ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে আমেরিকার মেগা এন্ট্রি! সাবেক পারস্য দেশের আকাশে দাপিয়ে বেড়াল কৌশলগত মার্কিন বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’। শিয়া মুলুকের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রকে নিশানা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী। এই লড়াইয়ের সূচনা অবশ্য হয়েছে ইহুদিদের হাত ধরে। চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝি তেহরানের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের বিউগল বাজিয়ে দেয় তেল আভিভ। যুদ্ধ শুরুর জন্য এই সময়কে কেন বেছে নিল ইজ়রায়েল? এর জন্য কত দিনের প্রস্তুতি নিয়েছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু? দুনিয়া জুড়ে চলছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার ইরান আক্রমণ দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনার ফল। রাগে অন্ধ হয়ে মোটেই এই যুদ্ধে ঝাঁপ দেয়নি ইহুদিরা। বছরের পর বছর ধরে এর জন্য পরিকল্পনা করে গিয়েছে তেল আভিভ। পাশাপাশি, তেহরানের ‘হাঁড়ির খবর’ নিঃশব্দে সংগ্রহ করতে কোমর বেঁধে লেগেছিল ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। ফলে লড়াইয়ের গোড়াতেই একের পর এক শিয়া ফৌজের শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীকে নিকেশ করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি নেতানিয়াহু সরকারের।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গত শতাব্দীর ’৯০-এর দশকের শুরু থেকে ইরানের উপর নজরদারি বাড়াতে থাকেন ইহুদি গুপ্তচরেরা। তত দিনে অবশ্য তেহরানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে গিয়েছেন শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। সাবেক পারস্য দেশের সর্বোচ্চ নেতা (সুপ্রিম লিডার) পদে বসেই ইজ়রায়েলকে ‘শয়তানের দেশ’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশ্যে বহু বার ইহুদিভূমিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার শপথ নিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
১৯৮৯ সালে ইরানে ‘সর্বোচ্চ নেতা’র পদ পান আলি খামেনেই। তার পরই তেহরানের বিদেশনীতিতে আসে বড় বদল। পরবর্তী দশকগুলিতে ইজ়রায়েলকে ‘চক্রব্যূহে’ ঘিরে ফেলতে লেবাননে হিজ়বুল্লা, ইয়েমেনে হুথি এবং প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় হামাস নামের তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম দেয় খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা শিয়া ফৌজের আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। ইহুদিদের কাছে এগুলি জঙ্গি সংগঠন, যাদের পর্দার আড়ালে থেকে সমানে মদত দিয়ে চলেছে সাবেক পারস্য দেশ।
ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব মুছে দিতে আলি খামেনেই যে ওখানেই থেমে ছিলেন, তা নয়। ইহুদিদের অভিযোগ, ’৯০-এর দশকের একেবারে শেষে পৌঁছে পরমাণু বোমা তৈরির দিকে নজর দেন তিনি। সেইমতো দেশের একাধিক প্রান্তে গড়ে তোলা হয় আণবিক চুল্লি। প্রকাশ্যে বলা হয়, এগুলির উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু তেল আভিভের দাবি, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলিকে সামনে রেখে গোপনে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে চলছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ, যা পরমাণু বোমা নির্মাণে একান্ত ভাবে প্রয়োজন। যদিও প্রথম দিন থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে খামেনেইয়ের ইরান।
এই পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বে তেহরানকে ‘একঘরে’ করে ফেলতে রাষ্ট্রপুঞ্জে দেওয়া ভাষণে ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির প্রসঙ্গ তোলেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তখনই সবাইকে সতর্ক করে দেন তিনি। বলেন, ‘‘৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ সেরে ফেলেছে পশ্চিম এশিয়ার শিয়া মুলুক। আণবিক বোমা তৈরি করতে আরও ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ করতে হবে তাদের। এক বার আণবিক বোমা হাতে পেয়ে গেলে তা হামাস বা হিজ়বুল্লার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে দু’দণ্ড দেরি করবে না তেহরান।’’
গত কয়েক বছরে যখনই আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠেছেন নেতানিয়াহু, তখনই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কথা খুঁচিয়ে তুলেছেন। সাবেক পারস্য দেশটিকে ‘মানবতার অভিশাপ’ বলতেও ছাড়েননি তিনি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা ইহুদি ভূমিতে ঢুকে আক্রমণ শানালে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ঠিক তখনই কূটনীতিক রাস্তা থেকে সরে এসে সামরিক পথে এই সমস্যা সমাধানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তেল আভিভ।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সরাসরি ইরান আক্রমণের সাহস পেয়েছে ইজ়রায়েল। তেহরানের কাছে পরমাণু হাতিয়ার থাক, তা কখনওই চায়নি আমেরিকা। কারণ, ইহুদিভূমির মতোই যুক্তরাষ্ট্রকেও ‘শত্রু’ বলে মনে করেন আলি খামেনেই। যদিও প্রথম পর্যায়ে সাবেক পারস্য দেশটির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাননি ট্রাম্প। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানসিক চাপ তৈরি করে শিয়া মুলুকটিকে পরমাণু চুক্তিতে যেতে বাধ্য করা। ওই চুক্তির প্রথম শর্ত হল কোনও অবস্থাতেই আণবিক বোমা তৈরি করবে না ইরান।
ট্রাম্পের এই চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হচ্ছিল, তা কিন্তু নয়। বেশ কয়েক ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে ইরান। ফলে প্রমাদ গোনে ইজ়রায়েল। ইহুদিরা বুঝে যায়, এক বার ওই চুক্তি হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না তাদের। অন্য দিকে চুক্তিকে ঢাল করে গোপনে তেহরান পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেললে অস্তিত্বসঙ্কটের মুখে পড়বে তেল আভিভ। আর তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামার নির্দেশ দেন নেতানিয়াহু।
গত ১৫ জুন ওমানে পরমাণু চুক্তি নিয়ে তৃতীয় দফায় আমেরিকা ও ইরানি আধিকারিকদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। সেখানে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের রূপরেখা তৈরি হবে বলে গুপ্তচর মারফত খবর পায় ইজ়রায়েল। আর তাই কালবিলম্ব না করে ১৩ জুন সাবেক পারস্য দেশের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইহুদি বায়ুসেনা। এই অভিযানের নাম ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ দিয়েছেন নেতানিয়াহু। তাঁর ওই পদক্ষেপের পর দু’তরফে তীব্র হয় সংঘাত।
এ বছরের ১২ জুন তেহরানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি)। ওই দিন সংস্থাটির ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি জানিয়ে দেন, আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ না মেনে পরমাণু কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। গত দু’দশকের মধ্যে প্রথম বার সাবেক পারস্য দেশটি এমন কাজ করছে বলেও স্পষ্ট করে আইএইএ। তাঁর ওই মন্তব্য শিয়া মুলুকটিতে ইজ়রায়েলি আক্রমণের রাস্তা খুলে দেয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছা়ড়া জুন মাসে নেতানিয়াহুর যুদ্ধ শুরুর করার নেপথ্যে আরও দু’টি কারণ রয়েছে। ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে রাশিয়া এবং চিনের। পশ্চিম এশিয়ার সংঘাতে এই দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর পা পড়লে পরিস্থিতি যে অনেকটাই ঘোরালো হয়ে উঠবে, তা ভাল করে জানে ইহুদি ফৌজ। কিন্তু, গত তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছে মস্কো। সেখানে অনেকটাই শক্তিক্ষয় হয়েছে ক্রেমলিনের। তা ছাড়া এখনও আমেরিকার ইউরোপীয় শক্তিজোট নেটোর আক্রমণের ভয় পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়ার এ-হেন বাধ্যবাধকতা সিরিয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট লক্ষ করেছে ইজ়রায়েল। গত বছর বিদ্রোহীরা দামাস্কাস দখল করলে ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার অল-আসাদের সমর্থনে খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ্যে আসতে পারেনি মস্কো। নিন্দকদের দাবি, ক্রেমলিনের ভরসাতেই পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে লম্বা সময় ধরে রাজপাট চালাচ্ছিলেন তিনি। অতীতে বহু বার বিপদের সময়ে তাঁর গদি বাঁচাতে বিদ্রোহীদের উপর বোমাবর্ষণও করতে দেখা গিয়েছে রুশ বায়ুসেনাকে।
কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে পূর্ণ শক্তি নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে ঝাঁপিয়েছেন পুতিন। বিদ্রোহীরা দামাস্কাস দখল করলে বাশারকে অবশ্য রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেনি মস্কো। পাশাপাশি, সিরিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলি রক্ষা করতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া চালাচ্ছে ক্রেমলিন। পূর্ব ইউরোপের ‘সুপার পাওয়ার’-এর এই ‘শরীরী ভাষা’য় সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল ইজ়রায়েল। ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ শুরু করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে তারা।
ইহুদিদের এই চিন্তাভাবনা যে মোটেই অমূলক নয়, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মন্তব্যে মিলেছে তার ইঙ্গিত। সংবাদ সংস্থা ‘বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ জুন সেন্ট পিটার্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক ফোরামে গিয়ে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের প্রসঙ্গে মুখ খোলেন তিনি। বলেন, ‘‘এই সংঘাতে আমরা কোথাও নেই। এ ক্ষেত্রে মস্কো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতেও অনিচ্ছুক। শুধু কিছু পরামর্শ দিতে চাইছি।’’ তেহরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করার ফল ভয়াবহ হতে পারে বলে অবশ্য বিবৃতিতে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
একই কথা চিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইরানে ইজ়রায়েলি হামলার কড়া নিন্দা করেছে বেজিং। সূত্রের খবর, তলে তলে ‘বন্ধু’ তেহরানকে হাতিয়ার দিয়ে সাহায্যও করেছেন ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। ট্রাম্প জমানায় আমেরিকার সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে জড়িয়ে যথেষ্ট আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছে চিন। বর্তমানে সেই ফাটল মেরামতির দিকে নজর রয়েছে জিনপিং সরকারের।
দ্বিতীয়ত, বেজিঙের মূল লক্ষ্য হল ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। দীর্ঘ দিন ধরে তাইওয়ানকে কব্জা করার স্বপ্ন দেখে আসছে ড্রাগন সরকার। সেখান থেকে নজর সরিয়ে চিন যে তার ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-কে পশ্চিম এশিয়ার আরবের মরুভূমিতে যুদ্ধ করতে পাঠাবে না, তা ভাল করে জানত ইজ়রায়েল। সেই কারণে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই মুখোমুখি সংঘাতে নামতে দেরি করেনি তারা।
তবে ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে জুনকে ‘যুদ্ধের মাস’ বলা যেতে পারে। ১৮১২ সালের ২৮ জুন মস্কোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সূচনা করেন কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ওই ঘটনার ১২৯ বছর পর ১৯৪১ সালের ২২ জুন রাশিয়া আক্রমণ করে অ্যাডল্ফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি জার্মানি। সামরিক অভিযানটির পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারোসা’।
পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে প্রথমে ইজ়রায়েল এবং তার পর আমেরিকার প্রবেশ হলেও দমে যায়নি ইরান। ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩’-এর মাধ্যমে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানাচ্ছে খামেনেইয়ের শিয়া ফৌজ। জুনে শুরু করা যুদ্ধে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল নেপোলিয়ন এবং হিটলারকে। এর জেরে পরবর্তী কালে পতন হয় তাঁদের। সাবেক পারস্য দেশে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়।