ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় গুজরাতের অহমদাবাদে মৃত্যু মিছিল! মাটি ছাড়ার ২-৩ মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দর সংলগ্ন চিকিৎসকদের হস্টেলে ভেঙে পড়ল যাত্রিবাহী উড়োজাহাজ। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই কি এই বিপত্তি? না কি অভিশপ্ত বিমানটির নির্মাণকারী সংস্থার অতিরিক্ত মুনাফার লোভে প্রাণ গেল হতভাগ্য যাত্রীদের? দুর্ঘটনার পর এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন তদন্তকারীরা। অন্য দিকে এই ইস্যুতে বিস্ফোরক দাবি করেছেন বিমান নির্মাণকারী সংস্থার সাবেক দুই কর্মী।
‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’ শ্রেণির অহমদাবাদের অভিশপ্ত বিমানটির নির্মাণকারী সংস্থা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং। উড়োজাহাজটির লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। এই প্রথম বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও অতীতে ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’র কারণে বেশ কয়েক বার খবরের শিরোনামে এসেছে বোয়িংয়ের এই মডেল। গত বছর মার্কিন সংস্থাটির সাবেক ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেফোর অভিযোগ করেন যে, দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ‘ড্রিমলাইনার’ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা বজায় রাখা হয়নি।
২০২৪ সালের গোড়ায় সংবাদ সংস্থা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং সিএনএনকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন বোয়িংয়ের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার স্যাম। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘তাড়াহুড়ো করে উৎপাদনের জন্য ড্রিমলাইনার মডেলগুলিতে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। উড়োজাহাজগুলি পুরনো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপদ টের পাওয়া যাবে। কিন্তু, তখন হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।’’ স্যামের দাবি, এই নিয়ে আমেরিকার ‘ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা এফএএ-র কাছে অভিযোগও দায়ের করেন তিনি। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
সাক্ষাৎকারে স্যাম আরও বলেন, ‘‘ড্রিমলাইনার উৎপাদনে শর্টকাট নিয়েছে বোয়িং। মডেলটির বডির ভুল জায়গায় ড্রিলিং করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘ফিউজ়েলেজ’ অংশে ছোট ছোট ফাঁকগুলিকে ভুল ভাবে পূরণ করেছে তারা। ফলে লম্বা পথ পাড়ি দিলে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজে ফাটল তৈরি হবে।’’ তাঁর দাবি, হাজারের বেশি ড্রিমলাইনার মডেলে এই সমস্যা রয়েছে। বোয়িংয়ের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার সালেফোরের বক্তব্য ছিল, এই বিমান ওড়ানো মানে টাইম বোমা নিয়ে আকাশে যাচ্ছেন পাইলট।
বোয়িংয়ের এ হেন কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মাসুলও তাঁকে দিতে হয়েছিল বলে অভিযোগ স্যামের। তাঁর দাবি, দু’দশক ধরে কাজ করা সত্ত্বেও ড্রিমলাইনারের অ্যাসেম্বলিং নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তড়িঘড়ি তাঁকে ৭৭৭ প্রকল্পে (বোয়িংয়ের আর একটি যাত্রিবাহী বিমানের মডেল) বদলি করে এই জনপ্রিয় মার্কিন সংস্থা। এই পদক্ষেপকে ‘প্রতিশোধমূলক’ বলে উল্লেখ করেন তাঁর আইনজীবী।
তবে স্যাম একা নন। গত বছরের জুন মাসে একই রকমের অভিযোগ করেন রিচার্ড কিউভাস নামের এক ঠিকাদার কর্মী। তাঁর আইনজীবী কাট্জ় ব্যাঙ্কস কুমিনের দাবি, এর জন্য নাকি তাঁর মক্কেলকে বরখাস্ত করেন বোয়িং কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ফরোয়ার্ড প্রেশার বাল্কহেড উৎপাদনে বিচ্যুতি নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করে মুখ খোলেন রিচার্ড। উড়োজাহাজ আকাশে থাকাকালীন বায়ুমণ্ডলের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
আইনজীবী কুমিন জানিয়েছেন, স্পিরিট অ্যারোসিস্টেমস নামের একটি ঠিকাদার সংস্থার কর্মী হিসাবে ড্রিমলাইনারের ফিউজ়লেজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিউভাস। বোয়িং ও স্পিরিট আমজনতা এবং লগ্নিকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে বলেও একটা সময়ে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এ ব্যাপারে অভিযোগ করা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি আমেরিকার ‘ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা এফএএ।
২০১৩ সালে জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত পাঁচ বার ‘ড্রিমলাইনার’-এর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফলে বিশ্বব্যাপী বোয়িংয়ের ৭৮৭-র বহরকে কিছু দিনের জন্য বসিয়ে দিয়েছিল মার্কিন এফএএ। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে এই মডেলের একটি উড়োজাহাজের জ্বালানিতে লিকেজ ধরা পড়ে। এ ছাড়া ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বিমানের প্রযুক্তিগত ত্রুটির তদন্তে নেমেছিল আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট সেফটি বোর্ড’ বা এনটিএসবি।
২০১৩ সালের ১১ এবং ১৩ জানুয়ারি টোকিয়োয় বোয়িংয়ের ‘ড্রিমলাইনার’-এর জ্বালানি ট্যাঙ্কে ফের লিকেজ ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার তদন্তে নামে জাপানের পরিবহণ মন্ত্রক। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে ইথিয়োপিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রচণ্ড তাপে বিমানটির বেশ ক্ষতি হয়েছিল। ওই উড়োজাহাজটিরও মডেল নম্বর ছিল বোয়িং-৭৮৭। লিথিয়াম ব্যাটারিতে যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে ওই ঘটনা বলে জানা গিয়েছিল।
২০১৩ সালের অগস্টে জাপানি উড়ান পরিষেবা সংস্থা ‘অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ়’-এর ড্রিমলাইনার বিমানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি ধরা পড়ে। ২০২১ সালের জুন মাসে আবার হিথরো বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই বোয়িং ৭৮৭ মডেলটির নোজ় গিয়ার ভেঙে পড়ে। গত বছরের মার্চে ল্যাটাম এয়ারলাইন্সের একটি ড্রিমলাইনার বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় গুরুতর আহত হন ৫০ জন। সেই ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে বলে জানা গিয়েছে।
বোয়িং অবশ্য এই ঘটনাগুলিকে নিছক দুর্ঘটনা বলেই দাবি করেছে। শুধু তা-ই নয়, ড্রিমলাইনারকে ‘অত্যন্ত নিরাপদ’ তকমা দিতেও দু’বার ভাবেনি তারা। পাশাপাশি, কর্মী বা শ্রমিকদের উপর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এই মার্কিন সংস্থা। অন্য দিকে স্যামের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শেষ করে মার্কিন ‘ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ জানিয়ে দেয়, বোয়িং ৭৮৭ মডেলগুলি ওড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কিছুই নেই। ফলে অহমদাবাদ দুর্ঘটনার পর তাদের ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
২০১১ সালে ‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’কে বাজারে আনে বোয়িং। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই বিমানগুলির বডির ৫০ শতাংশ কার্বন-ফাইবার-রিইনফোর্সড পলিমার দিয়ে তৈরি। সামগ্রিক ভাবে উড়োজাহাজের ওজন কম রাখতে এটিকে ব্যবহার করেছে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা। সংশ্লিষ্ট মডেলটিতে দু’টি সংস্থার ইঞ্জিন ব্যবহার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সেগুলি হল, রোলস রয়েস এবং জেনারেল ইলেকট্রনিক্স।
অহমদাবাদের যে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাতে ছিল রোলস রয়েসের ট্রেন্ট-১০০০ ইঞ্জিন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট মডেলগুলিতে জেনারেল ইলেকট্রনিক্সের জিএনএক্স ইঞ্জিন ব্যবহার করেছে বোয়িং। দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি নিয়ে গত তিন-চার বছরে বেশ কিছু অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। বাতাসের তাপমাত্রা কমে গেলে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনগুলিতে সমস্যা ধরা পড়ছে বলে জানা যায়।
‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’-এর পূর্বসূরি ছিল বোয়িঙের ৭৬৭ মডেল। মার্কিন সংস্থাটির দাবি, আগের চেয়ে অনেক বেশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজটিতে ব্যবহার করেছে তারা। আর সেই কারণে ড্রিমলাইনার ওড়াতে ২০ শতাংশ বেশি জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এটি একবারে ১৩ হাজার ৫৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে বলেও জানা গিয়েছে।
২০১২ সালে ভারতীয় উড়ান পরিষেবা সংস্থাগুলির মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়াকেই প্রথম ‘ড্রিমলাইনার’ সরবরাহ করে বোয়িং। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার একটি কারখানায় তৈরি ৭৮৭-৮ মডেলটি টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ইউরোপ, আমেরিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার একাধিক রুটে বোয়িংয়ের এই বিমান বিপুল সংখ্যায় ব্যবহার হয় বলে জানা গিয়েছে।
কিছু দিন আগেই বোয়িং গর্ব করে জানিয়েছিল, ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলটি এ পর্যন্ত ১০০ কোটিরও বেশি যাত্রী পরিবহণ করেছে। বিশ্ব জুড়ে ১,১৭৫টিরও বেশি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার প্রায় ৫০ লক্ষ ফ্লাইট নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছে বলেও জানা গিয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ড্রিমলাইনারের ‘উত্তরসূরি’ ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমানকেও ‘অতি নিরাপদ’ বলে চিহ্নিত করেছিল বোয়িং। কিন্তু ২০১৮ থেকে ধারাবাহিক ত্রুটি ধরা পড়ায় এবং কয়েকটি দুর্ঘটনার জেরে বিশ্বের বেশ কিছু উড়ান সংস্থা ওই বিমানকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে।
অহমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, দুর্ঘটনার কারণ বিমানটির ভার এবং সেই সংক্রান্ত গণনায় ত্রুটি। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, অভিশপ্ত বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি ছিল। ফলে উড়োজাহাজ ওড়ার পর সেটি ঠিকমতো বন্ধ হয়নি। এই ল্যান্ডিং গিয়ারই বিমানের ভার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিমান ওঠানামার সময় রানওয়ের সংস্পর্শে আসে ল্যান্ডিং গিয়ার। এখান থেকে বেরিয়ে আসে বিমানের চাকা।
দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজতে ইতিমধ্যেই তদন্তে নেমেছে ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ বা ডিজিসিএ। বোয়িং জানিয়েছে, ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনার জন্য উড়ান পরিষেবা সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে সব ধরনের সাহায্য করবে তারা। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রুটির কথা স্বীকার করেনি এই মার্কিন সংস্থা।
অহমদাবাদের অভিশপ্ত বিমানে ছিলেন গুজরাতের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী-সহ মোট ২৪২ জন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে এখনও পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে। বাকিদের মৃত্যুর আশঙ্কাই প্রবল। যাত্রীদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, সাত জন পর্তুগিজ এবং এক জন কানাডার বাসিন্দা ছিলেন বলে জানিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া।