রুশ-চিন ঘনিষ্ঠতায় বাড়ছে উদ্বেগ। এই পরিস্থিতিতে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় রণডঙ্কা বাজিয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনকে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁর এ-হেন পদক্ষেপে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় জমা হয়েছে আশঙ্কার কালো মেঘ। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক গ্রাস করেছে সাবেক সেনাকর্তা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্ভাব্য রুশ ও চিনা আগ্রাসন ঠেকাতে চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর পেন্টাগনকে যাবতীয় সামরিক প্রস্তুতির নির্দেশ দেন ট্রাম্প। পাশাপাশি, ৭৬ বছর পর প্রতিরক্ষা দফতরের নাম বদলে ফের এক বার যুদ্ধ দফতর করে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের যুক্তি, এর মাধ্যমে আমেরিকার শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরা অনেক বেশি সহজ হবে। তাঁর এ-হেন সিদ্ধান্তের পর দুনিয়া জুড়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদসংস্থা ‘ফক্স নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘যোদ্ধা নীতির প্রত্যাবর্তন’ ঘটিয়েছেন আমাদের প্রেসিডেন্ট। তবে তিনি শান্তিকামী। জোর করে কোনও সংঘর্ষ শুরু করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়।’’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে পেন্টাগনের প্রধান হিসাবে কাজ করছেন ট্রাম্পের এই ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য।
সাম্প্রতিক সময়ে রুশ-চিনের ‘প্রগাঢ় বন্ধুত্বের’ জন্য পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের দুষেছেন হেগসেথ। তাঁর কথায়, ‘‘আগেকার প্রশাসনিক দুর্বলতার জন্যেই মস্কো এবং বেজিং আজ কাছাকাছি আসতে পেরেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। মাঝে কিছু দিন যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কিছুটা অভাব দেখা গিয়েছিল। সেই কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিরক্ষা দফতরকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাহিনীর পুনর্গঠন, যোদ্ধা নীতির পুনরুদ্ধার এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য।’’
সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সংঘাত এড়াতেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘চিন, রাশিয়া এবং তাদের সঙ্গে জোট বাঁধা দেশগুলিকে একটা বার্তা দিতে পেরেছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ শানানোর আগে দু’বার ভাবতে হবে তাদের। এই পরিস্থিতি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যথেষ্ট।’’ এর পরই আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা মহাকাশ থেকে সমুদ্রের গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন পিট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে পরাজিত করার ৮০তম বর্ষ উদ্যাপনে গত ৩ সেপ্টেম্বর বিজয় দিবস পালন করে চিন। সেই উপলক্ষে বেজিঙের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে বিশেষ কুচকাওয়াজ করতে দেখা গিয়েছে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-কে। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেট, ডুবো ও উইংম্যান ড্রোন, লেজ়ার হাতিয়ার এবং রোবট-নেকড়ের মতো সমরাস্ত্রকে প্রকাশ্যে এনে শক্তি প্রদর্শন করেন মান্দারিনভাষীদের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় হইচই। সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন একগুচ্ছ রাষ্ট্রপ্রধান। তবে মঞ্চের একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন তিন জন। সেখানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকের (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) ‘সর্বোচ্চ নেতা’ বা ‘সুপ্রিম লিডার’ কিম জং-উনের মাঝে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তোলেন শি। শুধু তা-ই নয়, ওই মঞ্চ থেকে ওয়াশিংটনকে হুঁশিয়ারিও দেন চিনা প্রেসিডেন্ট।
বেজিঙের রাজপথে ড্রাগন লালফৌজের শক্তি প্রদর্শনের পর চিনের সমরাস্ত্রগুলির সক্ষমতা নিয়ে ইতিমধ্যেই কাটাছেঁড়া করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, বর্তমানে শি-র হাতে ১২ থেকে ২০ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ফলে সহজেই আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালাতে পারবেন তিনি। যদিও এ ব্যাপারে একমত মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব হেগসেথ। সাক্ষাৎকারে এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ‘গোল্ডেন ডোম’-এর প্রসঙ্গ তোলেন তিনি।
চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমেরিকা বা রাশিয়ার অত্যাধুনিক হাতিয়ারগুলি নকল করে মারণাস্ত্র তৈরি করেছেন তাঁরা। আর তাই সেগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব। ‘ফক্স নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে ওদের কাছে কিছু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। কিন্তু সেটা আমাদের ‘সোনালি গম্বুজ’-এর কবচ ভেদ করতে পারবে না। এর প্রতিলিপি তৈরি করাও সম্ভব নয়। ফলে সংঘর্ষের সময় প্রয়োজনে ড্রাগনভূমির ভিতরে হামলা চালানো যাবে।’’
এ বছরের মে মাসে দুর্ভেদ্য বর্মে দেশের আকাশকে ঢেকে ফেলার ঘোষণা করেন ট্রাম্প। নতুন ধরনের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স তৈরি করতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওই ঢালেরই পোশাকি নাম ‘গোল্ডেন ডোম’। ২০২৯ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটি চালু হয়ে যাবে বলে স্পষ্ট করেছে ওয়াশিংটন।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শক্তিশালী দেশের হাতে রয়েছে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা। মূলত, শত্রুর ছোড়া ব্যালেস্টিক বা ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান থেকে আমজনতা ও সামরিক কৌশলগত সম্পত্তিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেগুলি তৈরি করেছে তারা। তবে আমেরিকা যে ‘সোনালি গম্বুজ’ তৈরি করতে যাচ্ছে, তার কার্যপদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের এই হাতিয়ারটি হবে সম্পূর্ণ মহাকাশভিত্তিক। এর মাধ্যমে ইনফ্রারেড লেজ়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন সমরাস্ত্র গবেষকদের।
সূত্রের খবর, কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে শত্রুর ছোড়া ব্যালেস্টিক বা ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করবে আমেরিকার ‘সোনালি গম্বুজ’। এর জন্য স্থলভিত্তিক রেডারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে এই ব্যবস্থা। তার পর লেজ়ার ব্যবহার করে হাইপারসনিক, ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ়— তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করবে গোল্ডেন ডোম।
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, ‘সোনালি গম্বুজ’-এর মতো অতিশক্তিশালী ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা হাতে পেতে মার্কিন সেনাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও চার বছর। তার আগে অবশ্য পেন্টাগনের নামবদলের প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। যদিও এ ক্ষেত্রে আইনগত দিক থেকে রয়েছে বেশ কিছু জটিলতা, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস।
ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যবাহী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এর তরফে বলা হয়েছে, পেন্টাগনের নাম বদল করতে হলে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর অনুমোদন লাগবে। সেটা চলে এলে একটি ‘এক্জ়িকিউটিভ অর্ডার’-এ সই করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার পর থেকে প্রতিরক্ষা দফতরের দ্বিতীয় নাম হিসাবে যুদ্ধ দফতর শব্দবন্ধ সরকারি ভাবে ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সচিব পিটের পদ বদলে হবে ‘যুদ্ধসচিব’।
১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনে ছিল না কোনও প্রতিরক্ষা দফতর। ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগটির নাম ছিল যুদ্ধ দফতর। কিন্তু, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে নাম বদলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এর জন্য ১৯৪৭ সালে পাশ হয় জাতীয় আইন। সেখানেই নাম বদলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটা শেষ করতে লেগে গিয়েছিল আরও দু’বছর।
ট্রাম্প অবশ্য এ সব সাংবিধানিক নিয়মের খুব একটা পরোয়া করছেন না। হেগসেথকে ইতিমধ্যেই যুদ্ধসচিব বলতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। গত ২৫ অগস্ট এই পরিবর্তনের ব্যাপারে একটি ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘যুদ্ধ দফতর থাকাকালীন আমরা কয়েকটা অবিশ্বাস্য জয় পেয়েছিলাম। বিজয়ের সেই গৌরবময় ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না।’’
প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁরই ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য পিট। ‘ফক্স নিউজ়’কে তিনি বলেন, ‘‘সামরিক ক্ষেত্রে আমরা একটা সাংস্কৃতিক বদল আনতে চলেছি। প্রতিরক্ষা নয়, যুদ্ধ দফতর থাকাকালীনই আমরা প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করি। তা ছাড়া, শুধুমাত্র আক্রমণ ঠেকানো আমাদের বাহিনীর কাজ নয়, বরং তাঁরা আক্রমণাত্মক। এই শব্দগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে চিনা প্রেসিডেন্ট শি বলেন, ‘‘বেজিং কখনওই কোনও গুন্ডামিকে ভয় পায় না। আমরা সর্বদা এগিয়ে যাব।’’ দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসা ইস্তক ড্রাগনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। পাশাপাশি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মান্দারিনভাষীদের ‘দৌরাত্ম্য’ মানতে নারাজ আমেরিকা।
আর তাই কুচকাওয়াজ শেষ হতে না হতেই চিনকে কটাক্ষ করে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে বেজিং এবং মস্কোকে সরাসরি আমেরিকা-বিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করেছেন তিনি। তাঁর ওই পোস্টের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেয় ক্রেমলিন ও ড্রাগন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, তাইওয়ান, জাপান বা ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’কে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) কেন্দ্র করে সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে পারে চিন। এ ব্যাপারে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘কট্টর দুশমন’ ইরানকে পাশে পাচ্ছে বেজিং। অন্য দিকে, ওয়াশিংটনের ভরসা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। ৩২ দেশের এই সংগঠনে রয়েছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো পরমাণু শক্তিধরেরা।