‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের দুনিয়ায় পা রাখল তুরস্ক। আঙ্কারার এ-হেন শক্তি বৃদ্ধিতে দক্ষিণ ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় পড়ে গিয়েছে শোরগোল। শুধু তা-ই নয়, প্রমাদ গুনছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র গ্রিস। অত্যাধুনিক হাতিয়ার হাতে পাওয়ায় আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’টির দাপাদাপি বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ২২ জুলাই প্রথম বার একটি হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ্যে আনেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। হাতিয়ারটির নাম ‘টাইফুন ব্লক-৪’ রেখেছে আঙ্কারার বাহিনী। দেশের অন্যতম বড় শহর ইস্তানবুলে চলা ‘আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্প মেলা ২০২৫’-এ প্রদর্শিত ওই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে একাধিক রিপোর্ট।
তুরস্কের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘টার্কি টুডে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘টাইফুন ব্লক ৪’-এর দৈর্ঘ্য সাড়ে ছ’মিটার। বিস্ফোরকবোঝাই অবস্থায় এর ওজন ২,৩০০ কিলোগ্রাম। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। হাতিয়ারটির নকশা তৈরি করেছে আঙ্কারার জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘রকেটসান’। এর উৎপাদনের সঙ্গেও জড়িত আছে তারা।
দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। এ ব্যাপারে যাবতীয় দায়িত্ব ‘রকেটসান’-এর কাঁধে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। কয়েক বছর আগে ‘টাইফুন’ নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে আঙ্কারার ওই প্রতিরক্ষা সংস্থা। এত দিন পর্যন্ত সেটাই ছিল তুর্কি সেনার সবচেয়ে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
‘টার্কি টুডে’ জানিয়েছে, ‘টাইফুন’-এর উন্নত সংস্করণ হল এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যাকে প্রকাশ্যে আনার পর বিবৃতি দিয়েছে ‘রকেটসান’। সেখানে বলা হয়েছে, বহুমুখী ওয়ারহেড ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে এই হাতিয়ারের। শত্রুপক্ষের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স), কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, সামরিক বিমান রাখার হ্যাঙ্গারের মতো উচ্চমূল্যের কৌশলগত ফৌজি পরিকাঠামো ধ্বংসের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরি করা হয়েছে।
হাইপারসনিক কথাটির অর্থ হল শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতি সম্পন্ন। এই গোত্রের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ঘণ্টায় ৬,১০০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে সক্ষম। ফলে হামলার সময় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। একে ঠেকাতে ব্যর্থ হতে পারে বিশ্বের যে কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’।
চলতি বছরের জুনে ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে চলা যুদ্ধে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। সাবেক পারস্য দেশের ছোড়া ওই মারণাস্ত্রগুলিকে ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় ইহুদিদের অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা। ফলে তেল আভিভ-সহ ইজ়রায়েলের একাধিক শহরের ভিত পর্যন্ত নড়ে গিয়েছিল তেহরানের ‘হাইপারসনিক’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে। চোখের নিমেষে ইহুদিভূমির একাধিক অট্টালিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’।
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থার তৈরি ‘টাইফুন ব্লক ৪’-এর গতিবেগ অবশ্য প্রকাশ্যে আনেনি তুরস্ক। তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, আট ম্যাক (শব্দের গতিবেগের প্রায় আট গুণ) বেগে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারবে আঙ্কারার হাতিয়ার। তুর্কির এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ঘুম উড়িয়েছে প্রতিবেশী গ্রিকদের। আথেন্সের আশঙ্কা, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ফেলায় এ বার ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসকে পুরোপুরি কব্জা করার চেষ্টা করবেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান।
১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই আচমকাই সাইপ্রাস আক্রমণ করে সেখানকার এক তৃতীয়াংশ জমি দখল করে তুর্কি সেনা। ওই সময়ে দ্বীপরাষ্ট্রের জনসংখ্যার বড় অংশ ছিলেন গ্রিক। এর জেরে সেখানকার রাজনীতিতে বৃদ্ধি পায় আথেন্সের প্রভাব। গ্রিসের তৎকালীন জান্তা সরকার সাইপ্রাসকে নিজেদের অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছিল। কিন্তু সেই আশায় পুরোপুরি জল ঢেলে দেয় আঙ্কারা।
তুরস্কের সাইপ্রাস অভিযান বন্ধ করতে ওই সময়ে তৎপর হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হয়নি। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও দখল করা এলাকা থেকে বাহিনী প্রত্যাহারে অস্বীকার করে আঙ্কারা। উল্টে দখলীকৃত এলাকাটির নাম বদলে ‘টার্কিশ রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাস’ বা টিআরএনসি করে দেয় তুরস্ক সরকার। গত ৫১ বছর ধরে সেখানকার শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করছে তুরস্ক।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে দুনিয়ার সামনে আনার আগে হঠাৎ করেই ‘টু স্টেট সলিউশন’-এর কথা বলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। সাইপ্রাসের দখল করা এলাকাকে নিকোসিয়া ও আথেন্স মান্যতা দিক, চাইছেন তিনি। তাঁর এই চক্রান্ত ধরে ফেলতে দু’টি দেশেরই সমস্যা হয়নি। আর তাই এক তরফা ভাবে আঙ্কারা কোনও সিদ্ধান্ত নিলে চুপ করে বসে থাকবে না বলে হুমকি দিয়েছে আথেন্স।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে গ্রিক ও সাইপ্রাসের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে জড়ালে ধারে ও ভারে কিছুটা এগিয়ে থাকবে তুর্কি সেনাবাহিনী। কারণ, লড়াইয়ে ‘টাইফুন ব্লক ৪’-কে ব্যবহার করতে পারবে। আথেন্স ফৌজি জেনারেলরা অবশ্য সেটা যে একেবারে আঁচ করতে পারেননি, তা নয়। আর তাই গ্রিস ও ভারতের মধ্যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বড় অঙ্কের কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে বলে জল্পনা তীব্র হয়েছে।
তুরস্কের শক্তি বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত আর্মেনিয়াও। মধ্য এশিয়ার দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশী আজ়ারবাইজানের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। ২০২০ সালে বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখ এলাকার দখলকে কেন্দ্র করে বাকুর সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ইয়েরেভেন। ওই লড়াইয়ে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় আর্মেনীয় সেনাবাহিনীকে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আঙ্কারার দেওয়া হাতিয়ার ব্যবহার করে খেলা ঘুরিয়েছিল বাকু।
তুরস্কের হাতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র চলে আসার ঘটনায় রক্তচাপ বেড়েছে ভারতেরও। কাশ্মীর ইস্যুতে বরাবর পাকিস্তানের পাশে থাকা আঙ্কারার সঙ্গে বর্তমানে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে ইসলামাবাদের। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন তুর্কি সংস্থার তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে এ দেশের একাধিক সামরিক ছাউনিকে নিশানা করার চেষ্টা করেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে কাজে লাগিয়ে সেগুলিকে অবশ্য মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লির ফৌজ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে পাক সেনার হাত শক্ত করতে পারেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। তখন ইসলামাবাদের আক্রমণ ঠেকানো নয়াদিল্লির পক্ষে বেশ কঠিন হবে। তবে প্রত্যাঘাত শানানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে না ভারত। কারণ, এ দেশের বাহিনীর কাছেও রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি।
গত ২২ জুলাই ভারতের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম ‘দ্য মিরর ইউএস’। সেখানে বলা হয়েছে, হাইপারসনিক এবং পারমাণবিক হাতিয়ার বহনে সক্ষম উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় ঢিলে দিচ্ছেন না নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এতে এশিয়ায় ‘শক্তির ভরকেন্দ্র’ বদলাতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে চিনকে টক্কর দেওয়ার জায়গায় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার পৌঁছে গিয়েছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘দ্য মিরর ইউএস’ জানিয়েছে, সম্প্রতি একসঙ্গে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। এর মধ্যে আধুনিকতমটির নাম ‘এক্সটেন্ডেড ট্র্যাজেক্টরি লং ডিউরেশন হাইপারসনিক ক্রুজ় মিসাইল’ বা ইটি-এলডিএইচসিএম। শব্দের আট গুণ বেগে (পড়ুন আট ম্যাক) ছুটে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি নিখুঁত নিশানায় শত্রুর উপর হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানা গিয়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বর্ধিত ট্র্যাজেক্টরি দীর্ঘস্থায়ী হাইপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র’টির পাল্লা ১,৫০০ কিলোমিটার। এর গতিবেগ ঘণ্টায় সাড়ে ন’হাজার কিমির বেশি। ‘প্রকল্প বিষ্ণু’র আওতায় একে তৈরি করেছে ডিআরডিও। আগামী দিনে ইটি-এলডিএইচসিএমের পাল্লা এবং গতিবেগ আরও বাড়তে চলেছে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে মিলেছে খবর।
হাইপারসনিক যুগে পা রাখতে গত বছর স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের সফল পরীক্ষা করে ডিআরডিও। দু’হাজার ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রায় ওই ইঞ্জিন বেশ ভাল ভাবে কাজ করেছিল। এর পরেই ‘গেম চেঞ্জার’ ইটি-এলডিএইচসিএম তৈরিতে মন দেন এ দেশের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি দু’হাজার কেজি পর্যন্ত প্রচলিত এবং পরমাণু বিস্ফোরক (পড়ুন ওয়ারহেড) বহন করতে পারবে বলে জানা গিয়েছে।
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে চলা যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়াদিল্লি। শব্দের প্রায় তিন গুণ গতিতে ছুটতে পারে এই মারণাস্ত্র। একে হাইপারসনিক শ্রেণিতে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সে ক্ষেত্রে শব্দের আট গুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারবে ‘ব্রহ্মস’। এর পাল্লা বেড়ে দাঁড়াবে দেড় হাজার কিলোমিটার। এ ছাড়া অগ্নি এবং পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকেও হাইপারসনিক শ্রেণিতে বদলে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের।