আরব দুনিয়ায় ফের মুখ পুড়ল পাকিস্তানের। গণহারে ইসলামাবাদের ভিসা বাতিল করছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির পাসপোর্টের উপর একরকম নিষেধাজ্ঞার ‘রবার স্ট্যাম্প’ বসিয়ে দিয়েছে তারা। ফলে ব্যবসা হোক বা পর্যটন, কোনও কিছুর জন্যই দুবাই, শারজা ও আবু ধাবির মতো উপসাগরীয় শহরগুলিতে আপাতত যেতে পারবেন না পকিস্তানের সাধারণ বাসিন্দারা। অতীতেও একই পদক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে সৌদি আরবকে।
চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর আমিরশাহির ভিসা নীতি নিয়ে একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে পাকিস্তানের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘দ্য ডন’। সেখানে বলা হয়েছে, গোটা বিষয়টিতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। পাক সংসদ ‘মজলিশ-ই-সুরা’র উচ্চকক্ষ সেনেটকে পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন তারা। এর প্রভাবে ইসলামাবাদ-আবু ধাবির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলেও মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডন’ লিখেছে, সম্প্রতি আমিরশাহির গণহারে ভিসা বাতিল নিয়ে সেনেটের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যকরী কমিটির কাছে বিবৃতি দেন অতিরিক্ত স্বরাষ্ট্র সচিব সলমন চৌধরি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘পাক পাসপোর্টের উপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে আছে আবু ধাবি ও সৌদি আরব। তাদের সিদ্ধান্ত বদল করানো অত্যন্ত কঠিন হতে চলেছে।’’
সেনেট কমিটিকে সলমন জানিয়েছেন, বর্তমানে দু’ধরনের পাক পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ভিসা দিচ্ছে আমিরশাহি। সেগুলি হল, নীল এবং কূটনৈতিক (ডিপ্লোম্যাটিক) পাসপোর্ট। প্রথমটি শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে থাকে ইসলামাবাদ। আম পাকিস্তানিরা যে পাসপোর্ট ব্যবহার করেন তার কভার পাতার রং সবুজ। উল্লেখ্য, ভিসা বাতিলের কারণও পশ্চিমের প্রতিবেশীকে জানিয়ে দিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার ওই উপসাগরীয় রাষ্ট্র।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন পাক সেনেটের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যকরী কমিটির চেয়ারপার্সন সামিনা মুমতাজ়। তাঁর কথায়, ‘‘আবু ধাবির যুক্তি হল পর্যটনের নামে সেখানে গিয়ে পাক নাগরিকেরা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। সেই কারণেই গণহারে ভিসা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে তারা। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান খুঁজতে হবে। নইলে এর প্রভাব অর্থনীতি এবং সমাজের উপর ব্যাপক ভাবে পড়তে পারে।’’
পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সরকার জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে হাতেগোনা কয়েক জন বাসিন্দাকে ভিসা দিয়েছে আমিরশাহি। এর জন্য আবু ধাবির কাছে যথেষ্ট তদ্বির করতে হয়েছে তাঁদের। সূত্রের খবর, কিছু দিন আগে ভিসানীতিতে বদল আনার বিষয়টি অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ ঔরঙ্গজ়েবকে জানান ইসলামাবাদে নিযুক্ত উপসাগরীয় দেশটির রাষ্ট্রদূত সালেম এম সালেম আল বাওয়াব আল জ়াবি। তার পর থেকেই গণহারে আবেদন বাতিল করতে থাকে আমিরশাহি প্রশাসন।
ভিসা বিলি সহজ করতে ইতিমধ্যেই অনলাইনে আবেদন, পাসপোর্ট স্ট্যাম্পিং ছাড়া ই-ভিসা প্রদান এবং ডিজিটাল সংযোগ পরিষেবা চালু করেছে আমিরশাহি সরকার। আর তাই পাকিস্তানের ভিসা সেন্টারগুলিতে সংস্কারের কাজ চালাচ্ছে আবু ধাবির বিদেশ মন্ত্রক। বর্তমানে সেখানে দিনে সর্বোচ্চ ৫০০টি ই-ভিসার আবেদন প্রক্রিয়াকরণের সুবিধা রয়েছে। ভিসা বাতিলের নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্কারের বড় ভূমিকা থাকতে পারে বলেও মনে করেছে ইসলামাবাদ।
ভিসা সমস্যার সমাধান করতে এ বছরের জুলাইয়ে আমিরশাহি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী (পড়ুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সৈয়দ মহসিন রাজা নকভি। ওই সময় ভিসা বাতিলের পরিমাণ কমানোর আশ্বাস দেন উপসাগরীয় দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখ সইদ বিন জ়ায়েদ আল নাহিয়ান। এপ্রিলে ইসলামাবাদে নিযুক্ত আবু ধাবির রাষ্ট্রদূত একটি অনুষ্ঠানে বলেন, পাক নাগরিকদের পাঁচ বছরের জন্য ভিসা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি।
পাক গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সমস্যা বাড়তে শুরু করে। ওই সময়ে ইসলামাবাদের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ সেনেটের স্ট্যান্ডিং কমিটিকে একটি নোট পাঠায় আবু ধাবি। সেখানে বলা হয়, আনুষ্ঠানিক ভাবে ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখছে তারা। কারণ, বেড়াতে যাওয়ার নাম করে ভিক্ষাবৃত্তিতে রোজগারের আশায় উপসাগরীয় দেশটিতে পাড়ি দিচ্ছে শয়ে শয়ে পাকিস্তানি। এর জেরে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
এ বছরের অগস্টে পাকিস্তানের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশ্যে আসে এক বিস্ফোরক তথ্য। জানা গিয়েছে, ইসলামাবাদের ২৩ কোটি বাসিন্দার মধ্যে প্রায় চার কোটির জীবন চলছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। বর্তমানে এটাই পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি ছ’জনের মধ্যে এক জন ভিক্ষাজীবী। তাঁদের প্রতি দিনের আয় অন্যান্য পেশার চাকরিজীবীর আয়ের প্রায় সমান বলে জানা গিয়েছে।
দেশের আর্থিক হাল খারাপ হওয়ায় অতিরিক্ত লাভের আশায় ভিক্ষাজীবী পাক নাগরিকদের একাংশ দীর্ঘ দিন ধরেই পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। তীর্থযাত্রা ও পর্যটনের ছুতোয় পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ভিড় জমানোর প্রবণতা রয়েছে তাঁদের। আমিরশাহি ছাড়াও সৌদি আরব, ইরাক, ওমান, কাতার এবং মালয়েশিয়াকে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা বলে মনে করেন তাঁরা। আর তাই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলিতে পাক ভিখারিদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
খনিজ তেল রফতানির কারণে পশ্চিম এশিয়ার উপসাগরীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভাল। আর তাই ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে টাকা জমিয়ে সেখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন পাক নাগরিকদের একাংশ। সেটাই সৌদি আরব ও আমিরশাহির মতো দেশগুলির মাথাব্যথার মূল কারণ। তাদের ঝাঁ-চকচকে শহরগুলি ইসলামাবাদের ভিখারিতে ভরে যাক, এটা কোনও অবস্থাতেই চায় না রিয়াধ ও আবু ধাবি।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও মারাত্মক অভিযোগ তুলেছে সৌদি আরব। রিয়াধের দাবি, হজযাত্রার অজ়ুহাতে প্রতি বছর মক্কায় লাখ লাখ ভিখারি পাঠায় ইসলামাবাদ। দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রীদের থেকে ভিক্ষার নামে তোলাবাজি এবং তাদের জিনিসপত্র চুরি বা ছিনতাইয়ের ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে পাক ভিখারিদের বিরুদ্ধে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কয়েক বার কড়া বিবৃতিও দিতে দেখা গিয়েছে ওই উপসাগরীয় আরব দেশটির সরকারকে।
পাক পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অবশ্য বিদেশে ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন অভ্যন্তরীণমন্ত্রী (পড়ুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মহসিন নকভি। তিনি জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের অগস্টের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ভিখারিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার ছ’টি দেশ। এঁদের সিংহভাগই সিন্ধ প্রদেশের বাসিন্দা। সংখ্যার নিরিখে তার পর রয়েছে পঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া, বালোচিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নাম।
‘দ্য ডন’ আবার জানিয়েছে, ইসলামাবাদের ভিখারিদের দৈনিক গড় আয় ৮৫০ পাকিস্তানি টাকা। দেশে মোট ৩.৮ কোটি পেশাদার ভিখারি রয়েছেন। তাঁদের মোট দৈনিক আয় ১১ কোটি ২৫ লক্ষ ডলার। অর্থাৎ, বছরে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে পশ্চিমের প্রতিবেশীর ভিখারিরা ৪,২০০ কোটি ডলার রোজগার করেন। সেই কারণে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা নাগরিকদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সেখানে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইট্স কমিশনের সমীক্ষা অনুসারে, পাকিস্তানের জনসংখ্যার ২.৫ থেকে ১১ শতাংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে থাকেন। ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রধান শহরগুলির রাস্তায় প্রায় ১২ লক্ষ শিশু ঘুরে বেড়ায় ভিক্ষা করে রোজগার করার জন্য।
২০২৩ সালে সেনেট কমিটির বৈঠকে পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশসচিব জুলফিকর হায়দার বলেন, বিদেশে গ্রেফতার হওয়া ভিক্ষুকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পাক নাগরিক। গত আড়াই বছরে তাদের মধ্যে ৪৪ হাজার জনকে ইসলামাবাদে ফেরত পাঠিয়েছে একাধিক উপসাগরীয় দেশ। ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা করার কারণে দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে শাহবাজ় সরকার। যদিও সমাধানের পথ এখনও খুঁজে পাননি তাঁরা।
পাক গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, ধর্মীয় ও অন্যান্য পর্যটনের নামে দেশের ভিতরে একটি ভিখারি মাফিয়াতন্ত্র গড়ে তুলেছে একাধিক ট্যুর অপারেটর। কমিশনের মাধ্যমে মোটা টাকা নিয়ে লাখ লাখ বাসিন্দাকে বিদেশে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পাঠায় তারা। ২০২৩ সালে প্রায় দু’হাজার নাগরিকের পাসপোর্ট স্থগিত করে শরিফ সরকার। তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
তবে পাকিস্তান ও আমিরশাহির মধ্যে গভীর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উপসাগরীয় দেশটিতে প্রতি বছর কাজের খোঁজে যান পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির বহু বাসিন্দা। তাদের ভিসা অবশ্য এখনও বাতিল করেনি আবু ধাবি। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে সেখানেও নিষেধাজ্ঞার কোপ পড়তে পারে বলে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।