বিশ্বের মুখ্য তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেকে (অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়) ভাঙন? লাভের অঙ্ক হ্রাস পাওয়ায় সেখান থেকে নাকি বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকটি ওপেক ছাড়লে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির অস্তিত্ব টিকবে কি না তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। পাশাপাশি, এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘তরল সোনা’র দাম যে অস্থির হবে, তা বলাই বাহুল্য।
২০২৩ সালে আমিরশাহির ওপেক-ত্যাগের খবর ঝড়ের গতিতে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে বিশ্ব বাজারে হু-হু করে নেমে যায় খনিজ তেলের দর। প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে নীরব ছিল আবু ধাবি। পরে অবশ্য একে পুরোপুরি গুজব বলে উড়িয়ে দেয় পশ্চিম এশিয়ার ওই আরব মুলুক। দু’বছরের মাথায় ফের একই ধরনের গুঞ্জন ওঠায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এ বার কি তবে সত্যি সত্যিই ওপেক-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেবে আমিরশাহির সরকার?
আবু ধাবির ওপেক-ত্যাগের ইচ্ছার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠনের সদস্য হওয়ায় আমিরশাহির সরকারকে ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। ইচ্ছামতো খনিজ তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না পশ্চিম এশিয়ার এই আরব মুলুক। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ছে আবু ধাবি। সেই কারণেই ওপেক ছাড়তে চাইছেন সেখানকার ধনকুবের শেখরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে ‘তরল সোনা’র দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে ওপেক। সেই কারণেই ইচ্ছামতো তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলির উপর একরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে এই সংগঠন। ওপেকের সদস্যেরা তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করলে বিশ্ব বাজারে বাড়বে সরবরাহ। সে ক্ষেত্রে হ্রাস পাবে ‘তরল সোনা’র দাম। উল্লেখ্য, ওপেকভুক্ত দেশগুলি মূলত তেল বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ফলে এর দাম কমে গেলে প্রবল চাপে পড়তে পারে তাদের অর্থনীতি।
বর্তমানে ওপেকের নেতৃত্ব রয়েছে সৌদি আরবের হাতে। পশ্চিম এশিয়ার এই আরব মুলুকটি সর্বাধিক তেল উত্তোলন করে থাকে। অন্য দিকে, ওপেকভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ‘তরল সোনা’ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আমিরশাহি। ২০২৩ সালে সংগঠনের নিয়ম ভেঙে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল আবু ধাবি। সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা দেয় সৌদি আরব। ফলে এই ইস্যুতে দুই আরব মুলুকের মধ্যে বাড়তে থাকে দ্বন্দ্ব। পরবর্তী দু’বছরে সেই ফাটল আরও চওড়া হয়েছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সৌদি এবং আমিরশাহি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। রিয়াধের অর্থনীতি পুরোপুরি তেল উত্তোলনের উপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে দেশের আধুনিকীকরণে জোর দিয়েছে আবু ধাবি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘সবুজ শক্তি’ বা গ্রিন এনার্জি তৈরির দিকেও নজর রয়েছে সেখানকার শেখদের। এই সমস্ত প্রকল্পের বাস্তবায়নে চাই বিপুল অর্থ। আর তাই তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার ইচ্ছা রয়েছে আমিরশাহি সরকারের।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবু ধাবি মনে করে আগামী দিনে পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হবে জীবাশ্ম জ্বালানি। সেই জায়গায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি বা সবুজ শক্তি ব্যবহার করবে আমজনতা। জীবাশ্ম জ্বালানি লুপ্ত হলে খনিজ তেলের প্রয়োজন ফুরোবে। সেই কারণে অতি দ্রুত খনিজ তেল বিক্রি করে মুনাফার অর্থে পকেট ভরাতে চাইছে আমিরশাহি সরকার। সরকারি কোষাগারে আসা টাকা বিকল্প শক্তি তৈরির জন্য ব্যবহার করতে চাইছে এই উপসাগরীয় আরব মুলুক।
কিন্তু, আমিরশাহির এই পরিকল্পনায় সৌদির আপত্তি রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা মরু অঞ্চলের অন্তর্গত। ফলত, আবু ধাবির মতো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে জোর দেওয়া রিয়াধের পক্ষে সম্ভব নয়। সৌদির প্রধানমন্ত্রী তথা যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন ভাল করেই জানেন যে, আমিরশাহি ‘তরল সোনা’র উত্তোলন বৃদ্ধি করলে বিশ্ব বাজারে কমে যাবে তেলের দাম। সে ক্ষেত্রে ভেঙে পড়তে পারে রিয়াধের অর্থনীতি। সেই কারণে, ক্রমাগত এর উত্তোলন কমাতে আবু ধাবির উপর চাপ তৈরি করে যাচ্ছেন যুবরাজ সলমন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, এই মনোভাবের জন্যই সৌদি ও আমিরশাহির সম্পর্কে দেখা দিয়েছে টানাপড়েন। আবু ধাবির অভিযোগ, ওপেকের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকায় তেল উৎপাদনে হ্রাস টানতে একরকম তাদের বাধ্য করছে রিয়াধ। ফলে ইচ্ছা থাকলেও অর্থনীতির বিস্তার ঘটাতে পারছেন না আমিরশাহির প্রেসিডেন্ট শেখ মহম্মদ বিন জ়ায়েদ আল নাহিয়ান। আর সেই কারণেই তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ছাড়তে চাইছেন তিনি।
বর্তমানে দৈনিক তেল উৎপাদনের নিরিখে প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা। দিনে গড়ে ১ কোটি ২৯ লক্ষ ব্যারেল ‘তরল সোনা’ উত্তোলন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে সৌদি আরব এবং রাশিয়া। এই দুই দেশের দৈনিক তেল উত্তোলনের পরিমাণ যথাক্রমে ১ কোটি ৪ লক্ষ এবং ৯৯ লক্ষ ব্যারেল। দৈনিক ৪৫ লক্ষ ব্যারেল খনিজ তেল উৎপাদনকারী কানাডা রয়েছে চতুর্থ স্থানে। এই তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে আমিরশাহি। উপসাগরীয় দেশটির দৈনিক ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের মাত্রা ৪৩ লক্ষ ব্যারেল।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই তেল উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্য দিকে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার কারণে ‘তরল সোনা’র উৎপাদন পাল্লা দিয়ে বাড়াচ্ছে রাশিয়া। আমিরশাহির আশঙ্কা, এর জেরে আগামী দিনে বিশ্ব বাজারে আরও হ্রাস পাবে তেলের দর। আর তাই ওপেকে থেকে এখন নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনে রাজি নয় আবু ধাবি। বরং উত্তোলন বৃদ্ধি করে পৃথক ভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে এই আরব মুলুক।
নিয়ন্ত্রিত তেল উৎপাদন নীতির কারণে ২০০৯ সালে ওপেক ত্যাগ করে ইন্দোনেশিয়া। ২০১৬ সালে ফের ওপেকে ফিরে আসে জাকার্তা। কিন্তু, ওই বছর বিশ্বের তেল অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পা পড়ায় হু-হু করে নেমে যায় ‘তরল সোনা’র দর। ফলে সঙ্গে সঙ্গে ওপেকের সদস্যপদ স্থগিত করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র।
২০২০ সালে ওপেক ত্যাগ করে ইকুয়েডর। এই বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল তেল উত্তোলন শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। তাদের দৈনিক ‘তরল সোনা’ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৯ লক্ষ ব্যারেল। এতে ইকুয়েডরের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। ওপেক ছাড়ার পর আমিরশাহি সেই রাস্তা ধরতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি শেষ পর্যন্ত ওপেক ছাড়লে আরব দুনিয়ায় তেলকে কেন্দ্র করে ফের সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। রিয়াধ ও আবু ধাবির সম্পর্ক তলানিতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, ‘তরল সোনা’র বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে রাশিয়া বা ইকুয়েডরের মতো আমিরশাহিকে লাভবান হতে দেখলে ওপেক ত্যাগের হিড়িক দেখা যেতে পারে। তখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে এই সংগঠন।
২০২০ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। ফলে অর্থনীতি বাঁচাতে ভারতকে সস্তা দরে তেল বিক্রির প্রস্তাব দেয় মস্কো। ক্রেমলিনের সেই ‘মেগা অফার’ লুফে নেয় নয়াদিল্লি। বর্তমানে আমদানি করা খনিজ তেলের ৩৬ শতাংশই আসছে রাশিয়া থেকে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক এবং সৌদি আরব। এই দুই আরব মুলুক থেকে যথাক্রমে ২১ এবং ১৩ শতাংশ ‘তরল সোনা’ কিনছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
এই তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে আমদানি করা তেলের ন’শতাংশ আসে আবু ধাবি থেকে। আর এ ক্ষেত্রে আমেরিকার তিন শতাংশ অবদান রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, আমিরশাহি ওপেক ছাড়লে আলাদা করে তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির রাস্তা খুলে যাবে। নয়াদিল্লি সস্তা দরে তেল কেনার সুযোগ পেতে পারে। কারণ, উপসাগরীয় আরব মুলুকটির সঙ্গে মোদী সরকারের সম্পর্ক বেশ ভাল।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় ওপেকের। প্রথমে এর সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ। সেই দেশগুলি হল ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব এবং ভেনেজ়ুয়েলা। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২। ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ৩৮ শতাংশ তেল উৎপাদন করে থাকে এই সংগঠনের দেশগুলি।
২০১৬ সালে কলেবরে আরও বৃদ্ধি পায় ওপেক। এই সংগঠনের বাইরে থাকা আরও ১০টি দেশকে নিয়ে তৈরি হয় ওপেক প্লাস। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা। ওপেক প্লাসের অন্যতম সদস্য হল রাশিয়া। মূল ওপেকের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও এটি একটি আলাদা সংগঠন।
২০২৪ সালে ওপেকের সদস্যপদ ছেড়ে দেয় অ্যাঙ্গোলা। ২০১৯ সালে এই সংগঠন ত্যাগ করে কাতার। প্রতিটা ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলির যুক্তি ছিল তেল উৎপাদনে হ্রাস টানতে বাধ্য করছে এই সংগঠন। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হচ্ছে তাদের। সেই কারণেই আমিরশাহির ওপেক বিচ্ছেদের আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।