মহামন্দার খাদের মুখে দাঁড়িয়ে আমেরিকা! সমীক্ষক সংস্থা ‘মুডিজ় কর্পোরেশন’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ মার্ক জ়ান্ডির এ-হেন সতর্কবার্তার পর যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো বিপদ বাড়াতে পারে মুদ্রাস্ফীতি। চলতি বছরের ৩০ জুলাই ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে কটাক্ষ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু, মাত্র দু’মাসের মাথাতেই নিজের ঘর সামলাতে যে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার ভবিষ্যদ্বাণী করে খবরের শিরোনামে আসেন জ়ান্ডি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তালুর মতো চেনেন তিনি। এ-হেন ‘মুডিজ়’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদের সতর্কবার্তার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। জ়ান্ডির দাবি, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) নিরিখে আমেরিকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রদেশের সূচক রয়েছে ঋণাত্মক। এতে মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
সম্প্রতি এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন মার্ক। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ প্রদেশের জিডিপি হয় মন্দায়, নয়তো সেই রকম পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য এক তৃতীয়াংশ কিছুটা স্থিতিশীল। বাকি এক তৃতীয়াংশের সূচক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কথায় অর্থনীতি যথেষ্ট অস্থির। আমার মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমেরিকায় মন্দা আসার মতো সহায়ক পরিস্থিতি রয়েছে।’’
কোনও দেশ আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে, এটা বোঝার একটা সুনির্দিষ্ট উপায় রয়েছে। একটি অর্থবর্ষে পর পর দু’টি ত্রৈমাসিকে যদি জিডিপির সূচক ঋণাত্মক থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে মন্দা গ্রাস করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) প্রথম তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে শূন্যের নীচে নেমে যায় যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির সূচক। জুলাই-অগস্টে পরিস্থিতি সে ভাবে বদলায়নি। সেপ্টেম্বরে অবস্থার বিরাট পরিবর্তন না হলে মার্কিন অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
সংবাদসংস্থা ‘নিউজ়উইক’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিস্থিতির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন জ়ান্ডি। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ আমেরিকাবাসীদের জন্য দুঃসময় শুরু হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা শুরু হলে হু-হু করে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। খাদ্যসামগ্রীর জন্য আরও বেশি খরচ করতে হবে আমাদের। পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলিতে কর্মসংস্থানে আসবে বড় আঘাত। ফের এক বার গণহারে ছাঁটাই দেখতে পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।’’
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এক বার মন্দার দরজায় চলে গিয়েছিল আমেরিকা। কোনও মতে সে যাত্রা পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার অবশ্য ওই সময় থেকেই অগ্নিমূল্য হয়ে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতির সেই সূচককে আর টেনে নামতে পারেননি বাইডেন। ফলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই বিষয়টিকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালান ট্রাম্প। ভোটের বাক্সে তার ফলও পেয়েছেন তিনি।
‘নিউজ়উইক’-এর সাক্ষাৎকারে এই নিয়েও মুখ খোলেন জ়ান্ডি। বলেন, ‘‘বাজারে জিনিসের দাম যে বেড়েছে, তা তো দেখাই যাচ্ছে। তবে পুরোপুরি ভাবে মন্দা চলে এলে এটা আরও কয়েক গুণ উপরের দিকে উঠতে পারে। আমার ধারণা, আগামী দিনে কেনাকাটা আরও কমাবে মার্কিন আমজনতা। কারণ, আসন্ন আর্থিক সঙ্কট তাঁদের পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব।’’ পাশাপাশি, ট্রাম্পের শুল্কনীতি এবং আমেরিকার আবাসন শিল্পের দুরবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
‘মুডিজ়’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেপরোয়া ভাবে শুল্ক চাপানোর জেরে আমেরিকার শিল্প সংস্থাগুলির লাভের চেয়ে লোকসান হয়েছে অনেক বেশি। শুধু তা-ই নয়, এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ কঠিন হচ্ছে। এর প্রভাব উৎপাদনের খরচে পড়ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি।
জ়ান্ডির কথা সত্যি হলে, এ বছরই আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতির হার ২.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে তিন শতাংশে গিয়ে পৌঁছোবে। এই সূচক লাগাতার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৬) সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার চার শতাংশ বা তার বেশি থাকার পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। মন্দার জন্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ বা ছাঁটাইয়ের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে, সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘মুডিজ়’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ।
আর্থিক দিক থেকে আমেরিকার দক্ষিণ দিকের প্রদেশগুলি বেশি শক্তিশালী। ‘মুডিজ়’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, সেখানে জিডিপি বৃদ্ধির গতি যথেষ্ট শ্লথ রয়েছে। কেবলমাত্র সুনাম বজায় রেখেছে ক্যালিফোর্নিয়া এবং নিউ ইয়র্ক। মার্কিন অর্থনীতির এক পঞ্চমাংশ আসে এই দুই এলাকা থেকে, যা এখনও পর্যন্ত মোটের উপরে ধরে রাখতে পেরেছে তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ক্যালিফোর্নিয়ায় রয়েছে সিলিকন ভ্যালি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলিতে কাজ করেন বিপুল সংখ্যক ভারতীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার ঝুঁকি সর্বাধিক বেশি রয়েছে ওয়াইমিং, মন্টানা, মিনেসোটা, মিসিসিপি, কানসাস এবং ম্যাসাচুসেটসে। ‘মুডিজ়’ জানিয়েছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত মার্কিন ভোক্তাদের দৈনন্দিন খরচ গত বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। ২০০৮-’০৯ অর্থবর্ষের পর আর কখনওই আমেরিকার আমজনতার ব্যয়ের সূচক এতটা হ্রাস পায়নি। এই অঙ্ক নিয়েও যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ মার্ক জ়ান্ডি।
‘মুডিজ়’-এর পাশাপাশি মন্দা নিয়ে মার্কিন সরকারকে সতর্ক করেছে আর্থিক রেটিং সংস্থা ‘ইউবিএস’। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছরের শেষে ওই বিপদের মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। মন্দা আসার আশঙ্কা ৯৩ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছে তারা। যদিও এই সব সতর্কবার্তা গায়েই মাখছেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। উল্টে ভারতের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ বজায় রেখেছেন তিনি। পাশাপাশি, নয়াদিল্লিকে আরও বড় শাস্তি দেওয়ার হুঙ্কার শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়।
গত ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুক্তি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে এই পদক্ষেপ করেছেন তিনি। পূর্ব ইউরোপের ওই সংঘাত শুরু হওয়া ইস্তক মস্কোর থেকে সস্তা দরে অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানি করে চলেছে নয়াদিল্লি। ট্রাম্প মনে করেন, এতে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। আর তাই রাশিয়াকে ‘ভাতে মারতে’ ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
গত ৩ সেপ্টেম্বর এই ইস্যুতে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন মার্কিন প্রেসি়ডেন্ট। বলেন, ‘‘ভারতের উপরে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের জন্য রাশিয়ার বহু কোটি ডলারের লোকসান হয়েছে।’’ কিন্তু, কী ভাবে সেটা তিনি বা তাঁর প্রশাসন বুঝতে পারল, সেই ব্যাখ্যা দেননি ট্রাম্প। উল্টে হুমকির সুরে বলেন, ‘‘আমি এখনও দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ করিনি।’’ ফলে অচিরেই নয়াদিল্লির উপরে ওয়াশিংটন আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা চাপাবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্পের এ-হেন শুল্কনীতির অবশ্য আমেরিকার ভিতরেই শুরু হয়ে গিয়েছে কড়া সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক এডোয়ার্ড প্রাইস বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রেসিডেন্ট অর্থনীতির কিছুই বোঝেন না। ভারতের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধের নামে বেপরোয়া এবং বিপজ্জনক পদক্ষেপ করছেন তিনি। অবিলম্বে নয়াদিল্লির পণ্যে ৫০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করুক হোয়াইট হাউস। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। ২১ শতকের পৃথিবী কৌশলগত অংশীদারদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেখানে ভারতের মতো বন্ধুকে হারানো চরম মূর্খামি।’’
গত ৩০ জুলাই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে নয়াদিল্লি ও মস্কোকে নিশানা করে একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। ওরা ‘মৃত অর্থনীতি’কে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। আমি সব কিছুর জন্য চিন্তা করি। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। একে বিশ্বের সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে প্রায় কোনও ব্যবসা নেই বললেই চলে।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেই শুরু হয় হইচই।
এর পরেই সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যি কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ছাড়া এটা সবাই জানে।’’ রায়বরেলীর জনপ্রতিনিধির ওই মন্তব্যের কড়া জবাব দেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের অর্থনীতি মোটেই মরে যায়নি। বরং দ্রুত গতিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমরা।’’
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, অগস্টের একেবারে শেষে চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) এপ্রিল থেকে জুনে জিডিপির হার প্রকাশ করে কেন্দ্র। মোদী সরকারের দেওয়া সেই তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে ৭.৮ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে সূচক। পরে ‘সেমিকন ইন্ডিয়া ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘দ্রুত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে ভারত।’’ বর্তমানে চতুর্থ স্থানে রয়েছে নয়াদিল্লির নাম।
সমীক্ষক সংস্থা ‘ইওয়াই ইকোনমিক ওয়াচ’ আবার তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, আগামী ১৩ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে ভারত। পাশাপাশি, তালিকায় এক নম্বর স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গদি টলমল হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। সেখানে চিনের উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল বলেই মনে করছেন তাঁরা।
তবে চলতি বছরে মার্কিন অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়লে তার আঁচ যে ভারতের গায়ে লাগবে না, এমনটা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এ দেশের একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। সেখানে বিপুল হারে ছাঁটাই দেখতে পাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। ‘মুডিজ়’-এর পূর্বাভাসকে মিথ্যা করে ট্রাম্প মন্দা ঠেকাতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার।