Calcutta Stock Exchange closure

‘রাহু’ হয়ে আসেন কেতন পারেখ, লেনদেন বন্ধ এক যুগেরও বেশি, বন্ধ হয়ে যাবে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ?

কলকাতার অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কি না এই নিয়ে চর্চার শেষ নেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কী ভাবে হল সিএসই-র?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:৪১
Share:
০১ ২৫

একটি বড় হলঘর। চারিদিকে শুধুই কোলাহল। আর সেখানে একাধিক সংস্থার শেয়ার কেনাবেচা চলছে। কেউ দাম বলছেন, কেউ বিক্রি করছেন, আবার কেউ কিনছেন। ছবিটা বছর কয়েক আগের।

০২ ২৫

আসলে ওই হলঘরই ছিল একসময়ের শেয়ার বাজার। এখন শেয়ার বাজারে লেনদেন হয় কম্পিউটার বা মোবাইলের নানা অ্যাপের মাধ্যমে। কিন্তু আগে তা ছিল না। শুরুর দিকে ছোট-বড় সব সংস্থাকেই একটি জায়গায় একত্রিত হয়ে স্টক কেনাবেচা করতে হত।

Advertisement
০৩ ২৫

ভারতের অন্যতম শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যম, কলকাতা স্টক এক্সেচেঞ্জের (সিএসই) কাজও শুরু হয়েছিল ঠিক এমন ভাবেই। ১৯০৮ সাল, কলকাতায় তৈরি হয় ‘দি ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’ বা সিএসই।

০৪ ২৫

সেই সময় কয়েক জন ব্রোকার মিলিত ভাবে এই সংস্থাটি তৈরি করেন। তবে এখানে একটি বিষয় রয়েছে। ১৯০৮ সাল, অর্থাৎ দেশ তখনও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে কলকাতার স্টক বাজার তৈরি হলেও শোনা যায় ব্রিটিশ আধিপত্য কখনওই সিএসই-র কাজে সে ভাবে হস্তক্ষেপ করত না।

০৫ ২৫

কিছু তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ শুরু হয় ১৯০৮ সালেরও অনেক আগে। একটি নিমগাছের তলায় বসে কয়েক জন ব্রোকার মিলে নাকি স্বাধীন ভাবে শেয়ার কেনাবেচার কাজ করতেন।

০৬ ২৫

পরে ১৯০৮ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫৭ জন সদস্যকে নিয়ে ২, চায়না বাজার স্ট্রিটে (বর্তমানে এই জায়গার নাম রয়্যাল এক্সচেঞ্জ) কাজ শুরু হয় সিএসই-র।

০৭ ২৫

শুরুর দিকে কোনও সরকারি স্বীকৃতি পায়নি সিএসই। পরে ১৯২৩ সালে আইনি স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৫৬ সালের সিকিউরিটিজ় কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী এটি স্টক এক্সচেঞ্জ সংস্থা হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বীকৃতি পায়।

০৮ ২৫

বেসরকারি হলেও এই সংস্থা ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অংশ। পাশাপাশি এটি সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সিএসই-কে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেবির অনুমোদন অবশ্যই নিতে হয়।

০৯ ২৫

একসময় শেয়ার বাজারে দাপিয়ে রাজত্ব করেছে সিএসই। লেনদেনের মাপকাঠিতে তা ছাপিয়ে গিয়েছিল ‘বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ’ (বিএসই)-কেও। ভারতের বহু ছোট-বড় সংস্থা বিনিয়োগ করত সিএসই-র মাধ্যমেই। কিন্তু এখন সেই সংস্থাতেই বিগত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কোনও বিনিয়োগ, লেনদেন কিছুই হচ্ছে না।

১০ ২৫

কিন্তু কেন? সিএসই-র বর্তমান অবস্থা জানতে গেলে নজর দিতে হবে অতীতে। একসময় ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র ছিল পশ্চিমবঙ্গ। চা, কয়লা এবং পাটের তখন রাজ্য জুড়ে রমরমা ব্যবসা। এই তিনটি সামগ্রী বিক্রির সংস্থারাও নিজেদের বাজারদর বৃদ্ধি করতে সিএসই মারফত শেয়ার কেনাবেচা করেছে পাল্লা দিয়ে।

১১ ২৫

একসময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। সে কারণে বেশ কিছু বড় বড় সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল এখানে। সে ক্ষেত্রে ওই সংস্থাগুলিও মুম্বইয়ের চেয়ে সিএসই-কেই বেছে নিয়েছিল বিনিয়োগকারী মাধ্যম হিসাবে।

১২ ২৫

১৯৯৭ সালে ‘ওপেন আউটক্রাই সিস্টেম’-এর বদল এনে শুরু হয় সি-স্টার বা সিএসই স্ক্রিন বেসড ট্রেডিং অ্যান্ড রিপোর্টিং পদ্ধতিতে শেয়ার কেনাবেচার কাজ। অর্থাৎ, আগে ব্রোকারেরা সশরীরে উপস্থিত থেকে শেয়ার কেনাবেচা করতেন। পরে কম্পিউটারের মাধ্যমে নথিভুক্ত করে শেয়ার কেনাবেচা চালু হয়।

১৩ ২৫

সেই সময় থেকেই কোন কোন সংস্থা সিএসই-র অধীনে রয়েছে, কী কী শেয়ার কেনা হচ্ছে সেই সমস্ত তথ্য কম্পিউটারে নথিভুক্ত করে রাখা শুরু হয়। সেগুলিতে সেবি-ও নজরদারি চালাতে পারত। যদিও নতুন পদ্ধতিতে প্রাথমিক ভাবে সিএসই-র যে খুব করুণ অবস্থা হয়েছিল তা কিন্তু নয়।

১৪ ২৫

তথ্য বলছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের শুরু পর্যন্ত, বেশির ভাগ সময়ই সিএসই-র দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বিএসই-কে ছাড়িয়ে যেত। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিএসই-তে চার হাজারের বেশি সংস্থার নাম তালিকাভুক্ত ছিল।

১৫ ২৫

কিন্তু ওই ২০০০ সালেই এক ব্রোকারের জালিয়াতি প্রায় শেষ করে দেয় সিএসই-কে। শেয়ার বাজারের বড় খেলোয়াড় মনে করা হত ব্রোকার কেতন পারেখকে। কেতন দেখতে একেবারে সাদাসিধে ছিলেন। কোনও বিলাসবহুল জীবনযাপনও ছিল না তাঁর। সেই মানুষটিই যে ১২০ কোটি টাকার জালিয়াতি করতে পারেন তা সকলের কল্পনার বাইরে ছিল।

১৬ ২৫

কেতন শেয়ার বাজারের কাজ শিখেছিলেন হর্ষদ মেহতার থেকে। হর্ষদ নিজেও শেয়ার বাজার জালিয়াতির এক অন্যতম অপরাধী। অল্প দিনের মধ্যে কী ভাবে বেশি টাকা উপার্জন করা যায় সে নেশা চেপে বসেছিল হর্ষদের মাথায়। ওই একই নেশা চাপে কেতনেরও।

১৭ ২৫

কেতন খুব ছোট এবং মাঝারি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে নিশানা করতেন। তাঁর এই নিশানা শেয়ার বাজারে ‘কে ১০’ নামে পরিচিত। মূলত প্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং বিনোদন (‘আইস’: ইনফরমেশন, কমিউনিকেশন, এন্টারটেনমেন্ট) দুনিয়ার সংস্থাই থাকত কেতনের তালিকায়। তাঁদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে শেয়ার কিনে নিতেন।

১৮ ২৫

কিন্তু, একজন ব্রোকার হয়ে এত টাকা কেতন পেতেন কোথা থেকে? ঋণের জন্য কিছু ছোট ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কেতন। মাধবপুর মার্চেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মতো কিছু ছোট ব্যাঙ্ক তাঁর কথা মেনে বিপুল পরিমাণে টাকা ঋণ দেয়। কেতন পে অর্ডার দিয়ে (তথ্য অনুযায়ী, ভুয়ো পে অর্ডার তৈরি করতেন) ঋণ নিতেন। এ ছাড়াও বেশি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কয়েক জন প্রোমোটারের থেকেও ঋণ নিয়েছিলেন।

১৯ ২৫

শেয়ার কেনাবেচার জন্য কেতন বেছে নিয়েছিলেন সিএসই-কে। যদিও বেশি দিন তিনি বেআইনি ভাবে এই কাজ করতে পারেননি। প্রচুর টাকার বিনিময়ে আইস-স্টকের শেয়ার কেনার ফলে একটা সময়ের পর বাজারে ওই স্টকগুলির চাহিদা কমে যায়। যে চড়া দামে স্টক কিনতে হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম টাকায় সেগুলি বিক্রি করে দিতে হয়। কেতন অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। ঋণও শোধ করতে পারেননি। এমন অবস্থা নজরে আসে শেয়ার প্রশাসনের। জানা যায়, কে ১০ এবং পে অর্ডার পদ্ধতির মাধ্যমে শেয়ার বাজারে বিশাল টাকার জালিয়াতি করেছেন কেতন।

২০ ২৫

এর পরই সেবি-র তরফে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সিএসই-র উপর। ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলিও সিএসই-র উপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে। যদিও কেতনের ঘটনার পরেও সাময়িক সমস্যা কাটিয়ে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল সিএসই।

২১ ২৫

কিন্তু ২০১৩ সালে নিয়ম না মানার অভিযোগে সিএসই-তে লেনদেন স্থগিত করে দেয় সেবি। যে কারণে পাল্টা সিএসই-র তরফে সেবি-র বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করা হয়। যদিও তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সিএসই তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।

২২ ২৫

তবে শুধুমাত্র কেতনের কীর্তিকে সিএসই ভেঙে পড়ার প্রধান কারণ হিসাবে দেখছেন না অনেকে। সূত্রের খবর, সিএসই-র বরাবরই উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব ছিল। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বেশ নড়বড়ে অবস্থায় ছিল সিএসই। দীর্ঘ দিন ধরে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না সিএসই-র।

২৩ ২৫

এ ছাড়াও আরও একটি কারণকেও তুলে ধরা হয়েছে। একাধিক বড় সংস্থা তাঁদের মূল কার্যালয় কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে নিয়ে চলে যায়। ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রের তকমা হারিয়ে ফেলে। সংস্থাগুলি সিএসই থেকে নাম সরিয়ে বিএসই অথবা এনএসই-তে বিনিয়োগ করতে শুরু করে দেয়। এর ফলে সিএসই-ও ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

২৪ ২৫

সিএসই-র প্রাক্তন চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসার শমীক ভাদুড়ী বলেন, ‘‘সেবির না চাওয়া, ব্যবসার অভাব, আধুনিক প্রযুক্তিতে উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবের কারণেই সিএসই-র আজ ভঙ্গুর দশা।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, আগে বেশ কয়েক বার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে সিএসই, কিন্তু কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব থাকার কারণে প্রতি বার বাধার সম্মুখীন হলেও শেষ পর্যন্ত তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি আর।

২৫ ২৫

২০১৩ সাল থেকে একেবারে লেনদেন বন্ধ সিএসই-তে। কোনও সংস্থার নামও নেই আর সেখানে। তা হলে কি সত্যিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিএসই? আদৌ কি সেবির কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনও অনুমোদনপত্র জমা পড়েছে? সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত সেবি-র সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে সিএসই। সম্পূর্ণ ভাবে কলকাতার অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের ধারক সিএসই আদৌ বন্ধ হয়ে যাবে কি না সে নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠলেও, স্পষ্ট ভাবে কোনও উত্তর মেলেনি সিএসই কর্তৃপক্ষের তরফে। (ঋণস্বীকার অদিতি ঘটকের ‘ডাউন দ্য লায়ন্স রেঞ্জ’)

সব ছবি: অমিত দত্ত ও সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement