয় ওই আদালত। তাতে কম্বোডিয়া লাভবান হলেও কোনও বিরোধিতা করেনি তাইল্যান্ড।
’৬২ সালের রায়ে ‘পান্না ত্রিভুজ’-এর অন্তর্গত মম বেই ওরফে চং বোক এলাকাটিকে কম্বোডিয়ার বলে জানিয়ে দেন আন্তর্জাতিক আদালত। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটিতে রয়েছে তিনটি প্রাচীন মন্দির। এর মধ্যে অন্যতম হল প্রিয়াহ ভিহিয়ার দেবালয়। সেটিরও নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নম পেনের হাতে। যদিও মন্দির এলাকার আশপাশের জমি কার দখলে থাকবে, তা অবশ্য স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র হতে থাকে সংঘাত।
চলতি বছরের ২৮ মে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপের দিকে মোড় নয়। ওই দিন মম বেই বা চং বোক এলাকায় মোতায়েন থাকা কম্বোডিয়ার সৈনিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় তাইল্যান্ডের বাহিনী। এতে তাঁদের কয়েক জনের মৃত্যু হলে আশপাশের গ্রামগুলিতে যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে গুলিবর্ষণের সাফাই দিতে গিয়ে ব্যাঙ্কক জানায়, ‘পান্না ত্রিভুজ’-এর বিতর্কিত এলাকায় বেআইনি ভাবে পরিখা খনন করছিল কম্বোডিয়ার বাহিনী।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ ব্যাপারে পাল্টা বিবৃতি দেয় নম পেন। তাদের দাবি, সীমান্তে সেনাচৌকি রক্ষার জন্য ওই পরিখা খননের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করা হয়নি। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো এর মধ্যে আবার কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান সেনেটের সভাপতি হুন সেনের সঙ্গে তাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংটার্ন সিনাওয়াত্রার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়। তাতে আরও ঘোরালো হয়েছে পরিস্থিতি।
সূত্রের খবর, পেতংটার্নের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপ কম্বোডিয়ার অন্তত ৮০ জন রাজনৈতিক নেতার কাছে পাঠিয়ে দেন হুন সেন। সেখানে তাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁকে ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করতে শোনা গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দুই দেশের সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, ২৮ মে-র ঘটনার জন্য তাই সেনাবাহিনীর কড়া সমালোচনাও শোনা গিয়েছে পেতংটার্নের গলায়।
এ-হেন কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই ব্যাঙ্ককের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে প্রবল অস্থিরতা। পেতংটার্নের দল পিউ তাইয়ের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভূমজ়াইথাই পার্টির সঙ্গে জোটে সরকার চালাচ্ছিলেন তিনি। ওই ঘটনার পর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে তারা। ফলে যে কোনও মুহূর্তে কুর্সি হারাতে পারেন তাইল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।
সরকার বাঁচানোর জন্য পেতংটার্ন অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কথোপকথনের ফাঁস হওয়া অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান তিনি। বলেন, ‘‘আমি শুধুমাত্র সীমান্ত সংঘাত মেটাতে চেয়েছি। তাইল্যান্ডবাসীর ভাবাবেগে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে আমার কৃতকর্মের জন্য আমজনতার অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।’’ যদিও এতে শেষ পর্যন্ত তিনি সরকারের পতন ঠেকাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।
পেতংটার্ন সরে গেলে তাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি পেতে পারেন স্রেথা থাভিসিন। ধনকুবের এই শিল্পপতি এর আগে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন। তবে তাই সেনাবাহিনীর উপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ যে খুব বেশি রয়েছে এমনটা নয়। আশঙ্কার জায়গাটি হল, ব্যাঙ্ককের সশস্ত্র বাহিনীর স্বাধীন ভাবে কাজ করার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। এর জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করা বা সরকার ভেঙে দেওয়ার মতো ‘বদনাম’ সেঁটে আছে তাই ফৌজের গায়ে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন কূটনৈতিক ভাবে আলোচনার মাধ্যমে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। গত ১২ জুন সেই রাস্তায় হেঁটে সৈন্য পর্যায়ে বৈঠক করে যুযুধান দুই দেশ। সেখানে সীমান্তের পরিখা বুজিয়ে ফেলার ব্যাপারে সম্মত হয় কম্বোডিয়ার বাহিনী। পাশাপাশি সীমান্তের চারটি বিতর্কিত পয়েন্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে নতুন মামলা দায়ের করেছে নম পেন।
কিন্তু, ওই এলাকাগুলি নিয়ে আইসিজের নির্দেশ তাইল্যান্ড মেনে নেবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতিও দেয়নি ব্যাঙ্কক। উল্টে সীমান্ত বন্ধ করে কম্বোডিয়ার নাগরিকদের উপর কঠোর পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে সেখানকার সরকার। পাল্টা নিষেধাজ্ঞার রাস্তায় হেঁটে সংঘাতের আগুনে ঘি ঢেলেছে নম পেনও।
তাইল্যান্ড সীমান্ত বন্ধ করতেই ব্যাঙ্ককের ফল ও সব্জি আমদানিতে দাঁড়ি টেনেছে কম্বোডিয়ার সরকার। বন্ধ করা হয়েছে তাইল্যান্ডের টিভি শো এবং চলচ্চিত্র। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশটির বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারও কমিয়েছে নম পেন। পাশাপাশি, সমস্ত নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অন্তত দু’বছরের জন্য সেনাবাহিনীকে কাজ করার নিয়ম চালু করতে চলেছে কম্বোডিয়ার সরকার।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা অবশ্য সাম্প্রতিক সংঘাতের জন্য কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে পুরোপুরি দায়ী করেছেন। তাঁদের দাবি, ইচ্ছাকৃত ভাবে পেতংটার্নের সঙ্গে কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপ ফাঁস করে দেন তিনি। তাঁর অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে ১৭ মিনিটের ওই অডিয়োটি পোস্ট করা হয়েছিল। যদিও ওই ঘটনাকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন হুন সেন।
তাইল্যান্ডের বিদেশ মন্ত্রক অডিয়ো ক্লিপ ফাঁসের ঘটনাকে ‘গভীর হতাশাজনক’ বলে উল্লেখ করেছে। ব্যাঙ্ককের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘সৎ এবং সরল বিশ্বাসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেখানে আমরা বড় আঘাত পেয়েছি। কম্বোডিয়া হয়তো সোজা রাস্তায় সমাধান চাইছে না। এ বার তাই বাধ্য হয়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে।’’
তাইল্যান্ডের ওই মন্তব্যের পর প্রমাদ গুনেছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেজ়। সম্পর্কে তিনি আবার হুন সেনের পুত্র। সম্প্রতি রাজধানী নম পেনে একটি বিশাল জনসভা করেন তিনি। সেখানে মানেজ় বলেছেন, ‘‘দেশ যখন হুমকির সামনে দাঁড়াবে, তখন ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’
ঘন জঙ্গলে ভরা ‘পান্না ত্রিভুজ’ এলাকাটিতে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অঞ্চলটি বিতর্কিত হওয়ায় দীর্ঘ দিন সেখানে হাত প়ড়েনি কারও। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ওই এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির ভাগ্য বদলে দিতে পারে। রাতারাতি সেখানকার অর্থনীতিতে আসতে পারে বড় বদল। আর তাই বার বার সীমান্ত সংঘাতে জড়াচ্ছে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া।
ভারতের সঙ্গে আসিয়ান-ভুক্ত (অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স) যুযুধান দুই দেশের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। ফলে সংঘাতে কোনও একটা পক্ষ নেওয়া নয়াদিল্লির পক্ষে বেশ কঠিন। অন্য দিকে পরিস্থিতি খারাপ হলে সেখানে নাক গলাতে পারে চিন। সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় বাড়বে বেজিঙের প্রভাব। আর তাই এ ব্যাপারে মেপে পা ফেলতে হবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।