ভারতীয় বিয়ে বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আড়ম্বর, জাঁকজমকের খণ্ড খণ্ড চিত্র। কয়েক দিন ধরে চলে উৎসব, নানা রীতিনীতি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের নিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড! সব কিছুই অসাধারণ, ঝলমলে রঙিন। কখনও কখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়। ভারতের যে প্রান্তেই যান না কেন, বিয়ের জাঁকজমক চোখ এড়াবে না।
বিশ্ব জুড়ে ভারতীয় বিয়ের নামডাক রয়েছে তার জমকালো অনুষ্ঠান ও আয়োজনের জন্য। আজকাল বহু বিয়েবাড়িতে বলিউডি ছোঁয়াও থাকে। রুপোলি পর্দার দৃশ্য বাস্তব হয়ে ধরা দেয় বিবাহমণ্ডপে। ভারতীয় বিয়ের অনুষঙ্গে থাকে মেহন্দি, সঙ্গীত, হলদি। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানেরই আলাদা আলাদা জৌলুস। হুল্লোড়, দেদার মজা।
কল্পনা করুন বিয়েবাড়ির সমস্ত আনন্দ-উচ্ছ্বাস চেটেপুটে উপভোগ করছেন কিন্তু সেখানে নেই কোনও বর-কনে! দামি শাড়ি, ডিজ়াইনার লেহঙ্গা, ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাকে সজ্জিত হয়ে এমন একটি বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন যেখানে বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানের সমস্ত রসদ রয়েছে। অথচ সেখানে হচ্ছে না কোনও বিয়ে! পাত্রী-পাত্রী, তাঁদের পরিবার অনুপস্থিত। নেই কোনও নাটকীয়তা। আছে শুধু নিখাদ আনন্দ উদ্যাপন।
বর-কনে ছাড়া ‘বিয়েবাড়ি’, সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও জেন জ়ি কিন্তু মজেছে এই ‘ফেক ওয়েডিং’ বা ভুয়ো বিয়ের পার্টিতেই। গাঁটের কড়ি খরচ করে রীতিমতো টিকিট কিনে বিয়েবাড়ির মজা উপভোগ করতে এগিয়ে আসছে তরুণ প্রজন্ম।
বিয়েই নেই, তাই নেই কোনও চাপ। আছে শুধু এক দিনের হইহুল্লোড়। নাচ-গান-খাওয়াদাওয়া। সেই পার্টির থিম হল বিয়ের সঙ্গীত। এক দিনের আয়ু সেই পার্টির। বর-কনে ছাড়া আর সমস্ত কিছুরই বন্দোবস্ত করা হয় পার্টিগুলিতে। সাত পাকে ঘোরার বালাই নেই, নেই ‘কড়া নজরে রাখা’ আত্মীয়স্বজনের ভিড়, বিয়ের পর আবেগপূর্ণ বিদায়ের মুহূর্তও অনুপস্থিত।
ভারতীয় শহরগুলিতে ভুয়ো বিয়ের পার্টির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। সেখানে অতিথিরা আসল বিয়ের বদলে স্রেফ বিয়ের আনন্দটুকু উপভোগ করার জন্য জড়ো হচ্ছেন। এখানে অতিথিদের বেশির ভাগই একে অপরের অচেনা। তাই মন খুলে আনন্দ করতে বাধা নেই, নেই পরিবারের বাধা, নিয়ম, আদব-কায়দা।
খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে মেহন্দি এবং ডিজে অনুষ্ঠানে আর পাঁচটা বিয়ের মতোই আয়োজনের কোনও কমতি থাকে না। কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ সেজে কয়েকশো বা হাজার অতিথি জড়ো হন কোনও উন্মুক্ত বিয়ের মণ্ডপে। আবার কখনও বিলাসবহুল হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে বসে নকল বিয়ের আসর।
কার্ড পাঠিয়ে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করা হয় ‘বিয়ের অনুষ্ঠানে’। তবে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা প্যাকেজের ব্যবস্থা থাকে। কোনও মহিলা একা এলে ৯৯৯ টাকা দিয়ে পাস কিনতে পারেন, আবার যুগলে যোগ দিলে ১৪৯৯ টাকা। নকল বিয়ের টিকিটের মূল্য ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
নাচ-গান, পানভোজন এবং সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার মতো ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া যায় বিয়ের থিম পার্টিতে। দিল্লি, মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরগুলিতে ভুয়ো বিয়ের পার্টি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সব পার্টিতে অতিথি হিসাবে সাধারণত তরুণ-তরুণীদেরই দেখা যায়। অতিথি, পরিবারের কোনও চাপ ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে বিয়ের আনন্দ এবং মজা উপভোগ করতে এখানে উপস্থিত হন তাঁরা।
তেমনই একটি বিয়ের পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদ শ্রীকুমার। আদতে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা। তিনি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে বেঙ্গালুরুতে একটি নকল সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ২৫ বছরের তরুণ।
তিনি জানিয়েছেন, একটি বিলাসবহুল ক্লাবে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অতিথিরা সকলেই ভারতীয় পোশাকে সেজে হাজির হয়েছিলেন। মেয়েদের পরনে ছিল জমকালো লেহঙ্গা বা শাড়ি। পুরুষেরা কুর্তা, পাজামা, জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সকলেই ঢোলের তালে নাচছিলেন, মেহেন্দির স্টলে ভিড় জমিয়েছিলেন। বিভিন্ন খাবারের স্টলে থাকা চাট থেকে শুরু করে ভোজের সমস্ত পদ ছিল বৈচিত্রপূর্ণ।
শ্রীকুমারের মতো বহু জেন জ়ি-র এই ধরনের পার্টিকে আপন করে নেওয়ার অন্যতম কারণ হল বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দকে নিজের মতো করে উপভোগ করা। পোশাকের বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দ থেকে শুরু করে আচার-আচরণ— পারিবারিক বিয়েতে অনেক রকম বিধিনিষেধ থাকে। কিন্তু এই ধরনের থিমের বিয়ের পার্টিতে নাক উঁচু আত্মীয়-পরিজনের অবাঞ্ছিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না।
জেন জ়িদের একাংশের মতে, ভুয়ো বিয়ের পার্টিতে থাকেন শুধুমাত্র বন্ধুবান্ধব ও অপরিচিত মানুষেরা। তাঁদের সামনে ভান করার প্রয়োজন হয় না। থাকে না কোনও বাধ্যবাধকতা। আসল বিয়ের অনুষ্ঠানে বহু রীতিনীতি মানতে বাধ্য করা হয়। আত্মীয়দের নানা অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এড়াতে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এই ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে চান।
তাই বহু তরুণ-তরুণীর কাছে এই থিম পার্টি যেন খোলা হাওয়া। গাঁটের কড়ি খরচ করে কয়েক ঘণ্টার জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পেলে লুফে নিচ্ছেন বিশেষ করে যাঁরা পড়াশোনা বা কাজের সূত্রে ভিন্রাজ্যে বাস করেন।
নকল বিয়ের থিমের অনুষ্ঠান আয়োজনকারী একটি রেস্তরাঁর মালিক শরদ মদন বিবিসিকে জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও আয়োজন করতে তাঁদের প্রায় ১০ লক্ষ টাকা খরচ পড়ে। টিকিট বিক্রির মাধ্যমে এর দ্বিগুণ আয় হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে বিলাসবহুল হোটেলে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। কারণ ১ হাজার বা ২ হাজার অতিথির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে টিকিটের বুকিং দ্রুত শেষ হয়ে গিয়েছিল।
শরদ জানিয়েছেন, সবটাই শুধু লাভের জন্য নয়। আসল কথা হল অতিথিদের সঙ্গে সংযোগ। অতিথিরা সব সময়ই নতুন কিছু চান। তাঁদের চাহিদা সঙ্গে তাল মেলানোতেই আনন্দ।
জাঁকজমকের কথা যদি বলা হয়, সে ক্ষেত্রে কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই ভারতীয় বিয়েগুলি। আর আসল বিয়ের খরচ হামেশাই পৌঁছে যায় কোটির ঘরে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলির মতে, প্রতিটি মাঝারি আকারের নকল বিয়ের আয়োজন করতে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে ২০২৫ সালে নকল বিয়ের থিম পার্টির বেশির ভাগটাই দেখা গিয়েছে মেট্রো শহরগুলিতে, মূলত উচ্চ এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে।
আসল বিয়ে ছেড়ে নকল বিয়ের অনুষ্ঠানে গা-ভাসানোর পিছনের কারণ কতটা সঠিক তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন সমাজতত্ত্ববিদেরা। তাঁদের একাংশের মতে, ঝুটঝামেলা ছাড়াই সহজলভ্য বিয়ের আনন্দের দিকে ঝুঁকছেন তরুণ প্রজন্ম। বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারার সাধ মেটাচ্ছেন তাঁরা।
এই প্রবণতার কিছু ঝুঁকিও রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। কেউ কেউ মনে করছেন, পরিবারের বন্ধন ও দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন জেন জ়িরা। বিয়ের মতো তথাকথিত প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করে এটিকে একটি থিম পার্টি হিসাবে ভাবতে চাইছে নয়া প্রজন্ম।