নাগেরবাজার মোড় থেকে রাষ্ট্রগুরু অ্যাভিনিউ ধরে কয়েক পা হাঁটলেই চোখে পড়বে একটি ওষুধের দোকান। তার পাশ থেকে ডান দিকে ঘুরে কিছুটা এগোলেই এক ভগ্নপ্রায় বাড়ি চোখে পড়বে। কথিত আছে, এই স্থানের নাম দমদম হয় এই বাড়িটি যে ঢিবিটির উপর অবস্থিত, তা থেকেই। আরবি শব্দ ‘দমদমাহ্’র অর্থ চাঁদমারির জন্য নির্মিত উঁচু মাটির ঢিবি। অনেকের মতে, দমদম নামকরণ হয়েছে পার্সি শব্দ ‘দমদমা’ থেকে, যার অর্থ উঁচু ঢিবি।
ঢিবিটির উপর অবস্থিত এই দুর্গসদৃশ বাড়িটিতেই এককালে বাস করতেন রবার্ট ক্লাইভ। তবে ক্লাইভ এ বাড়ির প্রথম বাসিন্দা নন। ঘন জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত সেই আমলের দমদমে এই বাড়িটি ছিল আলিবর্দি খাঁর ‘হান্টিং হাউস’। কারও কারও মতে, ইংরেজদের উপর গোপনে নজর রাখা হত এই বাড়িটি থেকেই। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে এই বাড়িটি পান তাঁর নাতি সিরাজউদ্দৌলা। তিনি যখন কলকাতায় আসেন তখন তাঁর সেনাছাউনি পড়ে উমিচাঁদের বাগানবাড়িতে। তখন খুব সম্ভবত এই বাড়িটিতেই ছিলেন সিরাজ। অনেক ঐতিহাসিক বইয়েও এ বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
শোনা যায়, একসময়ে এটি ওলন্দাজদের তুলোর গুদাম ছিল। দুর্গসদৃশ এই বাড়িটির দেওয়াল চওড়া, চার কোণে রয়েছে বিশালাকার মজবুত থাম। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সাংবাদিক এবং ইংরেজ চিত্রকর ডেসমন্ড ডয়েগের ‘ক্যালকাটা: অ্যান আর্টিস্ট’স ইমপ্রেশন’ বইয়ে এই বাড়িটির এমনই একটি স্কেচ পাওয়া যায়। এ থেকে মনে করা হয়, এটি ছিল ওলন্দাজদের দুর্গ। লবণহ্রদের দিক থেকে জলপথে আসা শত্রুপক্ষ যাতে বরানগরের বাণিজ্যকুঠিতে আক্রমণ করতে না পারে, সে কারণে এটি নির্মাণ করা হয়। বরানগরের বাণিজ্যকুঠিগুলির সঙ্গে গঠনগত সাদৃশ্যের কারণে ধারণা করা যায়, আলিবর্দি এ বাড়ির নির্মাতা নন, এই বাড়িটি তিনি ওলন্দাজদের থেকে কেনেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল কর্মব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে সবুজে ঘেরা নিরিবিলি এই বাড়িটিকে নির্বাচন করেন। কথিত আছে, নিরাপত্তার কারণেই এর চারপাশে কাটা হয়েছিল পরিখা। এ বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনও ঘটে ক্লাইভেরই হাতে। উঁচু ঢিবির উপরে অবস্থিত একতলা বাড়িটিকে দোতলা করেন ক্লাইভ। একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে এবং তার স্থাপত্য বদলে বসবাসযোগ্য করে নেন। ক্লাইভের এই কান্ট্রি হাউসটি ‘দমদম হাউস’ হিসাবেও পরিচিত ছিল। এই বাড়ির চত্বরে একটি নয়নাভিরাম গোলাপবাগানও গড়ে তোলেন ক্লাইভ, যা ‘সাহেববাগান বাগিচা’ নামে খ্যাত ছিল। ক্লাইভের পরবর্তী কালে বেঙ্গল আর্টিলারির সৈন্যেরা দমদমের মাঠে চাঁদমারি অভ্যাস করতে এলে ছাউনি ফেলে সেই মাঠেই রাত্রিযাপন করতেন। উচ্চপদস্থ অফিসারেরা থাকতেন দমদম হাউসে।
যে ব্রিটিশ নথিতে এই বাড়িটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া তা হল রবার্ট ওরমে রচিত ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার ইন বেঙ্গল’ নামক একটি বই। আরসি স্টার্নডেল প্রেসিডেন্সি ভলান্টিয়ার রিজ়ার্ভ বাহিনীর ১৮৯১ সালের বার্ষিক রিপোর্টেও ‘দমদমা হাউস’-এর কথা লিখেছেন। স্টার্নডেল ছিলেন সাবেক কলকাতার কালেক্টর, কলকাতা ও হাওড়ার এক্সাইজ়ের সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
অনুমান করা হয়, দমদম অঞ্চলের সমৃদ্ধির নেপথ্যেও এই বাড়িটির ভূমিকা রয়েছে। রবার্ট ক্লাইভ এই বাড়িতে বসবাস শুরু করার পরে শিক্ষিত ইংরেজ নরনারীর আনাগোনা হতে থাকে এই অঞ্চলে। এ ছাড়া ১৭৮৩ সালে গোরাবাজারে গড়ে ওঠা ক্যান্টনমেন্টটির কারণেও এই অঞ্চলটিতে জনসমাগম ঘটতে থাকে। বিশ শতকের গোড়ায় ‘বেঙ্গল গেজেটিয়ার’-এ এই বাড়িটিকে কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বাড়ি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮২৪ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতার দ্বিতীয় বিশপ হেবার এই বাড়িটিতে আসেন। সে সময় বেঙ্গল আর্টিলারির কমান্ডার ছিলেন কমান্ডান্ট জেনারেল টমাস হার্ডউইক। হেবার এই বাড়িটি সম্পর্কে বলেন যে, ‘‘অন্য কোনও জায়গা থেকে মাটি এনে পাশাপাশি এলাকার চেয়ে জমি অনেকটা উঁচু করে বাড়িটি বানানো হয়। এর একতলার অংশ এবং যে কাঠামোর উপর বাড়িটি তৈরি, সেগুলি দেখে এই প্রাচীনত্ব বোঝা যায়।’’ হার্ডউইক এই বাড়িটিতে একটি ছোট জাদুঘরও বানান। এ কথা জানা যায় হেবারেরই লেখা থেকে। বেশ কিছু প্রাণীর ‘স্টাফ্ড বডি’ এবং পেন্টিং সংরক্ষিত ছিল সেই জাদুঘরে।
বাড়ির বাইরের দিকের একটি স্থান দেখিয়ে স্থানীয়েরা দাবি করেন, সেখানে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। অনেকের দাবি, সেটি নাকি মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার বাস্তব ভিত্তি নেই বললেই চলে। অনেকে আবার বলেন, এই সুড়ঙ্গের সঙ্গে যোগ ছিল গঙ্গার, আবার অনেকে বলেন বাগজোলা খালের।
এই বাড়িটি যে ঢিবিটির উপরে অবস্থিত, সেটি সম্পর্কেও অদ্ভুত গুজব রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এই ধারণা প্রচলিত আছে যে ওটি মনুষ্যনির্মিত নয়। কোনও এক অশরীরী রাতারাতি এটি গড়ে তোলে। বিশপ হেবার তাঁর ‘ন্যারেটিভ অফ আ জার্নি থ্রু দ্য আপার প্রভিন্স অফ ইন্ডিয়া’ বইয়েও এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ এ কথাও বলে থাকেন, যে ঘাসে ঢাকা উঁচু জায়গার উপর বাড়ি এবং খেলার মাঠটি অবস্থিত তার নীচে গোটা এলাকা জুড়ে বহু কক্ষ রয়েছে। কারও মতে, উঁচু মাঠটিকে খুঁড়লে বার হবে ক্লাইভের সঞ্চিত ধনরত্ন, কেউ আবার বলেন যে এর নীচে রয়েছে অস্ত্রাগার। তবে অধিকাংশেরই অভিমত, ভূতের গল্পের মতোই এ সব জনশ্রুতি অলীক এবং হাস্যকর।
এইচআইএস কানোয়ার তাঁর ‘মেমরিজ় অফ দমদম’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন যে ঝোপজঙ্গলে ঘেরা, জনবসতিশূন্য এই স্থান একসময় ছিল দস্যু-তস্করদের আড্ডাস্থল। শোনা যায়, শোনা যায়, এই এলাকার সংলগ্ন নোনা জলের হ্রদ দিয়ে ছোট দাঁড়টানা নৌকোয় ডাকাতেরা যাতায়াত করত এবং আশপাশের গ্রাম, ধীরগতির মালবাহী বড় নৌকো এবং বাণিজ্য জাহাজগুলিতে লুটপাট চালাত।
অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী কালে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বন্দি রাখার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা গড়ে তোলেন দমদম সেন্ট্রাল জেল। সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এই বাড়িটিতে কিছু রাজবন্দিকে স্থানান্তরিত করা হয়। সে সময় এর চারপাশে ভুট্টার খেত ছিল। রাজবন্দিদের স্থানান্তরিত করার পরে এই বাড়িটি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।
দমদমের এই বাড়িতেই ‘আলিনগরের চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন। ‘বেঙ্গল গেজেটিয়ার’-এ রয়েছে, ‘‘১৭৫৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দমদমে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইংরেজরা আগে যে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, এই চুক্তির মাধ্যমে নবাব সেই সব অনুমোদন করেন, কলকাতায় দুর্গ তৈরির অনুমতি দেন এবং বাণিজ্যের স্বাধীনতা ও টাকশাল প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা দেন।’’
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ইংরেজদের কাছে বাংলার তৎকালীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের ফলে ভারতে ইংরেজদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপিত হয়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সিরাজের পতনের সূচনা ‘আলিনগরের চুক্তি’ থেকেই। সে দিক থেকে বলা যায়, এই বাড়িতেই সেই ঘটনার সূত্রপাত। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পরে ক্লাইভকে এই বাড়িতেই আপ্যায়ন জানান মিরজ়াফর, আয়োজন ছিল পানাহার এবং নাচগানের।
১৯৬০-এর দশকে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সাংবাদিক এবং ইংরেজ চিত্রকর ডেসমন্ড ডয়েগ যখন এই বাড়িটি পরিদর্শনে যান তখন এর জরাজীর্ণ দশা। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা (অধুনা বাংলাদেশ) বেশ কিছু পরিবার বাড়িটিতে আশ্রয় নেয়। পঞ্চাশের দশকে এই বাড়িটিতেই ভারতের প্রথম এয়ার টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়।
১৯৫০ সাল থেকে এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন শ্যামাপদ ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি। তাঁর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, দু’দিকে দু’টি বারান্দা ছাড়াও এই বাড়িটিতে ছিল এক ডজন ঘর। দোতলার বারান্দার পরে এখনও রয়েছে একটি কাঠের পাটাতন-যুক্ত হলঘর, যা নাকি নাচঘর হিসাবে ব্যবহৃত হত। সামনেই রয়েছে স্তম্ভযুক্ত গাড়িবারান্দা, বিশাল চওড়া সিঁড়ি, যা দিয়ে দোতলায় ওঠা যায়।
২০০৪ সালের ২৫ মার্চ ‘ক্লাইভের কান্ট্রি হাউস’ নামে পরিচিত এই বাড়িটিকে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সৌধ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। প্রাচ্য এবং জর্জিয়ান নকশার এক সুন্দর মিশ্রণ এই বাড়িটি। পুরাতত্ত্ব বিভাগ পরিত্যক্ত এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সে কাজ আজও এগোয়নি। অবহেলায় পড়ে রয়েছে সময়ের দলিল।