মহাকাশ গবেষণায় রকেট যুগের ইতি। কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণে এ বার থেকে ব্যবহার হবে ক্যাটাপল্ট। নতুন এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বদলাতে চলেছে বলে দাবি করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)। তবে এতে কপাল পুড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্কের।
মহাকাশ গবেষণায় বিপ্লব আনতে চলা ক্যাটাপল্টের আবিষ্কর্তা আমেরিকার ক্যালোফোর্নিয়া-ভিত্তিক স্টার্ট আপ স্পিনলঞ্চ। কৃত্রিম উপগ্রহকে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে দিতে রকেটের বদলি হিসাবে ওই যন্ত্র তৈরি করেছে তারা। সংস্থাটির দাবি, এর সাহায্যে ব্যাপক সস্তায় কোনও যান বা কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাশূন্যে পাঠানো যাবে। পাশাপাশি, ক্যাটাপল্ট পরিবেশবান্ধব হওয়ায় নেই কোনও দূষণের আশঙ্কা।
স্পিনলঞ্চ জানিয়েছে, ক্যাটাপল্টের সাহায্যে হাইপারসোনিক গতিতে (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতি) কৃত্রিম উপগ্রহ বা অন্তরীক্ষ যান পৌঁছে যাবে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে। যন্ত্রটিতে রয়েছে ঘূর্ণায়মান দু’টি বিশাল হাতের মতো অংশ। এগুলির সাহায্যেই উৎক্ষেপণের পর গতির ঝড় তোলে ক্যাটাপল্ট।
রকেটের মতো স্পিনলঞ্চের এই যন্ত্রে প্রয়োজন হচ্ছে না কোনও জ্বালানির। ক্যাটাপল্ট পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত হওয়ায় এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। ক্যালিফোর্নিয়ায় স্টার্ট আপ সংস্থাটি শুধু মুখেই যে একাধিক দাবি করেছে এমনটা নয়। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক সফল উৎক্ষেপণও সেরে ফেলেছে স্পিনলঞ্চ।
এ-হেন ক্যালাপল্ট যন্ত্রটির প্রেমে পড়ছেন নাসার তাবড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদেরা। আর তাই এয়ারবাস এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে মিলে এর উন্নত সংস্করণ তৈরির দিকে মন দিয়েছেন তাঁরা। সূত্রের খবর, ২০২৬ সালের মধ্যে ক্যাটাপল্টের সাহায্যে একগুচ্ছ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থার।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাটিয়ে মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশযান নিয়ে যেতে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করে রকেট। ক্যাটাপল্টের প্রযুক্তি এর থেকে একেবারে ভিন্ন। স্পিনলঞ্চ পেলোড (ওজন) উৎক্ষেপণের জন্য এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে বিশুদ্ধ গতিশক্তি। সংস্থার তৈরি যন্ত্রটিতে বিশাল ভ্যাকুয়াম সিলড সেন্ট্রিফিউজ় রয়েছে।
ক্যাটাপল্ট উৎক্ষেপণের জন্য বিশেষ ধরনের একটি টিউব ব্যবহার করছে স্পিনলঞ্চ। এর সাহায্যে পেলোডগুলিকে অস্বাভাবিক গতিতে ঘুরিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা হচ্ছে। সেই শক্তিই কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশযানকে পৌঁছে দিচ্ছে অন্তরীক্ষে। পেলোডগুলিকে দুরন্ত গতিতে ঘোরাতেও বিদ্যুতের ব্যবহার করছে স্পিনলঞ্চ।
ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক সংস্থাটি জানিয়েছে, ক্যাটাপল্টের মাধ্যমে কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে মহাশূন্যের প্রান্তের কাছে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে সেগুলির গতিবেগ থাকছে ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ হাজার মাইল (৮০০০ কিমি/ঘণ্টা)। অত্যাধুনিক রাইফেল থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলি এর চেয়ে অনেক কম গতিতে ছোটে বলে জানিয়েছে স্পিনলঞ্চ।
নাসার বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই ক্যাটাপল্টকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের এ-হেন মন্তব্যের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রটিতে রাসায়নিক ভর্তি কোনও জ্বালানি ট্যাঙ্কারের প্রয়োজন হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, উৎক্ষেপণের নিরিখে এটি ঐতিহ্যবাহী রকেটগুলির তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি দক্ষ।
বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশযানকে অন্তরীক্ষে নিয়ে যেতে গেলে বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয় বেশ কয়েক মাস। কারণ, কৃত্রিম উপগ্রহ বা অন্তরীক্ষ যান উৎক্ষেপণের রকেটের নির্মাণ সময়সাপেক্ষ। নতুন পদ্ধতিটি ঠিকমতো কাজ করলে মাসের পরিবর্তে কয়েক ঘণ্টায় উৎক্ষেপণ করা যাবে কৃত্রিম উপগ্রহ।
স্পিনলঞ্চ পরীক্ষামূলক ভাবে ক্যাটাপল্ট ব্যবহার করার জন্য সাবঅর্বিটাল টেস্টিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। একেই এ বার পূর্ণাঙ্গ অর্বিটাল লঞ্চ সিস্টেমে বদলানোর জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার এই স্টার্ট আপ সংস্থা। সূত্রের খবর, যন্ত্রটির চূড়ান্ত সংস্করণ টেস্ট প্ল্যাটফর্মের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বড় হবে। বড় আকারের চলমান কয়েকটি মেশিন সেখানে বসানো হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন স্পিনলঞ্চের সিইও জোনাথন ইয়ানি। তিনি জানিয়েছেন, ১১ মাসে ১০টি সফল উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এতেই প্রমাণ করা গিয়েছে ক্যাটাপল্টের গ্রহণযোগ্যতা। আগামী দিনে একসঙ্গে একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে আধিপত্য রয়েছে ধনকুবের মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্সের। এই কোম্পানির প্রতিটা লঞ্চে খরচ হয় ন’লক্ষ পাউন্ডের বেশি জ্বালানি। আর তাই স্পেসএক্সের সাহায্যে মহাশূন্য কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর বিষয়টি বেশ খরচসাপেক্ষ।
অন্তরীক্ষে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে আমজনতার একেবারে বাড়িতে সরাসরি ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছে মাস্কের সংস্থা। কিন্তু উৎক্ষেপণ খরচসাপেক্ষ হওয়ায় এর জন্য আমজনতার পকেট থেকে খসছে অনেকটাই বেশি টাকা। বিশ্লেষকদের দাবি, স্পিনলঞ্চের ক্যাটাপল্ট পুরোপুরি সাফল্য পেলে মাস্কের ব্যবসায় থাবা বসানোর সুযোগ চলে আসবে জোনাথনের কাছে। উৎক্ষেপণ ব্যয়বহুল না হওয়ায় অনেক সস্তা দরে ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে পারবেন তিনি। ফলে গ্রাহকদের বড় অংশই মাস্কের কোম্পানির থেকে মুখ ফেরাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে স্পিনলঞ্চের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্রথমত, ক্যাটাপল্টের উৎক্ষেপণ পুরোপুরি গতিশক্তির উপর নির্ভরশীল। আর তাই ২০০ কেজির বেশি ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ এর সাহায্যে মহাশূন্যে পাঠানো প্রায় অসম্ভব। মহাকাশে বড় ধরনের মিশনের ক্ষেত্রে এটি কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে এখনও সন্দিহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশ।
বর্তমানে নাসা এবং এয়ারবাসের সঙ্গে মিলে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টার্ট আপ স্পিনলঞ্চ। এর মধ্যে অন্যতম হল কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কক্ষপথ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা তৈরি করা। এ ছাড়া চরম উৎক্ষেপণ শক্তি সহ্য করার জন্য শক্তিশালী স্যাটেলাইট শিল্ডিং নির্মাণের চেষ্টাও চালাচ্ছে তারা।
সূত্রের খবর, ক্যাটাপল্ট পদ্ধতিতে আরও বেশি পরিমাণে কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠাতে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদারি বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে স্পিনলঞ্চের। এই সংস্থার সিইও জোনাথন এই বিষয়ে বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে।
বিজ্ঞানীদের একাংশ অবশ্য মনে করেন নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকলেও আগামী দিনে মহাকাশ গবেষণায় দিগন্ত খুলে দেবে ক্যাটাপল্ট। শেষ হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। তবে তার জন্য কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।