Fly Breeding

দু’সপ্তাহে আস্ত মোষ সাবাড়! মাংসাশী পোকার বংশ ধ্বংসে যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েক কোটি ‘মাছি-সৈন্য’ নামাচ্ছে আমেরিকা

কথায় আছে, বিষে বিষে বিষক্ষয়। সেই তত্ত্ব মেনে মাংসাশী পোকার বংশ নির্মূল করতে ফের উদ্যোগী মার্কিন কৃষি দফতর। এর জন্য কয়েক কোটি ‘মাছি-সৈন্য’কে এয়ারড্রপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫২
Share:
০১ ১৯

মাংসাশী পোকার উৎপাতে নাজেহাল দশা। তাদের আক্রমণে প্রাণ যাচ্ছে গৃহপালিত পোষ্য থেকে বনের প্রাণীর। শুধু তা-ই নয়, বিষাক্ত পোকার অত্যাচারে আতঙ্কিত আমজনতাও। এই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটির ভরসা ‘প্রশিক্ষিত’ মাছি। শুধু তা-ই নয়, দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের মতো এ বার ওই পতঙ্গবাহিনীকে রণক্ষেত্রে ‘এয়ারড্রপ’ করার পরিকল্পনা নিচ্ছে সেখানকার কৃষি বিভাগ।

০২ ১৯

বিপদের নাম নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্ম মাছির মাংসভুক লার্ভা। তাদের আক্রমণে আতান্তরে পড়েছে আমেরিকা। পরিস্থিতি এমন যে, রাতারাতি শিকেয় উঠতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের গোমাংস ব্যবসা। আর তাই কোমর বেঁধে আসরে নামতে হয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগকে। সংশ্লিষ্ট প্রজাতির পুরুষ মাছির প্রজনন শুরু করছে তারা।

Advertisement
০৩ ১৯

সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ক্রুওয়ার্মের মাংসভুক লার্ভার থেকে বাঁচতে সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন আমেরিকার কৃষি বিভাগের পদস্থ আধিকারিকেরা। বিমান থেকে কোটি কোটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মাছিকে মেস্কিকো এবং দক্ষিণ টেক্সাসের আকাশে ছেড়ে দেবেন তাঁরা। আর তাতেই ঘুরে যাবে খেলা। সেই কারণে চলছে ওই মাছির দ্রুত প্রজনন।

০৪ ১৯

স্ক্রুওয়ার্ম প্রজাতির পুরুষ মাছির একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা সঙ্গমে লিপ্ত হলে স্ত্রী মাছিদের পাড়া ডিম আর নিষিক্ত হয় না। অর্থাৎ, ডিম ফুটে লার্ভার জন্মানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই। সেই কারণে এই পদ্ধতিতে স্ক্রুওয়ার্মের লার্ভা কমাতে চাইছেন মার্কিন কৃষি আধিকারিকেরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। লার্ভা নষ্টের পাশাপাশি ভবিষ্যতে কমবে ওই মাছির সংখ্যা।

০৫ ১৯

এই পদ্ধতি যে আমেরিকা প্রথম বার নিচ্ছে, এমনটা নয়। কয়েক দশক আগে পানামায় বিষাক্ত কীটপতঙ্গ নির্মূল করতে এমনই ফন্দি এঁটেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। এর জন্য দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশে জীবাণুমুক্ত মাছির প্রজনন ও প্রতিপালনের জন্য একটি কারখানা খোলে ওয়াশিংটন। গত বছরের শেষ দিকে মেক্সিকোয় ফের স্ক্রুওয়ার্মের লার্ভার উপদ্রব শুরু হওয়ায় সেখানে পুরনো দাওয়াই প্রয়োগের নীলনকশা ছকে ফেলেছে আমেরিকার কৃষি বিভাগ।

০৬ ১৯

মার্কিন কৃষি বিভাগের এ-হেন সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তথা পশুপালনে পরজীবীর গবেষক এডউইন বার্গেস। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যতিক্রমী হলেও এটা খুব ভাল প্রযুক্তি। কারণ, লার্ভা নষ্ট করার একমাত্র উপায় হল বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ। কিন্তু তাতে পরিবেশ এবং মানুষের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। রাসায়নিক যুক্ত গোমাংস পেটে গেলে রোগভোগ যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।’’

০৭ ১৯

মার্কিন কৃষি দফতর জানিয়েছে, আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে দক্ষিণ মেক্সিকোয় স্ক্রুওয়ার্ম মাছির প্রজননের একটি কারখানা চালু করা যাবে। দক্ষিণ টেক্সাসে মাছি বিতাড়নকেন্দ্র খুলতে লেগে যাবে আরও কয়েক মাস। ২০২৬ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের আগে সেটা সম্ভব নয়। সেই কারণে পানামার পুরনো প্রজননকেন্দ্র থেকে পুরুষ মাছি আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

০৮ ১৯

পতঙ্গবিদদের দাবি, একটা সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকায় স্ক্রুওয়ার্ম মাছির দাপট ছিল প্রবল। মৃত মাংস খেয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এদের লার্ভা। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, মেক্সিকোয় যে ভাবে স্ক্রুওয়ার্ম ফিরে এসেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের গোমাংসের ব্যবসা লাটে উঠতে পারে। এই প্রজাতির স্ত্রী মাছিরা সাধারণত কোনও ক্ষতস্থান বা শ্লেষ্মার (পড়ুন মিউকাস) জায়গায় ডিম পাড়ে।

০৯ ১৯

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন আমেরিকার ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি মাইকেল বেইলি। তাঁর দাবি, ‘‘স্ক্রুওয়ার্মের লার্ভার জন্য দু’সপ্তাহের মধ্যে এক হাজার পাউন্ডের একটা গরু মারা যেতে পারে। এতটাই দ্রুত মাংস খাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এদের।’’

১০ ১৯

এ ব্যাপারে দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন খামারে পশু প্রতিপালনের সঙ্গে যুক্ত ডন হাইনম্যান। তিনি বলেন, ‘‘লার্ভাগুলি এতটাই বিষাক্ত যে, সেগুলি দেহে বাসা বাঁধলে প্রথমেই গৃহপালিত প্রাণী পঙ্গু হয়ে পড়ে। তার পর শরীর থেকে বার হতে থাকে পচা মাংসের মতো দুর্গন্ধ। এর পরই ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ওই প্রাণী। পশু চিকিৎসকদের পক্ষে তাদের বাঁচানো বেশ কঠিন।’’

১১ ১৯

পতঙ্গবিদেরা জানিয়েছেন, গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় দিব্যি মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারে নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্ম মাছি। তবে প্রবল ঠান্ডায় এই মাছির টিকে থাকা অসম্ভব। বিভিন্ন সময়ে এদের আক্রমণে নাজেহাল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটা ঠেকাতে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে ৯,৮০০ কোটি জীবাণুমুক্ত মাছির প্রজনন করে আমেরিকার কৃষি বিভাগ। এর পর পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেগুলিকে সুনির্দিষ্ট জায়গায় ছাড়াও হয়েছিল।

১২ ১৯

অধ্যাপক বার্গেস জানিয়েছেন, জীবাণুমুক্ত মাছি-যোদ্ধাদের কাজে নামানোর আগে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। তাদের সংখ্যা যেন কয়েক কোটি হয়, যাতে স্ত্রী মাছিরা আমাদের পাঠানো পুরুষগুলোর সঙ্গে বাধ্য হয়ে সঙ্গম করে। স্ক্রুওয়ার্মের আর একটি জৈবিক বৈশিষ্ট্য হল, স্ত্রী মাছিগুলি জীবনে এক বারই সঙ্গমে লিপ্ত হতে পারে।

১৩ ১৯

বিপদের বিষয় হল, স্ত্রী স্ক্রুওয়ার্ম মাছি যে কোনও উষ্ণ রক্তের প্রাণীর ক্ষতস্থানে ডিম পাড়ে। সেই তালিকায় রয়েছে মানুষও। সেই কারণেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন মার্কিন কৃষি বিভাগ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, একটা সময়ে ফ্লোরিডা এবং টেক্সাসে জীবাণুমুক্ত পুরুষ মাছি প্রজননের দু’টি কেন্দ্র ছিল। কিন্তু, পোকামাকড় নির্মূল হয়ে যাওয়ায় সেগুলিকে বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।

১৪ ১৯

বর্তমানে পানামার কারখানায় সপ্তাহে ১১ কোটি ৭০ লক্ষ জীবাণুমুক্ত মাছির প্রজনন করতে পারে মার্কিন সরকার। কিন্তু, আমেরিকার কৃষি দফতর ৪০ কোটি মাছির প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র খুলতে চাইছে। এর জন্য টেক্সাস এবং দক্ষিণ মেক্সিকোয় নতুন কারখানা খুলতে যথাক্রমে ৮৫ লক্ষ এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ ডলার ব্যয় বরাদ্দ করেছে ওয়াশিংটন।

১৫ ১৯

কানসাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পতঙ্গবিদ অধ্যাপক ক্যাসান্দ্রা ওল্ডস জানিয়েছেন, বিপজ্জনক এই লার্ভার হাত থেকে বাঁচতে মাছিদের একটা বিরাট উপনিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া অন্য রাস্তা খোলা নেই। স্ত্রী মাছিগুলি ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ পেয়েই যাবে। আর শারীরিক পুষ্টির জন্য লার্ভাগুলির মাংস খাওয়া আবশ্যক।

১৬ ১৯

মার্কিন কৃষি বিভাগের পুরনো নথি অনুযায়ী, পানামার কারখানায় মাছি প্রজননের জন্য ঘোড়ার মাংস, মধু এবং শুকনো ডিম ব্যবহার হত। পরে এতে যোগ হয় গুড়। এ ছাড়াও লোহিত রক্তকণিকা এবং গবাদি পশুর প্লাজমার মিশ্রণ ব্যবহার করতেন সেখানকার পতঙ্গবিদেরা।

১৭ ১৯

বনাঞ্চলে সংশ্লিষ্ট লার্ভাগুলি প্রজাপতির কোকুন পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তাদের পোষককে ছেড়ে মাটিতে পড়ে যায়। এর পর একটা প্রতিরক্ষামূলক আবরণের মধ্যে বেড়ে ওঠে ওই মাছি। পানামার প্রজননকেন্দ্রে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে ওই পরিবেশ। এর জন্য কাঠের ট্রে ব্যবহার করছেন সেখানকার পতঙ্গবিদেরা।

১৮ ১৯

তবে সংশ্লিষ্ট জীবাণুমুক্ত মাছিগুলিকে বিমান থেকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা বিপজ্জনক হতে পারে বলে মার্কিন কৃষি বিভাগকে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। চলতি বছরের জুনে এই ধরনের একটি মিশনে গিয়ে গুয়াতেমালা ও মেক্সিকো সীমান্তে ভেঙে পড়ে একটি বিমান। তাতে তিন জন গুরুতর আহত হন। সেই কারণে বিমান থেকে মাছিযুক্ত ক্রেট নীচে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

১৯ ১৯

গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে জীবাণুমুক্ত মাছিদের ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ নামাতে বিশেষ ধরনের একটি কাগজের কাপ ব্যবহার করেছিল মার্কিন কৃষি দফতর। সেগুলিকে বলা হত ‘হুইজ় প্যাকার’। ওই কাপভর্তি মাছি বিমানে তুলতে বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্য নেন তাঁরা। ৫০ এবং ৬০-এর দশকের যুক্তরাষ্ট্রের ওই মিশন ছিল ষোলো আনা সফল। ২১ শতকে ফের পুরনো রণকৌশলে আমেরিকার কৃষি আধিকারিকেরা জয়ী হবেন কি না, তার উত্তর দেবে সময়।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement