দক্ষিণ আমেরিকায় (পড়ুন ল্যাটিন আমেরিকা) যুদ্ধের দামামা! মাদক-বিরোধী অভিযানের নামে যে কোনও মূহূর্তে ভেনেজ়ুয়েলা আক্রমণ করতে পারে আমেরিকা। ক্যারিবিয়ান সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর সমরসজ্জায় রণডঙ্কা বাজিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। অন্য দিকে সংঘর্ষের জন্য পাল্টা প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে কারাকাসও। এই আবহে খবরের শিরোনামে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি লড়াকু জেট। সেগুলি হল, এফ-৩৫ লাইটনিং টু এবং এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন। সম্ভাব্য সংঘাতে যা দু’তরফে ব্যবহার হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যম ‘সিএনএন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভেনেজ়ুয়েলার ভিতরে আঘাত হানতে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ লাইটনিং টু-কে কাজে লাগাতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ। সেই লক্ষ্যে লাগাতার মহড়ায় ব্যস্ত রয়েছেন আমেরিকার যোদ্ধা-পাইলটেরা। অন্য দিকে মাঝ-আকাশেই এফ-৩৫কে আটকে দিতে চতুর্থ প্রজন্মের এফ-১৬ নিয়ে প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে কারাকাস। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দু’টি লড়াকু জেটই তৈরি করেছে ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’।
এ-হেন পরিস্থিতিতে ভেনেজ়ুয়েলার বায়ুসেনাকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হুমকির সুরে বলেছেন, ‘‘কারাকাসের কোনও যুদ্ধবিমান যদি আমাদের রণতরীর কাছে আসার চেষ্টা করে, তা হলেই সেগুলিকে গুলি করে নামাবে মার্কিন ফৌজ। বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করার মতো ঝুঁকি আশা করি নেবেন না তাঁরা।’’ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, ট্রাম্প হুঙ্কার ছাড়লেও বিষয়টি মোটেই সহজ নয়। কারণ, ‘লোহা দিয়ে লোহাকে কাটা’র নীতি নিয়েছে উত্তর ল্যাটিন আমেরিকার ওই দেশ।
ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা ‘বিবিসি’ জানিয়েছে, ভেনেজ়ুয়েলার উপকূল সংলগ্ন এলাকায় মার্কিন রণতরী মোতায়েন হতেই নজরদারির জন্য এফ-১৬ লড়াকু জেট ওড়াতে শুরু করে কারাকাস। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দফতরের মূল কার্যালয় পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিদের দাবি, তাঁদের পাঠানো জাহাজগুলির খুব কাছে প্রায়ই ঘোরাঘুরি করছে ওই সমস্ত যুদ্ধবিমান। ফলে ভেনেজ়ুয়েলার তরফে আক্রমণ আসার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। সূত্রের খবর, এই অবস্থায় ক্যারিবিয়ান সাগরে রণতরীর সংখ্যা বাড়াতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।
চতুর্থ প্রজন্মের লড়াকু জেট এফ-১৬-এর যুদ্ধের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৭ সালে থেকে সংশ্লিষ্ট যু্দ্ধবিমানটি ব্যবহার করছে ভেনেজ়ুয়েলার বায়ুসেনা। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম এফ-১৬কে মাঝ-আকাশের যুদ্ধে হারানো বেশ কঠিন। ফলে একে ধ্বংস করতে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হতে পারে মার্কিন ফৌজকে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ক্যারিবিয়ান সাগরে একটি নৌকায় আচমকাই বোমাবর্ষণ করে মার্কিন ফৌজ। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয় ১১ জনের। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ভেনেজ়ুয়েলার সৈকত থেকে রওনা হয়ে সংশ্লিষ্ট নৌকাটি বিপুল পরিমাণে মাদক নিয়ে আমেরিকার উপকূলের দিকে যাচ্ছিল। সেই সময়েই এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান থেকে তাদের উপরে হামলা চালানো হয়েছে। যদিও কারাকাসের কোন মাদক গ্যাং সেটি ব্যবহার করছিল, তা স্পষ্ট হয়নি। ফলে পেন্টাগনের এ-হেন পদক্ষেপ ঘিরে উঠে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, অভিযুক্ত মাদক-নৌকাটিকে অনায়াসেই আটকাতে পারতেন মার্কিন জলযোদ্ধারা। গ্রেফতার করা যেত এর আরোহীদের। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনও সুযোগই দেননি তাঁরা। সংশ্লিষ্ট নৌকায় মাদক ছিল, এটা কী ভাবে বোঝা গেল, তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলিতে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এই ঘটনাকে ভেনেজ়ুয়েলার বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি হিসাবেই দেখছেন সাবেক সেনাকর্তারা। যা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এ প্রসঙ্গে ‘বিবিসি’র করা একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘কোনও ধরনের আগ্রাসী মনোভাব দেখালে উচিত শিক্ষা পাবে কারাকাস। মাদকের বিরুদ্ধে আমরা কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমেরিকার ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দিতে পারি না। ভেনেজ়ুয়েলার মাদক আমাদের জনগণকে হত্যা করবে, সেটা কাম্য নয়।’’
অন্য দিকে ট্রাম্পের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ভেনেজ়ুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। তাঁর কথায়, ‘‘দুই দেশের মতবিরোধ কখনওই সামরিক সংঘাতের রূপ নিতে পারে না। সমস্যা সমাধানে আমরা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে সেখানে আমাদের উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে।’’ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মাদুরোর দাবি মেনে কোনও অবস্থাতেই সেই রাস্তায় হাঁটবে না যুক্তরাষ্ট্র। কারণ কারাকাসের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তাঁকে মানতে নারাজ আমেরিকা।
একাধিক মার্কিন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান সাগরে লড়াকু জেটে নজরদারির পাশাপাশি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে মাদুরোর ফৌজ। এ ছাড়া উপকূল জুড়ে ১৫ হাজার সৈনিকের বিরাট বাহিনীকে তৈরি রেখেছে কারাকাস। প্রাথমিক ভাবে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রে আমেরিকার রণতরীগুলিকে নিশানা করতে পারে তারা। সূত্রের খবর, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের অগ্রগতি আটকাতে সৈকত সংলগ্ন সমুদ্রে বারুদের সুড়ঙ্গ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এর জন্য বিপুল সংখ্যায় ‘ওয়াটার মাইন’ জড়ো করেছে ভেনেজ়ুয়েলার নৌবাহিনী।
এই ব্যারিকেড ভেঙে মার্কিন সৈনিকদের পা ল্যাটিন আমেরিকার দেশটিতে পড়লে গেরিলা যুদ্ধে তাঁদের নাস্তানাবুদ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন কারাকাসের ফৌজি জেনারেলরা। এর জন্য উপকূল এলাকায় লুকোনোর জায়গা খুঁজে বার করা হচ্ছে। সেখানেই মোতায়েন থাকবে ভেনেজ়ুয়েলার ট্যাঙ্কবাহিনী। এ ছাড়া ল্যান্ডমাইন, ছোট কামান এবং মর্টারের বিপুল ব্যবহার করতে পারে তাঁরা। পরিস্থিতি দেখে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, আমেরিকার পক্ষে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে ঢোকা খুব সহজ হবে না।
পেন্টাগনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’ জানিয়েছে, অন্তত সাতটি যুদ্ধজাহাজ এবং একটি পরমাণু ডুবোজাহাজকে দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান সাগর দিয়ে ভেনেজ়ুয়েলার সৈকতের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার নৌবাহিনীর পাশাপাশি ‘অপারেশন কারাকাস’-এ অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলরক্ষীদের রণতরীও। মোট ২,২০০ জন মেরিন কম্যান্ডোর-সহ নৌবাহিনীর মোট সাড়ে চার হাজার যোদ্ধাকে এই মিশনে পাঠিয়েছে আমেরিকা।
‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউএসএস সান আন্তোনিও, ইউএসএস ইও জিমা এবং ইউএসএস ফোর্ট লডারডেলের মতো অত্যাধুনিক রণতরীগুলিকে ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান সাগরে মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূল অভিযানে নামার আগে তথ্য সংগ্রহ করতে পি-৮ গুপ্তচর বিমান ওড়াচ্ছেন মার্কিন নৌসেনা অফিসারেরা। পাশাপাশি পুয়োর্তো রিকোয় ১০টি এফ-৩৫ লড়াকু জেটকে তৈরি রেখেছেন তাঁরা।
কূটনীতিকদের দাবি, মুখে মাদক-বিরোধী অভিযানের কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের মূল নিশানায় রয়েছেন মাদুরো। ২০১৩ সাল থেকে একটানা ভেনেজ়ুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন তিনি। আমেরিকার অভিযোগ, অন্যায় ভাবে কারাকাসের কুর্সি দখলে রেখেছেন নিকোলাস। মাদক-মাফিয়াদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। ফলে নির্বাচনের নামে ল্যাটিন আমেরিকার দেশটিতে চলছে প্রহসন। সম্প্রতি মাদুরোর নামে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে মার্কিন সরকার। তাঁকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ কোটি টাকা ইনাম দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতীয় মুদ্রায় যেটা প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্প-মাদুরো সংঘাত একেবারেই নতুন নয়। ২০১৭-’২১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন ভেনেজ়ুয়েলার কুর্সি থেকে নিকোলাসকে সরানোর কম চেষ্টা করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু নানা কারণে সে বার সফল হননি তিনি। দ্বিতীয় বার শপথ নেওয়ার পর থেকে কারাকাসে সেনা অভিযানের একটি ছুতো খুঁজছিলেন তিনি। মাদক-বিরোধী অভিযানের নামে এ বার সেটা চালাতে পারেন ট্রাম্প।
দুঁদে কূটনীতিকেরা অবশ্য মনে করেন, ভেনেজ়ুয়েলায় রাজনৈতিক পালাবদলের চেষ্টার নেপথ্যে আমেরিকার অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। গত কয়েক বছরে রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেন নিকোলাস মাদুরো। আর তাতেই প্রমাদ গোনে ওয়াশিংটন। মস্কো এবং বেজিংকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসতে দিতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। আর তাই কারাকাসের ডানা ছাঁটতে উঠেপড়ে লেগেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
গত অগস্টে এই ইস্যুতে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিও। তাঁর কথায়, ‘‘অত্যন্ত সন্তর্পণে ভেনেজ়ুয়েলার ভিতরে ঘাঁটি গেড়েছে রাশিয়া ও চিন। ওখানে হামলাকারী ড্রোনের কারখানা তৈরি করতে চলেছে ইরান। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লাকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করছে কারাকাস। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে এগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক।’’
আমেরিকার অভিযোগ, ভেনেজ়ুয়েলায় যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে চিনা গুপ্তচরবাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বড় রকমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে তাঁরা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, এ সব কিছুই ছেঁদো যুক্তি। আসলে কারাকাসের খনিজ তেলের বিপুল ভান্ডার কব্জা করতে চাইছে ওয়াশিংটন। আর তাই মাদক মাফিয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনে প্রহসন এবং মস্কো-বেজিং ষড়যন্ত্রের আষাঢ়ে গল্প সাজাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
গত বছর (পড়ুন ২০২৪) নির্বাচনী প্রচারে নিজের মুখে সে কথা স্বীকারও করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। নর্থ ক্যারোলিনার একটি সভায় দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘আমরা (পড়ুন আমেরিকা) ভেনেজ়ুয়েলার থেকে খনিজ তেল কিনছি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, আমার প্রথম দফার শাসনকালে পতনের মুখে চলে এসেছিল কারাকাস। তখন বাহিনী পাঠিয়ে দেশটা কব্জা করা উচিত ছিল। তা হলেই ওদের তেলের উপরে সম্পূর্ণ অধিকার থাকত আমাদের।’’
বর্তমানে ভেনেজ়ুয়েলার কাছে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম খনিজ তেলের ভান্ডার। ২০১৯ সালে ‘দুনিয়ার জ্বালানি’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে ‘বিপি স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ’ নামের সমীক্ষক সংস্থা জানায়, কারাকাসের মাটির গভীরে সঞ্চিত আছে আনুমানিক ৩,০৩৩ কোটি ব্যারেল ‘তরল সোনা’। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরবের কুয়োগুলিতে জমা আছে ২,৯৭৭ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল। যদিও ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের নিরিখে প্রথম স্থানে আছে রিয়াধ।