US China Conflict in Myanmar

মায়ানমারে ‘ছায়াযুদ্ধের’ প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা? ড্রাগনকে হারানোর ‘খুনি ষড়যন্ত্রে’ অশান্ত হবে উত্তর-পূর্ব ভারত?

ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনের প্রবেশ আটকাতে মায়ানমারের উপর থেকে বেজিঙের প্রভাব কমাতে চাইছে আমেরিকা। এর জন্য সাবেক বর্মা মুলুকে ‘ছায়াযুদ্ধের’ প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী, খবর সূত্রের।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৫ ০৮:০১
Share:
০১ ১৯

ইরাবতীর তীর থেকে চিনকে উৎখাত করতে মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই লক্ষ্যে এ বার ‘ছায়াযুদ্ধের’ পুরনো কৌশল নিতে চলেছে ওয়াশিংটন? সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সেখানে তৎপরতা বাড়িয়েছে আমেরিকার গুপ্তচর বাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। এতে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে দেখা দিতে পারে চরম অস্থিরতা। বিষয়টি জানাজানি হতেই নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

০২ ১৯

ভারতের পূর্বের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে (আগে নাম ছিল বর্মা) এ হেন মার্কিন ‘ষড়যন্ত্রের’ খবর ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনাম দখল করে নিয়েছে। তাদের দাবি, ইয়াঙ্গনের (সাবেক রেঙ্গুন) জুন্টা সেনা সরকারের সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওয়াশিংটন। সেখানে নৌসেনা ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ড্রাগনের প্রবেশ বন্ধ করতে চাইছে আমেরিকা।

Advertisement
০৩ ১৯

২০২১ সালে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সাবেক বর্মা মুলুকের কুর্সি দখল করে সেখানকার সেনাবাহিনী। এর পরই ফৌজি অফিসারদের নিয়ে গঠিত কমিটির হাতে চলে যায় দেশের শাসনভার। স্পেনীয় ভাষায় একেই বলে জুন্টা। এই সামরিক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধের আগুনে গত চার বছর ধরে পুড়ছে আরাকানভূমি। আর এই অশান্তির সুযোগ নিয়েই সেখানে নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে চিন। উদ্দেশ্য, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রভাব বিস্তার।

০৪ ১৯

মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে স্থানীয় বর্মী ভাষায় বলা হয় ‘তাতমাদো’। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে ড্রাগন। কারণ ইরাবতীর তীরের দেশটিতে বেজিঙের লগ্নি নেহাত কম নয়। সেখানে তৈরি হচ্ছে ‘চিন মায়ানমার অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিএমইসি (চায়না মায়ানমার ইকোনমিক করিডোর)। নির্মীয়মাণ এই রাস্তার সাহায্যে একেবারে বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে চিনা লালফৌজের।

০৫ ১৯

উন্নয়নের নামে বেজিঙের এই আগ্রাসী মনোভাব টের পাওয়া ইস্তক বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছে আমেরিকা। ছলে-বলে-কৌশলে ড্রাগনের বঙ্গোপসাগরে আসার রাস্তা বন্ধ করতে চাইছে ওয়াশিংটন। সেই কারণে ‘তাতমাদো’কে পুরোপুরি ধ্বংসের পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন প্রশাসনের। বাহিনী সরে গেলে জুন্টা সরকার যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে তা ভালই জানে ওয়াশিংটন। তখন সেখানে ‘পুতুল সরকার’ বসিয়ে সহজেই কাজ হাসিল করতে পারবে তারা।

০৬ ১৯

সূত্রের খবর, সাবেক বর্মা মুলুকে ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে গত বছর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল। তাতে ছিলেন বিদেশ দফতর, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, ইয়াঙ্গনের দূতাবাসের পদস্থ আধিকারিকেরা। এ ছাড়াও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ডেপুটি কমান্ডার পদমর্যার এক ফৌজি অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু, আমেরিকার ওই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দেন হাসিনা।

০৭ ১৯

এর কয়েক মাসের মধ্যেই নাটকীয় ভাবে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে, যার তারিখটা ছিল ৫ অগস্ট, ২০২৪। ফলে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন হাসিনা। বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল মার্কিন গুপ্তচরদের হাত। হাসিনা-বিরোধীদের একরকম তাঁর পিছনে লেলিয়ে দেয় সিআইএ। মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ দিয়ে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশের জমি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে আমেরিকার।

০৮ ১৯

সাবেক বর্মা মুলুকের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আরাকান আর্মি, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি অন্যতম। ‘তাতমাদো’কে খতম করতে প্রাথমিক ভাবে তাঁদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আমেরিকা এগোচ্ছে বলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলিতে দাবি করা হয়েছে।

০৯ ১৯

সূত্রের খবর, কক্স বাজারের কাছে ড্রোন ঘাঁটি তৈরিতে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চায় আমেরিকা। সেখান থেকে ‘তাতমাদো’র উপরে মানববিহীন যানের হামলা পরিচালনা করতে চাইছে ওয়াশিংটন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন প্রদেশটির অধিকাংশ এলাকা বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে। ফলে জুন্টার বিমানবাহিনীর সেখানে প্রত্যাঘাত শানানোর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণে রাখাইনকে ‘নো ফ্লাইং জ়োনে’ রূপান্তরিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

১০ ১৯

কিন্তু, এর জন্য মার্কিন বিমানবাহী রণতরীকে বঙ্গোসাগরে মোতায়েন করতে হবে। গত কয়েক মাসে ওই এলাকায় আমেরিকার ছোট ছোট যুদ্ধজাহাজগুলির আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের কয়েকটি মায়ানমার উপকূলের খুব কাছে টহল দিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। এগুলির মাধ্যমেও ‘ছায়াযুদ্ধের’ জন্য সাবেক বর্মা মুলুকের বিদ্রোহীদের হাতে হাতিয়ার ও গোলাবারুদ পৌঁছে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী।

১১ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, তাইল্যান্ডের গোপন আস্তানা থেকে মায়ানমারের জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত গৃহযুদ্ধে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এই কাজে ব্রিটেন-সহ একাধিক পশ্চিমি শক্তিকে পাশে পেয়েছে মার্কিন গুপ্তচরেরা। সূত্রের খবর, চলতি বছরের গোড়ায় সাবেক বর্মা মুলুকের চিনল্যান্ড প্রদেশে প্রবেশ করে ভাড়াটে সেনার দল। সেখানকার বিদ্রোহীদের তাঁরা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলেও গোয়েন্দা রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে।

১২ ১৯

চিনের ইউনান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে সিএমইসির কাজ মায়ানমারের পশ্চিম উপকূল কিয়াকপিউ বন্দরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট বন্দরটির দখল নেবে বেজিঙের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর নৌবাহিনী। তখন ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় আসার বিকল্প রাস্তা পেয়ে যাবে ড্রাগন ফৌজ। এ কাজে তাদের বাধা দিতে সাবেক বর্মা মুলুককে একাধিক ছোট ছোট রাষ্ট্রে ভেঙে ফেলতে চাইছে আমেরিকা, মত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের।

১৩ ১৯

সম্প্রতি মায়ানমারের ‘ছায়াযুদ্ধে’ বাংলাদেশকে পাশে পেতে ঢাকাকে বড় প্রতিশ্রুতি দেয় মার্কিন সরকার। ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে রাখাইন প্রদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘মানবিক করিডর’ তৈরির আশ্বাস দিয়েছে ওয়াশিংটন। গৃহযুদ্ধের সময় জুন্টা সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার কারণে আরাকান আর্মির নিশানায় চলে আসে বর্মা মুলুকের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। ফলে তাঁদের একাংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

১৪ ১৯

কিন্তু আমেরিকার এই প্রস্তাব মেনে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘মানবিক করিডর’ তৈরি করতে দেওয়া হবে না বলে দাবি তুলেছে সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ। এ ব্যাপারে প্রবল আপত্তি রয়েছে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ়-জামানেরও। তাঁদের দাবি, এতে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

১৫ ১৯

১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করলে প্রমাদ গোনে আমেরিকা। হিন্দুকুশের কোল থেকে মস্কোর বাহিনীকে তাড়াতে সেখানে ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু করে ওয়াশিংটন। এর জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইসলামাবাদের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে মুজাহিদিন বা ধর্মযোদ্ধা নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয় সিআইএ।

১৬ ১৯

ওয়াশিংটনের মদত মেলায় কয়েক বছরের মধ্যেই ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত হয় আফগানিস্তান। ১৯৮৯ সালে আমু দরিয়া পেরিয়ে রুশ ফৌজ ফিরে গেলেও সেই লড়াই থামেনি। পরবর্তী দশকগুলিতে কিছুতেই স্থায়ী সরকার তৈরি করতে পারেনি কাবুল। এর আঁচে পুড়তে হয়েছে ভারতকেও।

১৭ ১৯

আফগানিস্তান থেকে রুশ সেনা সরে যেতেই মুজাহিদিন বা ধর্মযোদ্ধাদের জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার জন্য কাজে লাগাতে শুরু করে পাকিস্তান। ফলে গত শতাব্দীর ’৯০-এর দশক থেকে ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদে বহু বার রক্তাক্ত হয়েছে উপত্যকা। সেই ধারা এখনও চলছে।

১৮ ১৯

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ‘ছায়াযুদ্ধের’ নামে মায়ানমারে আমেরিকা বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার ঢোকালে তার আঁচ লাগবে উত্তর-পূর্ব ভারতের গায়ে। পাশাপাশি, নয়াদিল্লি-বিরোধী সরকার বাংলাদেশ তৈরি হলে সেখানকার পরিস্থিতিও পাকিস্তানের মতো হতে পারে। তখন সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কা থাকবে বাংলা, বিহার বা ওড়িশার মতো রাজ্যেও।

১৯ ১৯

যদিও মায়ানমারে ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু করার ক্ষেত্রে আমেরিকা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, হাসিনা চলে যাওয়ার পরে পদ্মাপারে যে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে, তার উপর বাড়ছে নির্বাচন করানোর চাপ। ভোট না হলে সেখানেও পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। তখন বাংলাদেশের কোনও অংশ ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আরও কঠিন হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement