কখনও তাইওয়ান। কখনও আবার জাপানের একগুচ্ছ দ্বীপ। একের পর এক এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি তুলে মানচিত্র বদলের চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দিন দিন বাড়ছে ড্রাগনের ‘দৌরাত্ম্য’। শুধু তা-ই নয়, পর্দার আড়ালে থেকে কোরীয় উপদ্বীপের সংঘাতে উস্কানি দেওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই বেজিং। এই ‘আগ্রাসন’ ঠেকাতে কাছাকাছি এসেছে টোকিয়ো, তাইপে এবং সোল। তাদের মাথার উপর আবার আছে মার্কিন সুরক্ষার ছাতা। এতে কতটা নিরাপদ এই তিন রাষ্ট্র? প্রশ্ন তুলছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গত ৮০ বছরে সে ভাবে কোনও রক্তপাত দেখেনি প্রশান্ত মহাসাগর। কিন্তু, ২১ শতকে বেজিঙের নৌশক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ড্রাগনের পাশাপাশি ওই এলাকায় ধূমকেতুর মতো উঠে এসেছে উত্তর কোরিয়া (ডেমোক্রেটিক পিপ্লস রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে)। পিয়ংইয়ঙের বাহিনীর হাতে আছে পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে ঘুম উড়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু দেশগুলির। প্রশ্নের মুখে পড়েছে জাপান, তাইওয়ান (সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপ) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা (রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে)।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জাপানের নিরাপত্তা নিজের কাঁধে তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোয় নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ওয়াশিংটন ও টোকিয়ো। অন্য দিকে, ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হলে মার্কিন সরকারের সঙ্গে একই রকম প্রতিরক্ষা সমঝোতা করে সোল। তাইওয়ানের সঙ্গে অবশ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও সামরিক চুক্তি নেই আমেরিকার। তবে সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপটিকে চিন কব্জা করার চেষ্টা করলে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে এই তিন বন্ধুর সঙ্গে প্রায়ই মহড়ায় গা ঘামাতে দেখা যাচ্ছে মার্কিন ফৌজকে।
কিন্তু এই সব কিছু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। এ ব্যাপারে ফকল্যান্ড যুদ্ধের উদাহরণ দিয়েছেন তাঁরা। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জ বর্তমানে স্বশাসিত এলাকা হলেও তা বাস্তবে রয়েছে ব্রিটেনের কব্জায়। সেখানকার সামরিক এবং বিদেশনীতির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইংরেজ সরকারের। যদিও পাউরুটির আকারের সংশ্লিষ্ট দ্বীপপুঞ্জটিকে দীর্ঘ দিন ধরে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে আসছে আর্জেন্টিনা।
১৯৮২ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ এলাকা হিসাবে পরিচিত ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে বুয়েন্স এয়ারেস সামরিক অভিযান পাঠালে দ্বিপাক্ষিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। পরবর্তী ১০ সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকায় আর্জেন্টিনা এবং ইংরেজ ফৌজের মধ্যে চলে এক অঘোষিত যুদ্ধে। এতে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করে দক্ষিণ আমেরিকার ওই দেশ। তাদের প্রায় ১২ হাজার সৈন্যকে বন্দি করেন ব্রিটিশ সেনা অফিসারেরা। এই সংঘর্ষের সময় অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপের ১২টি দেশ নিয়ে একটি সামরিক সংগঠন গড়ে তোলে আমেরিকা, যার পোশাকি নাম নেটো। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৩২। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, এই গোষ্ঠীর কেউ অন্য কোনও দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে, নেটো-ভুক্ত সকলে তা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে। এর ফলশ্রুতিতে ৩২টি দেশের সংগঠন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওই শত্রুর উপর।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আর্জেন্টিনার ফৌজ ফকল্যান্ড আক্রমণের সময় নেটোর এই নিয়ম কার্যকর হয়নি। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ পরিচালনায় বাধ্য হন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। নেটো-ভুক্ত অধিকাংশ দেশের যুক্তি ছিল সমস্যাটি দ্বিপাক্ষিক। আর তাই বুয়েন্স এয়ারেসের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় জড়াতে রাজি নয় তারা।
দ্বিতীয়ত, আর্জেন্টিনার সামরিক অভিযান ছিল ফকল্যান্ড-কেন্দ্রিক। মূল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে যার দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার। আর তাই সংশ্লিষ্ট আগ্রাসনটিকে আদৌ আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্রের উপর আক্রমণ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল নেটোর সদস্যরা। শুধু তা-ই নয়, এই সংগঠনের অন্যতম সদস্য ফ্রান্স সংঘাতের মুখে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিকে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র এবং গোলা-বারুদ দিয়ে সাহায্যও করেছিল।
যদিও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আর্জেন্টিনাকে যাবতীয় সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে ফ্রান্স। এ ছাড়া সংঘর্ষের সময় ওয়াশিংটনের থেকে নানা ধরনের সাহায্য পেয়েছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনী। তবে ফকল্যান্ড যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি আমেরিকা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির থেকে দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল তৎকালীন মার্কিন সরকার। এ ভাবে দক্ষিণ আটলান্টিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবেশ আটকাতে সমর্থ হয় তারা।
বিশ্লেষকদের দাবি, চিন বা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংঘাতের সময় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। কারণ, ইতিমধ্যেই টোকিয়ো এবং সোলের সঙ্গে সামরিক সমঝোতাগুলি মেনে চলার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ওই মন্তব্যের পর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’।
তাই ফকল্যান্ড যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের নিজস্ব ফাঁকফোকর মেরামতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। তাঁদের কথায়, এ ব্যাপারে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে লজিস্টিক হাব শক্তিশালী করার দিকে নজর দিতে হবে। যুদ্ধের সময় অত্যাধুনিক হাতিয়ার থেকে গোলা-বারুদ ও রসদ মজুতের মাধ্যমে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিয়ে থাকে এই ধরনের হাব, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ফকল্যান্ড সংঘাত চলাকালীন ওয়াশিংটনের লজিস্টিক হাব ব্যবহারের পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি। ফলে দ্রুত ওই দ্বীপপুঞ্জ পুনর্দখল করতে তাদের তেমন কষ্ট হয়নি। বিশ্লেষকদের কথায়, এ ক্ষেত্রে ইয়োকোহামা এবং কোবের মতো বন্দরকে মার্কিন ফৌজের লজিস্টিক হাব হিসাবে গড় তোলার পরিকল্পনা করতে পারে জাপান। সেটা হলে শুধুমাত্র গুয়াম, ওকিনাওয়া এবং বুসানের উপর নির্ভর করতে হবে না আমেরিকার বাহিনীকে।
দ্বিতীয়ত, আধুনিক যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স) ব্যবস্থার সঠিক মোতায়েন প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ১৯৫০-’৫৩ সালের মধ্যে কোরীয় উপদ্বীপের সংঘাতে জাপানি বন্দরগুলিকে ট্রান্সজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন আছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ সাফল্যের তৃতীয় কারণ হল গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের জাতীয় সুরক্ষায় ওই ধরনের ‘রিয়্যাল টাইম ইনফরমেশন’ দেওয়া-নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। এর জন্য ওসান বিমানঘাঁটি, ইয়োকোটা বিমানঘাঁটি এবং হাওয়াইয়ের মার্কিন সামরিক ছাউনির মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক ফিউশন সেল তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে চিনা নৌবাহিনীর উপর কড়া নজর রাখতে পারবে টোকিয়ো, সোল এবং তাইপে।
চিনা আগ্রাসনের জেরে লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ চললে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির মজুত দ্রুত শেষ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আর তাই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির হাতিয়ার নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি শত্রু সেনাকে ঠেকিয়ে রাখতে আগাম কিছু সমরাস্ত্র মজুত রাখার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বিশেষ কয়েকটি হাতিয়ারের কথা বলেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। সেই তালিকায় থাকছে লড়াকু জেটের এইম-১২০ ও এইম-৯এক্স আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র, প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রণতরী ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র এবং আত্মঘাতী ড্রোন। এগুলি সবই যুক্তরাষ্ট্রে থেকে কিনে আগাম মজুতের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ চলাকালীন গোপনে ব্রিটেনকে সাহায্য জুগিয়েছিল আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী দেশ চিলি। এর জেরে পরবর্তী কালে দক্ষিণ আমেরিকার এই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকায় দেখা যেতে পারে সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স এবং অস্ট্রেলিয়াকে।
এ ছাড়া আসন্ন সংঘাতে সবচেয়ে ‘বড় খেলোয়াড়’ হিসাবে ভারতকে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকেরা। ট্রাম্প জমানায় নয়াদিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের সূচক কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়ায় দূতাবাস খোলার কথা ঘোষণা করে বিদেশ মন্ত্রক। যদিও জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। এই পরিস্থিতিতে কোথাকার জল কোথায় গড়ায় সেটাই এখন দেখার।