কাকে বলে সুখ? কোনটাই বা দুঃখ? কালজয়ী উপন্যাস ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এ অত্যন্ত মজার ছলে এর জবাব দিয়েছেন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স। গল্পে দেওয়া তাঁর ব্যাখ্যার বাস্তব রূপ যেন দেখা যাচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিতে। আর তার জন্য এক জনের দিকেই আঙুল তুলছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ডিকেন্সের উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মাইকবার আয় ও ব্যয় সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের কথা বলতে গিয়ে সুখ ও দুঃখের সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বার্ষিক আয় ২০ পাউন্ড আর ব্যয় উনিশের উনিশ ছয় পাউন্ড হলে সুখ। কিন্তু বার্ষিক আয় বিশ পাউন্ড এবং ব্যয় বিশ পাউন্ডের সঙ্গে অতিরিক্ত ছ’পাউন্ড হলে দুঃখ।’’ মাইকবারের কথা মতোই কি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে ফেলছে আমেরিকা? ট্রাম্পের সাম্প্রতিক নীতিতে উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
১৮৪৯ সালের মে মাসে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ‘ডেভিড কপারফিল্ড’। এক বছরের মধ্যেই বই হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ডিকেন্সের এই কালজয়ী উপন্যাস। মজার বিষয় হল, ইংরেজ কথাসাহিত্যিক যে সময়ে গল্পটি লেখেন, তখনও মুদ্রাস্ফীতির দশমিকীকরণের নিয়ম বিশ্বে জনপ্রিয়তা পায়নি। ফলে মাইকবারের তত্ত্ব আমজনতার মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি করেছিল।
‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এ সুখ বা দুঃখ বোঝাতে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে ছ’পেন্সের কথা। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় মুখ খোলেন মার্কিন ধনকুবের জে পল গেটি। উনিশ শতকে তিনিই ছিলেন বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি। গেটি বলেন, ‘‘ছ’পেন্স দিয়ে লন্ডনে একটি ট্যাক্সি পাওয়া যেতে পারে। তা হলেই বুঝুন ব্রিটিশ মুদ্রাটি কত অভিজাত।’’
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ মার্কিন পেনিকে ব্রিটিশ পেন্সের অনুরূপ মুদ্রা বলে মনে করেন। আমেরিকায় অবশ্য এর নাম ‘দ্য সেন্ট’। প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসার এক মাসের মাথাতেই এ-হেন মুদ্রাটির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প। তাঁর ওই ঘোষণায় আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটিতে হইচই পড়ে গিয়েছে।
‘দ্য সেন্ট’কে নিয়ে ঠিক কী বলেছেন ট্রাম্প? চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন তিনি। সেখানে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা বলেন, ‘‘আমেরিকাকে মহান দেশে পরিণত করতে হলে বাজেট থেকে সেন্ট নামের বর্জ্যটাকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। এর মূল্য এক পয়সা বা আধুলি হলেও, সেটা করা উচিত।’’
বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই ধারণা, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্কের ‘হাত’ রয়েছে। বর্তমানে প্রেসিডেন্টের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ত্রুটি দূর করতে স্টারলিঙ্ক, এক্স হ্যান্ডল (সাবেক টুইটার) এবং টেসলা কর্তার কাঁধে কর্মদক্ষতা বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজিই) দায়িত্ব সঁপেছেন ট্রাম্প।
‘দ্য সেন্ট’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপকে পুরোপুরি হঠকারী বলা অবশ্য ঠিক হবে না। তাঁর সিদ্ধান্তের নেপথ্যকারণ লুকিয়ে রয়েছে মার্কিন টাঁকশালের (ইউএস মিন্ট) বার্ষিক রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, গত বছর একটি ‘সেন্ট’ তৈরি এবং তা বাজারজাত করার খরচ ছিল ৩.৬৯ সেন্ট। অর্থাৎ প্রতিটা মুদ্রার ক্ষেত্রে ২.৬৯ সেন্ট করে লোকসান হচ্ছে সরকারের।
১৮ শতকে মার্কিন অর্থনীতিতে আবির্ভাব হয় ‘দ্য সেন্ট’-এর। তামার তৈরি পয়সাটির মূল্য এক ডলারের ১০০ ভাগের এক ভাগ। ১৭৯৭ সাল থেকে এটি ব্যবহার করছে আমেরিকার আমজনতা। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির জন্য তামার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘দ্য সেন্ট’ তৈরির খরচ উত্তরোত্তর বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এর ব্যবহার বন্ধ করার দাবি তুলেছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাজারে ঘুরছে এক লক্ষ কোটি ‘দ্য সেন্ট’। অর্থাৎ মাথাপিছু আমেরিকানদের হাতে রয়েছে ৭০০-র বেশি খুচরো মুদ্রা। ট্রাম্পের যুক্তি, এগুলির কোনও গুরুত্ব নেই। আর তাই দ্রুত খুচরো মুদ্রা পুরোপুরি বাজার থেকে তুলে নিতে চাইছেন তিনি।
১৮৫৭ সালে সেন্টের আধুলির ব্যবহার মোটের উপর বন্ধ করে আমেরিকার সরকার। শুধুমাত্র কাপড়ের মিল, কর এবং নির্দিষ্ট কিছু আর্থিক ক্ষেত্রে এর লেনদেনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেন্টের আধুলির বাজারমূল্য ছিল এক ডলারের হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। কয়েক বছরের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট মুদ্রাটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়।
তবে এ ব্যাপারে কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে আমেরিকা। ২০১০ সালেই খুচরো পয়সা তৈরি পুরোপুরি বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের প্রতিবেশী অটোয়া। এক এবং দুই সেন্ট তৈরি করা ‘ক্যাঙারুর দেশে’ বন্ধ হয় ১৯৯২ সালে। একই রাস্তা অবলম্বন করে এক সেন্ট তৈরি থামায় দক্ষিণ গোলার্ধের আর এক দেশ নিউ জ়িল্যান্ড।
ষোড়শ শতকে ব্রিটেনের রানি এলিজ়াবেথের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা ছিলেন টমাস গ্রেশাম। ইংল্যান্ড তখন চলছিল টিউডরদের শাসন। দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে ভাল মুদ্রা এবং খারাপ মুদ্রার মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করেন গ্রেশাম। তাঁর তত্ত্ব ‘গ্রেশামের আইন’ নামে বিশ্ব জুড়ে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
গ্রেশামের তত্ত্ব অনুযায়ী, যে মুদ্রা তৈরি করতে বা ছাপাতে তার মূল্যের তুলনায় বেশি খরচ হয়, সেটি খারাপ মুদ্রা। আর যেগুলির মূল্য বাজারের পণ্যের দামের সমান, সেগুলিকে ভাল মুদ্রা বলেছেন ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ রাজপরিবারের আর্থিক উপদেষ্টা।
ভাল ও খারাপ মুদ্রার পার্থক্য বোঝানোর পাশাপাশি বার বার একটি বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করতেন গ্রেশাম। বাজারে ভাল এবং খারাপ— উভয় ধরনের মুদ্রা প্রচলিত থাকলে সমস্যা তৈরি হবে। কারণ, সে ক্ষেত্রে আমজনতা খারাপ মুদ্রাটি মজুত করতে পারে। আর সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভেঙে পড়বে দেশের আর্থিক কাঠামো।
গ্রেশামের এই তত্ত্বের বাস্তব রূপের প্রতিফলন ঘটেছে আমেরিকার বাজারে। অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই সেন্ট জমিয়ে সেগুলিকে গলিয়ে ফেলছেন। তার পর মুদ্রাটি থেকে প্রাপ্ত তামা চোরাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। আর তাই খুচরো পয়সা পুরোপুরি বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
সেন্ট বা পেনি গলিয়ে তামার চোরাচালান আটকাতে ২০০৬ সালে বিশেষ আইন তৈরি করে আমেরিকার ট্রেজ়ারি দফতর। সেখানে একে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি, এই অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা দুটোই হতে পারে।
খুচরো পয়সা তৈরি বন্ধ করার ব্যাপারে ট্রাম্প সিলমোহর দেওয়ায় বেজায় খুশি হয়েছেন তাঁর ‘ফের আমেরিকাকে মহান দেশ’-এ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা মাগা) পরিণত করার স্বপ্ন দেখে রিপাবলিকান সদস্য-সমর্থকেরা। অন্য দিকে ‘ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস’ বা ইউপিআই চালু হওয়ার পর থেকে ভারতে বাড়ছে ডিজিটাল লেনেদেন। যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো রাস্তায় ভবিষ্যতে মুদ্রা তৈরি বন্ধ করতে নয়াদিল্লিও? উত্তর দেবে সময়।