Simo Haiha

বরফের রাজ্যের ‘যমদূত’! গুলিতে চোয়াল ওড়ার আগে পাঁচ শতাধিক শত্রুকে নিকেশ করেন ‘উইন্টার সোলজার’

১৯৩৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন মাসের এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল ফিনল্যান্ড। সোভিয়েত সেনাবাহিনী পাঁচ লক্ষেরও বেশি সৈন্য নিয়ে ফিনল্যান্ডে প্রবেশ করে। সেই যুদ্ধে স্নাইপার নিয়ে শত্রুকে নিকেশ করেছিলেন ফিনিশীয় বন্দুকবাজ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ১১:৫৮
Share:
০১ ২০

বরফের আড়াল থেকে ছুটে আসছে গুলি। প্রায় নির্ভুল নিশানায় সেই গুলি ফুঁড়ে দিচ্ছে শত্রুপক্ষকে। শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢাকা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের ঘায়েল করে শত্রুপক্ষের স্নাইপার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছেন। মেঘের আড়াল থেকে মেঘনাদ যেমন তাঁর শত্রুদের নাস্তানাবুদ করেছিলেন, তেমনই বরফের রাজ্যে আত্মগোপন করে একের পর এক রুশ সেনাকে ধরাশায়ী করে ফেলছেন কোনও ‘অতিমানব’।

০২ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করেছিল রাশিয়া। ১৯৩৯-৪০ সালে সাড়ে তিন মাস ধরে চলা সেই যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে ঘোল খাইয়ে দিয়েছিলেন এক বন্দুকবাজ। বরফের রাজ্যে তুষারচিতার মতো ক্ষিপ্রতায় শত্রুদের ঘায়েল করতেন তিনি। হাতিয়ার বলতে পুরনো রাশিয়ান রাইফেল। নিশানা করতে তাঁর কোনও দিন প্রয়োজন পড়েনি টেলিস্কোপেরও।

Advertisement
০৩ ২০

পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে তাঁকে বলা হয় ‘হোয়াইট ডেথ’। তিনি সিমো হ্যায়হ্যা। ‘উইন্টার ওয়ার’-এর মোড় একাই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি হয় না। মাত্র পাঁচ ফুট লম্বা, ছোটখাটো চেহারার এই মানুষটি যখন বন্দুক হাতে নিয়ে প্রস্তুত হতেন, মৃত্যু যেন পরোয়ানা নিয়ে হাজির হত। শত্রুদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন ফিনল্যান্ডের সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা এই সৈনিক। বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক স্নাইপারের তকমা দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

০৪ ২০

১৯৩৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েতের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন মাসের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল ফিনল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে জোসেফ স্ট্যালিন রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করেন। আক্রমণের সময় সোভিয়েত নেতার ধারণা ছিল, ফিনল্যান্ড একটি সহজ লক্ষ্য।

০৫ ২০

সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে যায় অচিরেই। সোভিয়েত বাহিনী সংখ্যায় বহু গুণ হলেও সিমোর দক্ষতায় ভর করে ফিনল্যান্ড সমানে টক্কর দিয়ে গিয়েছিল। পাঁচ লক্ষেরও বেশি সৈন্য নিয়ে ফিনল্যান্ডে প্রবেশ করে সোভিয়েত। সেখানে ফিনল্যান্ডের সৈন্যবল ছিল মাত্র ৩ লক্ষ। ছোট নর্ডিক দেশটির কাছে মাত্র কয়েকটি ট্যাঙ্ক এবং শ’খানেক বিমান ছিল। ভাবা হয়েছিল যে যুদ্ধটা একতরফা হবে।

০৬ ২০

অস্ত্রে ও যুদ্ধবিমানে বলীয়ান সোভিয়েত দেশের কাছে যা ছিল না তা হল সিমোর মতো তুখোড় বন্দুকবাজ। নজরে না পড়ার মতো চেহারা, নম্র স্বভাবের সিমোকে দেখে কারও বোঝার উপায় ছিল না যে বন্দুক হাতে ধরলে কতটা ভয়ঙ্কর ও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে সে কাহিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তো বটেই, যুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর স্নাইপার ছিলেন সিমো।

০৭ ২০

১৯০৫ সালে ফিনল্যান্ডের রাউতজারভির এক অখ্যাত গ্রাম কিসকিনেনে জন্ম সিমোর। জুহো এবং ক্যাটরিনা হ্যায়হ্যা ছিলেন সিমোর বাবা-মা। এই এলাকাটি ছিল পুরনো ফিনিশীয় অঞ্চল কারেলিয়ার অন্তর্গত। বর্তমানে এটি রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসাবে পরিচিত। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি কর্পোরাল পদে উন্নীত হন। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তাঁর নিশানার দক্ষতা নজর কেড়েছিল সামরিক কর্তাদের।

০৮ ২০

২০ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীর চাকরি শেষে তিনি তাঁর গ্রামে ফিরে আসেন ও চাষবাসেই মন দেন। সঙ্গে চলত স্কিয়িং, শিকার এবং শুটিংও। অবসর সময়ে তিনি বিভিন্ন শুটিংয়ের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতেন। তখনও তাঁর দক্ষতার পরিচয় পায়নি ফিনল্যান্ডের মানুষ।

০৯ ২০

১৯৩৯ সালে স্ট্যালিনের বাহিনী ফিনল্যান্ডের উপর আক্রমণ চালানোর পর ডাক পড়ে সিমোর। তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। তিনি লাডোগা হ্রদের উত্তরে কোল্লা অঞ্চলে পদাতিক রেজিমেন্টে যোগদান করেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময় তিনি ১৯২৮ সাল থেকে তৈরি হওয়া এম ২৮/৩০ নামের স্নাইপার রাইফেল তুলে নিয়েছিলেন। অন্যান্য রাইফেলের তুলনায় এটি ছিল একটু খাটো এবং কিছুটা ভারী।

১০ ২০

উত্তর ফিনল্যান্ডের বরফের রাজ্যে হাড়কাঁপানো হিমাঙ্কের নীচে থাকা তাপমাত্রায় সোভিয়েত প্রতিপক্ষের অপেক্ষায় থাকতেন ‘মৃত্যুদূত’ সিমো। বিশ্বস্ত রাইফেল এবং সাদা সুটে সজ্জিত যুদ্ধবাজ একা একা কাজ করতেই ভালবাসতেন। তাঁর কাজ করার পদ্ধতিও ছিল ফিনিশীয় সেনাদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। প্রতিকূল আবহাওয়াকে নিজের অনুকূলে এনে নিঃশব্দে আঘাত হানতেন সোভিয়েত প্রতিপক্ষের উপর।

১১ ২০

এক দিনের রসদ এবং গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে নিঃশব্দে বনের মধ্যে ঢুকে পড়তেন তিনি। লাল ফৌজের অনুপ্রবেশকে রুখে দেওয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করতেন শিকারি বেড়ালের মতো। সহযোদ্ধারা যখন টেলিস্কোপিক লেন্স ব্যবহার করে তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতেন, তখন সিমো টেলিস্কোপ ছাড়াই লড়ে যেতেন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে।

১২ ২০

তাঁর নিজস্ব ধারণা ছিল, টেলিস্কোপে আলো পড়লে সেই আলোর প্রতিফলন দেখে তাঁকে শত্রুপক্ষ চিহ্নিত করে ফেলতে পারে। তাই তিনি পুরনো পদ্ধতির ‘আয়রন সাইটের’ উপর ভরসা করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত ভাবে আঘাত করতেন। সিমোর মারণাস্ত্রের সীমানায় আসামাত্রই যেন মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে যেত শত্রুপক্ষের সেনাদের।

১৩ ২০

তাঁর নিশানার মতো আত্মগোপন করার পদ্ধতিও ছিল স্বতন্ত্র। শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য কতগুলি প্রায় নির্ভুল উপায়ও তৈরি করেছিলেন এই স্নাইপার। ফিনল্যান্ডের সেনাদের মতো তিনিও আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরে বরফের সঙ্গে মিশে যেতেন। নিজেকে আরও লুকিয়ে রাখার জন্য তিনি তাঁর অবস্থানের চারপাশে তুষারের ঢিবিও তৈরি করে ফেলতেন।

১৪ ২০

হিমাঙ্কের নীচে ৪০ ডিগ্রিতেও শত্রুহননে অবিচল ছিলেন ফিনিশীয় এই যোদ্ধা। বরফের স্তূপগুলি তাঁর রাইফেলের প্যাডিং হিসাবেও কাজ করত। গুলি বেরোনোর ফলে যে ঝাঁকুনি হত তা বরফের স্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে যেত। যখন সিমো মাটিতে শুয়ে নিশানা করতেন, তখন তিনি তাঁর মুখের মধ্যে বরফ ঠেসে রাখতেন যাতে তাঁর বাষ্পীভূত নিঃশ্বাস অবস্থান প্রকাশ না করে ফেলে।

১৫ ২০

কেবলমাত্র তাঁর বন্দুকের নিজস্ব আয়রন সাইট দিয়ে ৯৮ দিনের মধ্যে কমপক্ষে ৫০৫ জন শত্রুকে ঘায়েল করেছিলেন। এর বাইরেও তাঁর ছিল সাবমেশিন গান বা আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। সেটি দিয়ে আরও কয়েকশো শত্রুকে ঘায়েল করার রেকর্ড রয়েছে সিমোর।

১৬ ২০

শত্রুনিকেশের পদ্ধতি ও আত্মগোপনের কায়দার কারণে ‘উইন্টার ওয়ার’-এর সময় প্রায় জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন সিমো। সোভিয়েত শত্রুরা তাঁর টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি বেশ কয়েক দিন। বরফের বুক চিরে তাঁর বুলেট শত্রুর দেহ ফুঁড়ে দিত বলে তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘হোয়াইট ডেথ’। সোভিয়েত সৈন্যদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

১৭ ২০

উইকিপিডিয়ায় উদ্ধৃত ফিনিশ সেনাবাহিনীর নথিতে প্রকাশিত হয়েছে সিমো হ্যায়হ্যা যোদ্ধা হিসাবে কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর। এই নথি অনুসারে, তিনি ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র ২২ দিনে ১৩৮টি হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯৪০ সালের ২৬ জানুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা ১৯৯-এ পৌঁছে যায়। ১৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ২১৯-এ পৌঁছে যায়। তার পরের ১৮ দিনে সিমো আরও ৪০ জন শত্রুসৈন্যকে হত্যা করেন।

১৮ ২০

লাল ফৌজ ফিনল্যান্ডের এই অপ্রতিরোধ্য সৈনিককে নির্মূল করতে তাঁর সম্ভাব্য অবস্থানগুলিতে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করেছিল। অবিশ্বাস্য ভাবে, সিমো আহত বা নিহত হননি। এক বার একটি কামানের গোলা তাঁর অবস্থানের কাছে এসে পড়ে। সেই গোলার আঘাতে তাঁর কোটের পিছনের অংশ ছিঁড়ে যায়। পিঠে সামান্য আঁচড় ফেলা ছাড়া অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান দুর্ধর্ষ এই যোদ্ধা।

১৯ ২০

১৯৪০ সালের ৬ মার্চ কোল্লা অঞ্চলের উলিসমারের বনে এক সোভিয়েত স্নাইপারের বুলেট ধেয়ে এসে তাঁর চোয়াল উড়িয়ে দেয়। গুরুতর আহত হলেও, কোনও ভাবে বেঁচে যান সিমো। সহযোদ্ধারা তাঁকে খুঁজে পেয়ে একটি ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। কোমায় চলে যান ‘হোয়াইট ডেথ’। তার পরও মৃত্যুর সঙ্গে সমানে লড়ে গিয়েছেন এই স্নাইপার। অদ্ভুত সমাপতন ঘটে ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ। সে দিনই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফিনল্যান্ড যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে। আর ঠিক সেই দিনই ১১ দিন পর জ্ঞান ফেরে সিমোর।

২০ ২০

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সিমো তাঁর খামারবাড়িতে ফিরে যান। ফিনল্যান্ডে তাঁর যুদ্ধের কৃতিত্বের জন্য সরকারি খেতাব দেওয়া হয় তাঁকে। চোয়ালে মোট ২৬টি অস্ত্রোপচারের পর তাঁর বাক্‌শক্তি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১ এপ্রিল ২০০২ সালে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান লাল ফৌজের ত্রাস এই স্নাইপার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement