চিনের নাকের ডগায় মার্কিন বিষফোড়া! বেজিঙের রক্তচাপ বাড়িয়ে তাইল্যান্ডে (আগে নাম ছিল শ্যামদেশ) সেনাঘাঁটি বানাতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই উত্তাল হয়েছে ব্যাঙ্ককের রাজনীতি। সেখানকার বিরোধী দলগুলির দাবি, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ফাং নাগা নৌছাউনিতে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে তৎপর হচ্ছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের শুল্ক-বাণ থেকে বাঁচতে এ ব্যাপারে তাইল্যান্ডের সরকার সবুজ সঙ্কেত দিতে চলেছে বলে তীব্র হয়েছে জল্পনা।
গত শতাব্দীর ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে ব্যাঙ্ককের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে ওয়াশিংটন। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করতে তাইল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন মার্কিন নৌসেনা অফিসারেরা। আর তাই ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে আমেরিকার সেনাঘাঁটি ছিল সাতটি।
যুদ্ধের সময়ে ভিয়েতনামের উপর বোমাবর্ষণ করতে তাই সামরিক ঘাঁটিগুলিকে ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ। কিন্তু, পরবর্তী কালে দেশের মধ্যে মার্কিন সেনার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয় ব্যাঙ্ককের রাজনীতি। ফলে ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় ওয়াশিংটন। ১৯৭০-এর দশকে পা দেওয়ার প্রাক্-মুহূর্তে তা শুরু করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন।
১৯৬৯ সালে তাইল্যান্ডে মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৩০০। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় সেটাই কমে নেমে আসে ২৭ হাজারে। ঠিক তার পরের বছর পুরোপুরি ভাবে বিদেশি সৈনিক মুক্ত হয় ব্যাঙ্কক। যদিও তাইল্যান্ডের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক কখনওই ত্যাগ করেনি আমেরিকা। এখনও যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয় দুই দেশের ফৌজ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আমেরিকা শেষ পর্যন্ত তাইল্যান্ডে পাকাপাকি ভাবে সেনাছাউনি তৈরির অনুমতি পেলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মার্কিন-চিন সংঘাত যে তীব্র হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ব্যাঙ্কককে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে। সেখান থেকে দক্ষিণ চিনের ইউনান, গুয়াংজি, গুয়াংডং এবং জিনজিয়াং প্রদেশগুলিকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে নিশানা করা যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজের কাছে একেবারেই কঠিন নয়।
গত কয়েক বছরে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ক্রমাগত নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে চিন। শুধু তা-ই নয়, আকারের নিরিখে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা বিশ্বের সর্ববৃহৎ। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ওই এলাকায় আনাগোনা বেড়েছে রুশ ডুবোজাহাজের। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই সমস্ত কারণে তাইল্যান্ডের কৌশলগত এলাকায় সামরিক ছাউনি তৈরি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পেন্টাগন।
বিরাট এই সামুদ্রিক এলাকায় আমেরিকার কোনও নৌঘাঁটি নেই, তা ভাবলে ভুল হবে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গুয়াম এবং পার্ল হারবারের মতো শক্তিশালী নৌছাউনি রয়েছে পেন্টাগনের হাতে। এ ছাড়া ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপপুঞ্জেও একটি সেনাঘাঁটি রয়েছে আমেরিকার। কিন্তু, অবস্থানগত দিক থেকে এগুলি চিনের উপকূল থেকে অনেকটাই দূরে। ফলে সংঘাতের সময়ে পিএলএ নৌসেনা এই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ঢোকা বন্ধ করলে বিপাকে পড়বে ওয়াশিংটন। আর তাই তাইল্যান্ডে ঘাঁটি গাড়তে চাইছে তারা।
বর্তমানে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ রয়েছে আমেরিকা। ওই সমঝোতা অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশটির কিছু এলাকাকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছে মার্কিন নৌসেনা। কিন্তু, এতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা ছাড়া চুক্তিটির পুনর্নবীকরণ হওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ ও প্রতিরক্ষা দফতর যথেষ্ট সন্দিহান। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সেই কারণেই বিকল্প হিসাবে ব্যাঙ্কককে ‘দলে টানার চেষ্টা’ করছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, ব্যাঙ্ককের ফাং নাগা এলাকায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে সিঙ্গাপুর মডেল অনুসরণ করতে পারে আমেরিকা। যৌথ সেনাছাউনি নির্মাণের নামে নিঃশব্দে সেখানে পা জমানোর পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে সরাসরি প্রতিরক্ষা চুক্তি এড়িয়ে কাজ হাসিল করতে সক্ষম হবে মার্কিন সরকার। এ ব্যাপারে তাই প্রশাসনের স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে অবশ্য দুই দেশের মধ্যে কোনও সামরিক সমঝোতা নেই।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে ১৯৫৪ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা সিয়াটো। আট দেশের সংশ্লিষ্ট সামরিক সমঝোতায় সই হয় ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায়। এর সদর দফতর ছিল তাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে। কিন্তু, ১৯৭৭ সালে সিয়াটো গুরুত্বহীন হয়ে গেলে ওই এলাকায় অনেকটাই কমে যায় মার্কিন প্রভাব। পরবর্তী কালে ২০১২ এবং ২০২০ সালে তাইল্যান্ডের সঙ্গে ‘কৌশলগত বন্ধুত্ব’ নিয়ে একাধিক বিবৃতি দেয় ওয়াশিংটন। যদিও সংঘাত পরিস্থিতিতে একে অপরকে সাহায্য করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তাইল্যান্ড। এই পরিস্থিতিতে দেশের ভিতরে মার্কিন নৌসেনাঘাঁটি তৈরি হলে ফৌজের যে শক্তিবৃদ্ধি হবে, তা ভালই জানে ব্যাঙ্কক। দ্বিতীয়ত, তাদের পণ্যের উপরে ৩৬ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সূত্রের খবর, ওয়াশিংটনের লবিস্টদের পিছনে ৯ কোটি ৭০ লক্ষ ভাট (২৯ লক্ষ ৯০ হাজার ডলার) খরচ করেও এই অঙ্ক কমাতে পারেনি তাই প্রশাসন। সেই কারণে সামরিক ঘাঁটি তৈরির অনুমতি দিয়ে আর্থিক সঙ্কট এড়াতে চাইছে ব্যাঙ্কক।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা থেকে বছরে দু’কোটি মেট্রিক টন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য ২০ বছরের চুক্তি করেছে তাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা পিটিটি গ্রুপ। ব্যাঙ্ককের আশঙ্কা, আমেরিকাকে সামরিক ঘাঁটি তৈরির ব্যাপারে সরাসরি ‘না’ বললে, তার প্রভাবে বাতিল হতে পারে এই চুক্তি। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি সঙ্কটের মুখে পড়বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশ।
তবে সেনাঘাঁটি নির্মাণের ব্যাপারে আমেরিকাকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাইল্যান্ডের সামনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। ব্যাঙ্ককের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, এর জেরে দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর মাঝে পড়ে তাদের অবস্থা হবে ইউক্রেনের মতো। কারণ, ফাং নাগায় আমেরিকা সেনাছাউনি তৈরি করলে চুপ করে বসে থাকবে না চিন। বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’র রোষের মুখে পড়তে হবে তাদের।
গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব ইউরোপে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তাতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে কিভকে। ইউক্রেনের একের পর এক শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে মস্কোর বায়ুসেনা। পাশাপাশি, পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির বেশ কিছুটা জমির দখল নিয়েছে ক্রেমলিন। এই সংঘাতের অন্যতম কারণ হল ইউক্রেনের মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’ বা নেটোর (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা) সদস্যপদ পেতে চাওয়ার ইচ্ছা। এর ফলে জাতীয় সুরক্ষা প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মনে করেছে রাশিয়া।
তৃতীয়ত, পর্যটনশিল্পের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম তাইল্যান্ডের ফাং নাগা এলাকাটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এর আশপাশে প্রচুর পরিমাণে রিসর্ট ও হোটেল গড়ে উঠেছে। ওই এলাকায় মার্কিন নৌসেনাঘাঁটি তৈরি হলে সেগুলিকে দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এতে আর্থিক দিক থেকে ব্যাঙ্ককের বিরাট লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে ‘জোট নিরপেক্ষ’ দেশ হিসাবে তাইল্যান্ডের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এই অবস্থায় আমেরিকাকে সেনাছাউনি করতে দিলে ব্যাঙ্ককের সেই বিদেশনীতিতে আসবে বড় বদল। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী কম্বোডিয়ায় ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে চিনা পিএলএ। বেজিঙের বিপুল হাতিয়ার হাতে এলে সীমান্তে আরও আগ্রাসী হতে পারে নম পেন। তাই মার্কিন ‘অনুপ্রবেশ’ রুখতে এখন থেকেই সুর চড়াতে শুরু করেছে তাইল্যান্ডের বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা।
সূত্রের খবর, এর আগে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সেনাঘাঁটি তৈরি করতে চেয়ে ব্যর্থ হয় আমেরিকা। কিন্তু, দু’টি জায়গাতেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। এ ব্যাপারে প্রথমে ইসলামাবাদের কথা বলা যেতে পারে। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছে আফগানিস্তান সীমান্তে ড্রোন ছাউনি তৈরির অনুমতি চায় যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইয়ের নেতা এ ব্যাপারে রাজি না হওয়ায় তিন-চার মাসের মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাবে পতন হয় তাঁর সরকারের।
শুধু তা-ই নয়, এর পর আর্থিক তছরুপের অভিযোগে জেলবন্দি হয় ইরমান। দু’বছরের বেশি সময় ধরে গারদের পিছনেই রয়েছেন তিনি। সূত্রের খবর, বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি নৌঘাঁটি তৈরি করতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে রাজি হননি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এর পরই প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। দেশের শাসনভার চলে যায় প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। যদিও সেন্ট মার্টিনে ছাউনি তৈরির স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের।
এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন ভারপ্রাপ্ত তাই প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও বিদেশি শক্তিকে সামরিক ছাউনি তৈরির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে বিরোধীরা। আর সেটা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।’’ ব্যাঙ্ককের নৌসেনাও জানিয়েছে, আমেরিকাকে সেনাছাউনি নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে তার পরেও জল্পনা বন্ধ হওয়ায় এই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।