একের পর এক হুমকি দিয়ে ‘শুল্কযুদ্ধের’ ঘোষণা। কিন্তু, সময়ের চাকা ঘুরতেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর ‘বেপরোয়া’ সিদ্ধান্তের জেরে বাণিজ্য ঘাটতি কমা তো দূরে থাক, উল্টে তা দৌড়োতে শুরু করেছে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই মাথায় হাত ‘পোটাস’-এর (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স)। তাই কি সমাজমাধ্যমে ভারতকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করে সন্ধির বার্তা দিচ্ছেন তিনি? ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করে আমেরিকার ‘ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালিসিস’। তাদের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে ফারাক বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যেটা প্রায় ৭,৮৩০ কোটি ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতির জন্য ট্রাম্পের ‘বেপরোয়া’ শুল্কনীতিকেই দায়ী করেছেন তারা। আগামী দিনে ব্যবধান আরও চওড়া হবে বলে ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
বাণিজ্যিক ঘাটতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালিসিস’-এর কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গত জুলাইয়ে ‘মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’-এর (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) সূচক অনেকটা নেমে যায়। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে, অচিরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। মার্কিন অর্থনীতির জন্য একে ‘খাঁড়ার ঘা’ বললে অত্যুক্তি হবে না।
ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে (পড়ুন জানুয়ারি থেকে মার্চ) জিডিপির নিরিখে বাণিজ্যিক ঘাটতি পৌঁছে যায় ৪.৬১ শতাংশে। এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ওই সূচক সামান্য বেড়ে ৪.৯৫ শতাংশে গিয়ে থেমেছে, এখনও পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ। এই সময়সীমার মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩.৩ শতাংশ বলে জানা গিয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে এর গতি ছিল আরও শ্লথ। ওই সময় জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ০.৫ শতাংশ।
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে ‘আটলান্টা ফেডারেল রিজ়ার্ভ’। তাদের দাবি, এ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জিডিপির হার থাকবে তিন শতাংশের কাছাকাছি। অন্য দিকে, গত জুলাইয়ে আমেরিকার আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৯ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যেটা প্রায় ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি আবার ৬.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ হাজার ৩৩০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে।
এ ছাড়া ট্রাম্পের শুল্ক সংঘাতের আবহে বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানির পরিমাণ বাড়িয়েছে আমেরিকা। সেই খাতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ১,২৫০ কোটি ডলার। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’-এর বাইরে ৯৬০ কোটি ডলারের সোনা কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই তালিকায় একমাত্র স্বস্তির জায়গায় রয়েছে পেট্রোপণ্য। এপ্রিল থেকে এর আমদানি সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে ওয়াশিংটন।
গত জুলাইয়ে আমেরিকার মূলধনী পণ্য আমদানি ৪৭০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৯,৬২০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। এই খাতে বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কম্পিউটার, টেলি যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং শিল্পসামগ্রী কিনছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, ৮০ কোটি ডলারের সেমিকন্ডাক্টর আমদানি কমাতে পেরেছে মার্কিন সরকার। এ ছাড়া ১৩০ কোটি ডলারের ভোগ্যপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ভারতের উপর আমেরিকার প্রবল নির্ভরশীলতা রয়েছে। আর তাই ‘শুল্কযুদ্ধের’ আওতায় ফার্মা শিল্পকে রাখেননি ট্রাম্প। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছরের জুলাইয়ে ১১০ কোটি ডলারের ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম বা তাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ কমাতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই ক্ষেত্রে আমেরিকা পুরোপুরি স্বাবলম্বী হয়ে গিয়েছে, তা বলা যাবে না।
পাশাপাশি, এ বছরের জুলাইয়ে গাড়ি ও তার নির্মাণ সরঞ্জাম এবং ইঞ্জিনের আমদানি হ্রাস করেছে ট্রাম্পের আমেরিকা। ফলে ট্রাক, বাস এবং যাত্রিবাহী গাড়ির বিদেশ থেকে কেনার সূচকটিকে নিম্নমুখী হতে দেখা গিয়েছে। এই খাতে ১৪০ কোটি ডলার বাঁচাতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, গাড়ি রফতানি করে মোটা টাকা মুনাফা করেছে একাধিক মার্কিন সংস্থা। সেখান থেকে ৩০ কোটি ডলার ওয়াশিংটন ঘরে তুলেছে বলে জানা গিয়েছে।
এ বছরের জুলাইয়ে ০.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায় আমেরিকার রফতানি। টাকার অঙ্কে যেটা ২৮ হাজার ৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর রফতানি ০.১ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৯৪০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। অন্য দিকে, মূলধনী পণ্য রফতানি বেড়ে ৫,৯৯০ কোটি ছুঁতে পেরেছিল বলে জানা গিয়েছে।
তবে খনির যন্ত্রাংশ রফতানি হ্রাস ট্রাম্প প্রশাসনের চিন্তা বাড়িয়েছে। সেখানে বরাতে ঘাটতি ছিল ১৫০ কোটি ডলার। জুলাইয়ে মোট ২৯০ কোটি ডলারের সোনা বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আমেরিকার থেকে ‘হলুদ ধাতু’ কেনেনি কোনও বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
‘ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালিসিস’ জানিয়েছে, জুলাইয়ে শুধুমাত্র পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতি বেড়েছে ২১.২ শতাংশ। ফলে ব্যবধানের অঙ্ক ১০ হাজার ৩৯০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি ৫৩০ কোটি ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১,৪৭০ কোটি ডলারে গিয়ে থেমেছে। এ ছাড়া ভারত, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), সুইৎজ়ারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া (পড়ুন রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে) এবং জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে।
গত জুলাইয়ে আমেরিকার পরিষেবা খাতে আমদানির পরিমাণে ১৭০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৭,৫৫০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত রেকর্ড। এর প্রভাব পরিবহণ, পর্যটন এবং অন্যান্য ব্যবসার উপরে দেখতে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
আশার কথা হল, গত জুলাইয়ে পরিষেবা খাতে রফতানিকে সর্বকালীন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয় আমেরিকা। ফলে ওই খাতে ৬০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ১০ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের স্বদেশে ফেরত পাঠান ট্রাম্প। এর প্রভাব মার্কিন পরিবহণ পরিষেবায় পড়েছে। সেখানে আয় ৩০ কোটি ডলার কমেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর।
সম্প্রতি, মার্কিন অর্থনীতি মহামন্দার খাদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে বলে সতর্কবার্তা দেন সমীক্ষক সংস্থা ‘মুডিজ় কর্পোরেশন’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ মার্ক জ়ান্ডি। তাঁর ওই মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো বিপদ বাড়াতে পারে মুদ্রাস্ফীতি। ২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার ভবিষ্যদ্বাণী করে খবরের শিরোনামে আসেন জ়ান্ডি। সেই কারণেই তাঁর সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনও।
কয়েক দিন আগে এই বিষয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন মার্ক। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ প্রদেশের জিডিপি হয় মন্দায়, নয়তো সেই রকম পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য এক তৃতীয়াংশ কিছুটা স্থিতিশীল। বাকি এক তৃতীয়াংশের সূচক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কথায় অর্থনীতি যথেষ্ট অস্থির। আমার মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমেরিকায় মন্দা আসার মতো সহায়ক পরিস্থিতি রয়েছে।’’
কোনও দেশ আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে, এটা বোঝার একটা সুনির্দিষ্ট উপায় রয়েছে। একটি অর্থবর্ষে পর পর দু’টি ত্রৈমাসিকে যদি জিডিপির সূচক ঋণাত্মক থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে মন্দা গ্রাস করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) প্রথম তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে শূন্যের নীচে নেমে যায় যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির সূচক। জুলাই-অগস্টে পরিস্থিতি সে ভাবে বদলায়নি। সেপ্টেম্বরে অবস্থার বিরাট পরিবর্তন না হলে মার্কিন অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
সংবাদসংস্থা ‘নিউজ়উইক’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিস্থিতির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন জ়ান্ডি। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ আমেরিকাবাসীদের জন্য দুঃসময় শুরু হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা শুরু হলে হু-হু করে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। খাদ্যসামগ্রীর জন্য আরও বেশি খরচ করতে হবে আমাদের। পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলিতে কর্মসংস্থানে আসবে বড় আঘাত। ফের এক বার গণহারে ছাঁটাই দেখতে পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।’’
এই পরিস্থিতিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর ‘ভারত ও রাশিয়াকে চিনের অন্ধকারে হারিয়ে ফেললাম’ বলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন ট্রাম্প। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভারতকে হারিয়ে ফেলিনি। ভারতের উপর আমরা খুব বড় একটা শুল্ক আরোপ করেছি— ৫০ শতাংশ। এটা খুবই চড়া শুল্ক।’’ এর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে।
ভারত সম্পর্কে ট্রাম্পের এ-হেন ইতিবাচক মন্তব্যের পর নিজে থেকেই বার্তা দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ৬ সেপ্টেম্বর সকালে সমাজমাধ্যমে দু’লাইনের একটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে নমো লেখেন, ‘‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুভূতি এবং আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ওঁর ইতিবাচক বক্তব্যের প্রশংসা করছি। আমরা এর সম্পূর্ণ প্রতিদান দেব।’’ ফলে দু’তরফে যে বরফ গলতে শুরু করেছে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।