দেখতে দেখতে সাড়ে তিন বছর পার। শত চেষ্টাতেও থামছে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সংঘাত বন্ধের মরিয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুখে অবশ্য বার বার শান্তির কথা বলতে শোনা যাচ্ছে তাঁকে। যদিও গোটাটাই তাঁর কুম্ভীরাশ্রু বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। কারণ, পূর্ব ইউরোপের সংঘর্ষ থেকে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে লড়াই থামুক তা আদপেই চায় না আমেরিকা।
সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মুনাফা সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে গবেষক সংস্থা ‘অবজ়ারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (ওআরএফ)। সেখানে বলা হয়েছে, পূর্ব ইউরোপের সংঘাত শুরু হওয়া ইস্তক আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্পে ‘বিস্ফোরক’ বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। কারণ, গত সাড়ে তিন বছরে কিভের আমদানি করা হাতিয়ারের ৪৫ শতাংশই সরবরাহ করেছে ওয়াশিংটন। মার্কিন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ রয়েছে সেখানকার সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাগুলির দখলে।
ওআরএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বব্যাপী খরচ বৃদ্ধি পায় ৯.৪ শতাংশ। ফলে সেটা পৌঁছোয় ২.৭২ লক্ষ কোটি ডলারে। বিশ শতকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে সাড়ে চার দশক ধরে চলা ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর পর আর কখনওই এই হারে সামরিক ব্যয়কে ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা যায়নি। এর জন্য মূলত ইউক্রেন যুদ্ধকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষকেরা। শুধু তা-ই নয়, এর ষোলো আনা লাভ যে যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে, তারও উল্লেখ রয়েছে ওই রিপোর্টে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (পড়ুন স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে রাশিয়া। পূর্ব ইউরোপে ওই সংঘাত শুরু হতেই হাতিয়ার, গোলা-বারুদ এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়ে কিভের পাশে দাঁড়ান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা জো বাইডেন। গত বছরের নির্বাচনে তাঁর এই নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির বর্ষীয়ান নেতা ট্রাম্প। যদিও কুর্সি লাভের পর তিনি যে ইউক্রেনে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম পাঠানো বন্ধ রেখেছেন, এমনটা নয়।
‘অবজ়ারভার রিসার্চ’-এর রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বাইডেনের তুলনায় ট্রাম্প জমানায় ইউক্রেনকে অস্ত্র বিক্রির মাত্রা আমেরিকা বাড়িয়েছে বই কমায়নি। তবে সরাসরি কিভকে হাতিয়ার দেওয়ার বদলে বর্তমানে ঘুরপথে সেটা পাঠাচ্ছে ওয়াশিংটন। ২০২০ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে রুশ আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছিল। ফলে পরবর্তী চার বছরে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে একসময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা ইউক্রেন।
ওআরএফের গবেষকদের দাবি, ২০১৫-’১৯ সালের মধ্যে দুনিয়াব্যাপী হাতিয়ার আমদানির মাত্র ০.১ শতাংশ ছিল কিভের দখলে। কিন্তু, ২০২০-’২৪ সালের মধ্যে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৮ শতাংশ। অর্থাৎ, এই সময়সীমার মধ্যে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে ৯,৬২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল হাতিয়ারের আমদানি। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি করা হাতিয়ারের ৯.৩ শতাংশ কেন্দ্রীভূত ছিল একটি মাত্র দেশে। আর সেটা হল ইউক্রেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। পরের সাত মাসের মাথায় (পড়ুন অগস্টে) ৩,৩৫০টি বর্ধিত পাল্লার হামলাকারী ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে বিক্রির অনুমোদন দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি বিক্রির জন্য ওয়াশিংটনের কোষাগারে ৮২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার ঢুকবে বলে জানা গিয়েছে। ওই টাকা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) ভুক্ত দেশগুলি মেটাবে বলে জানা গিয়েছে।
সূত্রের খবর, ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বর্ধিত পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার দাম চুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং নেদারল্যান্ডস। ক্ষমতায় আসার পর একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন ট্রাম্প। তা হল, সামরিক সাহায্যের নামে কোনও দেশকে ঢালাও অনুদান দেবে না তাঁর সরকার। সরাসরি বা নেটোর মাধ্যমে অস্ত্র কিনতে হবে ইউক্রেনকে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই দাবি মেনে নিয়েই ওয়াশিংটনের থেকে হাতিয়ার আমদানি বজায় রেখেছে কিভ। ফলে সামরিক সরঞ্জামের ব্যবসায় সে ভাবে কোনও সমস্যার মুখে পড়ছে না ওয়াশিংটন।
এর পাশাপাশি নেটো-ভুক্ত দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনতে রাজি করিয়েছেন ট্রাম্প। সেই হাতিয়ারও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের রণাঙ্গনে যাবে বলে জানা গিয়েছে। কিভের অত্যাবশ্যক সামরিক সরঞ্জামের একটি তালিকা তৈরি করেছে নেটো। গত ১৪ জুলাই হোয়াইট হাউসে সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটটির মহাসচিব (সেক্রেটারি জেনারেল) মার্ক রুটের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সেখানে অত্যাবশ্যক সামরিক সরঞ্জামের জন্য কিভকে ২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ দিতে সম্মত হয় নেটো।
গত ৪ অগস্ট ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে কামান ও গোলা-বারুদ পৌঁছে দিতে ৫০ কোটি ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করে নেদারল্যান্ডস। ঠিক তার পরের দিন (পড়ুন ৫ অগস্ট) সমপরিমাণ আর্থিক প্যাকেজের বিষয়টি নিশ্চিত করে ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং সুইডেন। ১৩ ও ২৪ অগস্ট কিভের জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে জার্মানি ও কানাডা। এই দুই দেশের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার বলে জানা গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্যাকেজগুলির অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের থেকেই হাতিয়ার কিনবে নেটো। ফলে আখেরে লাভ যে আমেরিকার হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এ বছর নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে নেটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন ট্রাম্প। সেখানে সংশ্লিষ্ট জোটটির সদস্য দেশগুলিকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দের বার্তা দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের পর ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত সামরিক খাতে খরচ করতে সম্মত হয় যাবতীয় নেটো-ভুক্ত দেশ।
গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪-’১৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৩৫ শতাংশ। এটি আগে ২০ থেকে ২১ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। ২০২০-’২৪ সালের মধ্যে সেটা আরও বেড়ে ৪৩ শতাংশে গিয়ে পৌঁছোয়। এই সময়সীমার মধ্যে সর্বাধিক মুনাফা করে আমেরিকার পাঁচটি প্রতিরক্ষা সংস্থা। তারা হল লকহিড মার্টিন, আরটিএক্স, জেনারেল ডায়নামিক্স, নর্থরপ গ্রুম্যান এবং বোয়িং।
অস্ত্র ব্যবসায় বিপুল লাভের স্বাদ অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম বার পায় আমেরিকা। জাপান এবং জার্মানির আক্রমণের আতঙ্কে হাতিয়ার নির্মাণে জোর দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ থেমে গেলে শুরু হয় সমস্যা। অস্ত্র কারখানাগুলিতে আসে মন্দা। কমে যায় পুঁজি, চলে যথেচ্ছ ছাঁটাই।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন নতুন অস্ত্রের বাজারের খোঁজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা। তত দিনে একটি সহজ সত্য বুঝে গিয়েছেন তাঁরা। সেটা হল, যুদ্ধের আতঙ্ক তৈরি করতে পারলেই বিপুল টাকা দিয়ে হাতিয়ার কিনবে দুনিয়ার যে কোনও দেশ। তবে তার জন্য দেখাতে হবে স্বাধীনতার মিথ্যা স্বপ্ন। এমনকি প্রয়োজনে নিজেকেই নামতে হতে পারে লড়াইয়ের ময়দানে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। এই সময়ে হাতিয়ার ব্যবসায় মুনাফা করতে কমিউনিজ়মের আতঙ্ককে বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরেরা। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল ওয়াশিংটনের অস্ত্র নির্মাণকারী সমস্ত সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত শতাব্দীর ৫০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত হাতিয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে মূলত সোভিয়েত আতঙ্ককেই পুঁজি করেছিল আমেরিকা। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে নেটো। ওই সময় সোভিয়েত হামলার ভয় দেখিয়ে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বিপুল অস্ত্র বিক্রি করে ওয়াশিংটন। ফলে ৫০-এর দশকে অস্ত্র নির্মাণকারী আমেরিকান সংস্থা ‘জেনারেল ডায়নামিক্স’-এর শেয়ার সূচক ৪০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
অস্ত্রের বাজার ঠিক রাখতে একসময়ে দেশের ভিতরে ভুয়ো প্রচার চালিয়েছিল আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। ৬০-এর দশকে সোভিয়েত সেনা এসে নিরীহ যুক্তরাষ্ট্রবাসীর ফ্রিজে রাখা ভদকা (রাশিয়ান মদ) খেয়ে যাবে বলে খবর ছড়িয়ে দেন তাঁরা। ফলে মস্কোর প্রতি আটলান্টিকের পারে বাড়তে থাকে ঘৃণা। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী বছরগুলিতে সেখানকার হাতিয়ার নির্মাণকারী সংস্থাগুলির দক্ষ শ্রমিক বা প্রযুক্তবিদ পাওয়ার ক্ষেত্রে কখনওই সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে শীতল লড়াই পর্বের গোপন তথ্য প্রকাশ্যে আনে সিআইএ। সেই সমস্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ৮০-র দশকের পরবর্তী সময়ে মস্কোর আর্থিক অবস্থা ইটালির থেকেও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন আমেরিকার যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী জনপ্রিয় সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৎকালীন সিইও। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমরা হাতিয়ারের বাজারে আধিপত্য রাখতে যে ভাবে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলাম, তার জন্য নোবেল পাওয়া উচিত।’’
তবে অস্ত্র বিক্রি করতে আমেরিকা যে শুধুই সোভিয়েত আতঙ্কের উপর নির্ভরশীল ছিল, এমনটা নয়। ১৯৫৩ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। তিনি কুর্সি থেকে সরতেই পারস্য উপসাগরের তীরের দেশটিতে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে বিবাদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে হাতিয়ার বিক্রির খোলা বাজার চলে আসে ওয়াশিংটনের হাতে।
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৫,৯০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিশ্বব্যাপী বিক্রি করেছে ওয়াশিংটন। এর ৭০ শতাংশই গিয়েছে পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে। এর মাধ্যমে সেখানে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।