যুদ্ধ হলে ‘আগ্রাসী’ চিনকে কতটা শিক্ষা দিতে পারবে মার্কিন ফৌজ? না কি বেজিঙের সামনে পড়ে লেজেগোবরে দশা হবে ওয়াশিংটনের? যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দফতরের (ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার) সদর কার্যালয় পেন্টাগনের এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ফাঁস হতেই আমেরিকা জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই। সেখানে মুখোমুখি সংঘর্ষে ড্রাগনের হাতে বেদম মার খাওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারকে সতর্ক করেছেন আমেরিকার দুঁদে সেনা কমান্ডারেরা।
চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর পেন্টাগনের একটি গোপন রিপোর্ট ফাঁস করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে চিনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন বাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেখানে দু’তরফের তুলনা টানতে গিয়ে ‘ওভারম্যাচ’ (মিল খাচ্ছে না) শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তাঁরা। এককথায় বেজিঙের অত্যাধুনিক ফৌজের কাছে মার্কিন সেনাকে হারতে হতে পারে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে কী ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সুবিধাগুলি চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র সামনে অকেজো হয়ে পড়বে, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি যুদ্ধের মহড়া, সাইবার দক্ষতা এবং মার্কিন গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করে পেন্টাগনের ভিতরের ‘অফিস অফ নেট অ্যাসেসমেন্ট’ নামের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। এতে কারা রয়েছেন, তা অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত পেন্টাগনের গোপন নথিতে মার্কিন কৃত্রিম উপগ্রহ, রণতরী এবং লড়াকু জেট ধ্বংসের চিনা সক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। পাশাপাশি, যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহ শৃঙ্খলের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালেও এই ধরনের একটি রিপোর্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ-র (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) কাছে পাঠায় সাবেক প্রতিরক্ষা দফতর, যা এখন নাম বদলে যুদ্ধ দফতর হয়ে গিয়েছে।
সূত্রের খবর, পেন্টাগন থেকে আসা ‘ওভারম্যাচ’ রিপোর্ট পড়ে ভয় পেয়ে যান বাইডেনের এনএসএ। তড়িঘড়ি সেনা অফিসারদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন তিনি। এ বছরের নভেম্বরে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধসচিব পিট হেগসেথ। মার্কিন ফৌজের একটি মহড়ায় গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা অনেক বিষয়েই পিছিয়ে বা হেরে যাচ্ছি। সেটা হলে চলবে না।’’ সংঘাত পরিস্থিতিতে শত্রুকে যে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেওয়া হবে না, তা স্পষ্ট করেন তিনি।
কোন যুক্তিতে চিনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ মার্কিন ফৌজ? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পেন্টাগনের গোপন রিপোর্টে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, খুব কম খরচে উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন, হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) অস্ত্র এবং সাইবার হাতিয়ার ব্যবহার করছে ড্রাগন পিএলএ। সেখানে আমেরিকার সেনাবাহিনীর অস্ত্রগুলি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। বর্তমানে সেগুলির উৎপাদনও হচ্ছে যথেষ্ট ধীর গতিতে।
২০২২ সালে মার্কিন নৌসেনার বহরে যুক্ত হয় বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস জ়েরাল্ড আর ফোর্ড’। পরমাণু শক্তিচালিত সংশ্লিষ্ট যুদ্ধপোতটি তৈরি করতে ১,৩০০ কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ভেনেজ়ুয়েলার মতো দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একে মোতায়েন করা যেতে পারে। কিন্তু, নতুন ধরনের আক্রমণ সহ্য করার শক্তি এর নেই। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেজিঙের পিএলএ নৌবাহিনী একে ডোবাতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
২০০৫ সালে সংঘাত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিমিৎজ় শ্রেণির বিমানবাহী রণতরীতে আঘাত হানে সুইডেনের গটল্যান্ড শ্রেণির ডিজ়েলচালিত সাবমেরিন থেকে ছোড়া টর্পেডো। পেন্টাগনের গোপন রিপোর্টে ওই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। যুদ্ধ দফতরের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের দাবি, সংশ্লিষ্ট হামলায় যুদ্ধপোতটি ডুবে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কোনওমতে পরিস্থিতি সামাল দেন ক্যাপ্টেন। তখনই বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে থাকা মার্কিন নৌবহরের দুর্বলতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আধুনিক লড়াইয়ে ডুবো ড্রোন এবং স্পাইঅয়্যারের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দুই অস্ত্রের নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ঢের বেশি এগিয়ে আছে চিন। সমুদ্রের গভীরে বিছানো ইন্টারনেটের তার কেটে মার্কিন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করতে পারে তারা। তা ছাড়া ওয়াশিংটনের রণতরী ডোবানোর ক্ষমতা রয়েছে ড্রাগনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের। স্পাইঅয়্যারে বেজিঙের আড়িপাতা ঠেকানোরও শক্তি নেই ওয়াশিংটনের।
পেন্টাগনের রিপোর্টে আরও একটি বিষয় নিয়ে ট্রাম্প সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। সেটা হল, চিনের মতো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও গোলাবারুদের দ্রুত উৎপাদনের অভাব। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এখনও নতুন প্রজন্মের রণতরী নির্মাণে মান্ধাতার আমলের শিপইয়ার্ড ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। অধিকাংশ অস্ত্র তৈরির বরাত পেয়ে থাকে চার থেকে পাঁচটি প্রভাবশালী ঠিকাদার। লড়াইয়ের সময় এগুলি সবই ব্যুমেরাং হতে পারে, বলছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আমেরিকার সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গাটা হল, অনেক কম খরচে তাদের বড় আর্থিক আঘাত দিতে পারবে চিন। কারণ, কার্যত জলের দরে লাখ লাখ সামরিক ড্রোন ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে বেজিং। সেখানে ড্রাগনের চেয়ে ২৩০ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে রণতরী এবং অন্যান্য হাতিয়ার বানিয়েছে ওয়াশিংটন। যুদ্ধের সময় সেগুলি ধ্বংসের লোকসান সামলানো হোয়াইট হাউসের পক্ষে বেশ কঠিন।
এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন বাইডেন জমানার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তাঁর কথায়, ‘‘চিনের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে মার্কিন ফৌজের কামানের গোলা এবং জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্রের ভান্ডার ফুরিয়ে যাবে। এটি সম্ভব হবে পিএলএ সেনাবাহিনীর বিশালতার জন্য। অন্য দিকে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র কী পরিমাণে পিএলএ-র কাছে আছে, সেটা কেউ জানে না। এগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পদ ধ্বংস করতে ব্যবহার করতে পারে ড্রাগন।’’
তা ছাড়া এ বছরের জুনে ১২ দিনের ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসে। সংঘাতের সময় ইহুদিভূমির শহরগুলিকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে নিশানা করে তেহরানের আধাসেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। ওই সময়ে সেখানে মোতায়েন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘টার্মিনাল হাইঅল্টিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড নামের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে আটকাতে ব্যর্থ হয় ওই হাতিয়ার।
গত ৯ ডিসেম্বর ফক্স নিউজ় ডিজিটালকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার উল্লেখ করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেথ জোন্স। তিনি বলেন, ‘‘তেল আভিভ-সহ একাধিক ইজ়রায়েলি শহরের কী অবস্থা হয়েছিল, সেটা আমরা দেখেছি। লড়াই আরও কিছু দিন চললে থাডের আরও দুর্বলতা সামনে আসত। অধিকাংশ ইরানি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত করতে এটি হয় অতিরিক্ত সময় নিয়েছে বা চিহ্নিতই করতে পারেনি। মনে রাখতে হবে চিনের হাতে ৬০০-র বেশি হাইপারসনিক অস্ত্র আছে।’’
জোন্স জানিয়েছেন, মার্কিন হামলায় একগুচ্ছ রণতরী ধ্বংস হলে বার্জ নিয়ে ময়দানে নামবে চিন। যুদ্ধের সময় সেগুলি ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসাবে এ বছরের জুনে রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনীয় গুপ্তচরবাহিনীর ড্রোন হামলার কথা বলেছেন তিনি। ওই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’। জোন্সের কথায়, ‘‘অত্যন্ত সস্তায় কৃত্রিম মেধা পরিচালিত ছোট ছোট পাইলটবিহীন যান ব্যবহার করে মস্কোর বোমারু বিমানের বহর ধ্বংস করে দেয় কিভ। এর কোনও উত্তর দিতে পারেনি ক্রেমলিন।’’
গত জুনে আত্মঘাতী ডুবোড্রোনের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে মূল রুশ ভূখণ্ডের সংযোগরক্ষাকারী কের্চ সেতু উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ইউক্রেন। যদিও তাতে চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি কিভ। অগস্টে ওই ঘটনার মোক্ষম প্রতিশোধ নেয় মস্কো। সমুদ্র-ড্রোন ব্যবহার করে ইউক্রেনের বৃহত্তম রণতরীকে দানিয়ুব নদীর মোহনায় উড়িয়ে দেয় ক্রেমলিন। জোন্সের দাবি, এই ধরনের সস্তা অথচ মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম হাতিয়ার বিপুল পরিমাণে রয়েছে চিনের লালফৌজের কাছে।
পেন্টাগনের অন্দরের থিঙ্ক ট্যাঙ্কটির অবশ্য অনুমান, কোনও অবস্থাতেই যুদ্ধ শুরু করবে না যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দাবি, ২০২৭ সাল নাগাদ ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ অর্থাৎ তাইওয়ান আক্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে চিনের। ওই সময়ে সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বাঁচাতে গেলে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে আমেরিকা। তবে তাইওয়ান কব্জা করতে বেজিং ঝাঁপিয়ে পড়লে টোকিয়ো যে চুপ করে বসে থাকবে না, ইতিমধ্যেই তা স্পষ্ট করেছে জাপান।
মার্কিন যুদ্ধ দফতরের ফাঁস হওয়া ওই রিপোর্ট অবশ্য মানতে নারাজ বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশের সমর্থন পাবে যুক্তরাষ্ট্র। তা ছাড়া ওয়াশিংটনের পাশে রয়েছে নেটোর মতো সামরিক জোট, যার সদস্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালির মতো রাষ্ট্র। তা ছাড়া লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা চিনের খুবই কম। সংঘর্ষের সময় স্নায়ুর চাপ ধরে রেখে বেজিং কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।