মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তিপ্রস্তাবে ‘সিলমোহর’। গাজ়া যুদ্ধে আপাতত দাঁড়ি টানল ইজ়রায়েল এবং হামাস। শুধু তা-ই নয়, সন্ধির শর্ত মেনে পণবন্দি ইহুদিদের ফিরিয়ে দিয়েছে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র সংগঠন। ফলে তেল আভিভ বা হাইফার মতো ইজ়রায়েলি শহরগুলিতে শুরু হয়েছে উৎসব। ট্রাম্পের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সেখানকার আমজনতা। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইতিহাসখ্যাত ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’-এর তুলনাও টেনেছেন তাঁরা।
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর গাজ়া যুদ্ধের সমাপ্তি এবং বন্দি প্রত্যর্পণের বিষয়টি স্পষ্ট হতেই ইজ়রায়েলি শহরগুলিতে পদযাত্রা করেন সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল ব্যানার-প্ল্যাকার্ড। সেখানে ট্রাম্পের ছবির পাশে লেখা আছে তিনটি শব্দ, ‘মহান সাইরাস জীবিত’। ইহুদিদের এই বিজয় মিছিল দেখে স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে একটি প্রশ্ন— কে এই ‘মহান সাইরাস’? তাঁর সঙ্গে ইজ়রায়েলের সম্পর্কই বা কী?
পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি রাষ্ট্রটির ইতিহাসে সাইরাসের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁর হাত ধরেই একসময় জেরুজ়ালেমে গড়ে ওঠে তাঁদের পবিত্র উপাসনাস্থল ‘সেকেন্ড টেম্পল’। এর পশ্চিম দিকের দেওয়ালটি এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, যার পোশাকি নাম ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’। সংশ্লিষ্ট দেওয়ালটি আবার মুসলিমদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদের ভিতরে অবস্থিত। ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের মূল বীজ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে, একসময় পারস্য সাম্রাজ্যের (অধুনা ইরান) শক্তিশালী রাজা ছিলেন দ্বিতীয় সাইরাস। তাঁর নামের সঙ্গে ‘দ্য গ্রেট’ বা ‘মহান’ উপাধি অবশ্য গ্রিক দার্শনিকদের দেওয়া। উপসাগরীয় দেশটিতে আখামেনিড শাসন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি, যা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ পর্যন্ত চলেছিল। তৎকালীন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইরাস বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এর বিস্তার ছিল ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর এবং তুরস্কের কিছু অংশ নিয়ে।
সাইরাসের সামরিক অভিযানগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ব্যাবিলন দখল। বর্তমান ইরাক এবং এশিয়ার মাইনরের কিছুটা অংশ জুড়ে সেটা গড়ে উঠেছিল। পারস্য সম্রাট সেটা কব্জা করেন ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাঁর হাতে পরাস্ত হন ব্যাবিলনের তৎকালীন শাসক ন্যাবোনিডাস। এই লড়াই শেষ হতে না হতেই ব্যাবিলনে বন্দি থাকা সমস্ত ইহুদিকে মুক্তি দেন সাইরাস। ফলে জেরুজ়ালেমের জন্মভূমিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন তাঁরা।
ন্যাবোনিডাসের পূর্বসূরি আবার ছিলেন দ্বিতীয় নেবুচাদনেজ়র। তাঁর সময়কালকে (খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫-৫৬২) ব্যাবিলনীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগ বললে অত্যুক্তি হবে না। ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিম এশিয়ার জুডা দখল করে তাঁর বাহিনী। এটি প্রকৃতপক্ষে ছিল ইহুদি অধ্যুষিত একটি এলাকা এবং স্বশাসিত রাজ্য। তৎকালীন জুডা বর্তমানে ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইন, জর্ডন এবং সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এর বিস্তার ছিল এক দিকে ভূমধ্যসাগর এবং অপর দিকে প্রায় ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জুডাহ্ শাসন করতেন ইহুদি রাজারা। তাঁদের রাজধানী ছিল জেরুজ়ালেম। সেখানে প্রধান উপাসনাস্থল হিসাবে একটি মন্দির নির্মাণ করেন তাঁরা। পরবর্তী কালে ইতিহাসবিদেরা একে চিহ্নিত করেন ‘ফার্স্ট টেম্পল’ হিসাবে। দ্বিতীয় নেবুচাদনেজ়রের বাহিনীর হাতে ইহুদি রাজ্যটির পতন হতেই রাজধানী জ়েরুজ়ালেমে শুরু হয় মারাত্মক লুটপাট। হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী রাজা ন্যাবোনিডাসের শাসনকালে আরও দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের।
ব্যাবিলনীয় রাজাদের অধিকাংশই ছিলেন ইহুদি ধর্মের ঘোরতর বিরোধী। ন্যাবোনিডাসের রাজত্বকালের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলিতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ওই সময়কালের বহু মাটির ফলক বর্তমানে ব্রিটিশ জাদুঘরগুলিতে সংরক্ষিত রয়েছে। অপ্রচলিত ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে কী কী শাস্তি পেতে হবে, সেখানে তার স্পষ্ট বিবরণ পেয়েছেন ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। অন্য দিকে সাইরাস ছিলেন অনেকটাই উদার।
আর তাই ব্যাবিলন দখলের পর পারস্য সম্রাট ইহুদিদের মুক্তি দিলে প্রায় ৫০ বছর পর ফের জুডায় ফেরেন তাঁরা। ইহুদিদের বাইবেলে এই ঐতিহাসিক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। সেখানে আরও বলা আছে যে স্বয়ং ঈশ্বরের থেকে জেরুজ়ালেমের ‘সেকেন্ড টেম্পল’ পুনর্নির্মাণের নির্দেশ পান সাইরাস, দ্বিতীয় নেবুচাদনেজ়র যা ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
ইহুদিদের বিশ্বাস, তাঁদের মুক্তির জন্য সাইরাসকে পৃথিবীকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। তবে তিনি নিজে ইহুদি ছিলেন না। অন্য পারস্য সম্রাটদের মতোই সাইরাস ছিলেন জ়রথ্রুস্টের প্রচার করা ধর্মের উপাসক। মূলত তাঁর উদ্যোগেই জেরুজ়ালেমে গড়ে ওঠে ‘সেকেন্ড টেম্পল’। পরবর্তী দশকগুলিতে সেখানে শান্তিতে বসবাস করার ক্ষেত্রে ইহুদিদের কোনও সমস্যা হয়নি।
সাইরাসের আমল থেকেই পশ্চিম এশিয়ায় স্বায়ত্তশাসন পেয়েছিলেন বর্তমান ইজ়রায়েলিদের পূর্বসূরিরা। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের পর ফের ইহুদিদের জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। সেখানকার শাসকদের নজর তখন পড়েছে নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতার উপর। ফলে একের পর এক সামরিক অভিযান পাঠিয়ে জেরুজ়ালেম দখল করেন জাঁদরেল রোমান জেনারেলরা। পাশাপাশি, তাঁদের হাতেই ভাঙা পড়ে ‘সেকেন্ড টেম্পল’। সময়টা ছিল ৭০ খ্রিস্টাব্দ।
রোমানদের হাতে ‘সেকেন্ড টেম্পল’ ধ্বংস হওয়ার পর পশ্চিম এশিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বাস্তুচ্যুত হয় ইহুদি সম্প্রদায়। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের একাধিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আশ্রয় নেন সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউরোপীয় দেশগুলি অবশ্য ইহুদিদের নিজের বলে গ্রহণ করেনি। বহু ক্ষেত্রে সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে থাকতে হয়েছিল তাঁদের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫ সাল) পর রাষ্ট্রপুঞ্জের সিদ্ধান্ত মেনে পশ্চিম এশিয়ার আরব দুনিয়ায় জন্ম হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইজ়রায়েলের। এর পরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে দলে দলে ইহুদিরা আসতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েও তেল আভিভ কখনও দয়ালু সাইরাসকে ভোলেনি। এখনও তাঁদের ইতিহাসে বড় জায়গা জুড়ে আছে এককালের পারস্য দেশের এই মহান সম্রাট।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এতে ১,২০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন নারী ও শিশু। এ ছাড়া বেশ কয়েক জন ইহুদিকে পণবন্দি করে গাজ়ায় নিয়ে যান হামাসের যোদ্ধারা। গত দু’বছর ধরে টানা যুদ্ধ লড়েও তাঁদের উদ্ধার করতে পারেনি ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। ফলে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপর ঘরে-বাইরে বাড়ছিল চাপ।
এই পরিস্থিতিতে শান্তিপ্রস্তাবের প্রসঙ্গ তোলেন ট্রাম্প। এর প্রাথমিক শর্তগুলি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানায় হামাস। ১৩ অক্টোবর ইজ়রায়েল সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে ইহুদি রাষ্ট্রে তাঁর পা পড়ার আগেই দু’দফায় ২০ জন পণবন্দিকে মুক্তি দেয় প্যালেস্টাইনি ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী। পরে সব পণবন্দিকেই মুক্তি দেয় হামাস। আর তাই এই ঘটনাকে ‘মহান’ সাইরাসের ব্যাবিলন দখলের পর বন্দি ইহুদিদের ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন তেল আভিভ বা হাইফার বাসিন্দারা।
পশ্চিম এশিয়া সফরে গিয়ে ইজ়রায়েলি পার্লামেন্ট ‘নেসেট’-এ ভাষণ দেন ট্রাম্প। সেখানে গাজ়ায় শান্তিপ্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে ‘ঐতিহাসিক ভোর’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, “এখন আকাশ শান্ত। বন্দুকের আওয়াজ থেমে গিয়েছে। পবিত্র ভূমিতে শান্তি এসেছে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ট্রাম্পের আগে ইহুদিদের এই আইনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন আরও তিন জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৯ সালে জিমি কার্টার, ১৯৯৪ সালে বিল ক্লিন্টন এবং ২০০৮ সালে জর্জ বুশ।
‘নেসেট’-এ ট্রাম্পের ভাষণ সম্পূর্ণ ভাবে মসৃণ ছিল এমনটা নয়। তিনি ভাষণ দেওয়ার সময়ে আয়মেন ওদেহ এবং ওফের কাসিফ নামে দুই বামপন্থী সদস্য প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ফলে কথা বলা থামাতে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আসেন নিরাপত্তারক্ষীরা। দুই বিক্ষোভকারীদের তুলে ইজ়রায়েলের আইনসভার বাইরে নিয়ে যান তাঁরা।
গোটা ঘটনার জন্য ট্রাম্পের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন আইনসভার স্পিকার আমির ওহানা। এর পরে বক্তৃতা শেষ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে ‘নেসেট’-এর নিরাপত্তারক্ষীদের ‘দক্ষতা’র প্রশংসা করতে ভোলেননি তিনি। ট্রাম্পের পর আইনসভায় ভাষণ দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যাতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন, তার জন্য গোটা বিশ্বে দৌত্য চালাবে ইজ়রায়েল।
এ ছাড়া শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে সোনার পায়রা তুলে দেন নেতানিয়াহু। পাশাপাশি, বন্দি বিনিময়ের শর্ত হিসাবে তাদের জেলগুলিতে বন্দি থাকা প্রায় দু’হাজার প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দিচ্ছে ইজ়রায়েল। ফলে পশ্চিম এশিয়ার সংঘর্ষে আপাতত পুরোপুরি ইতি পড়ল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে এত কিছুর পরেও থেকে যাচ্ছে একটা কাঁটা। সাইরাসের বদান্যতায় তৈরি ‘সেকেন্ড টেম্পল’-এর যে দেওয়াল এখনও টিকে আছে সেখানে ফের মন্দির তৈরির ঘোষিত রাষ্ট্রীয় নীতি রয়েছে ইজ়রায়েলের। এই বিষয়ে আপত্তি আছে ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং প্যালেস্টাইনবাসীদের। ট্রাম্পের নামের সঙ্গে সেই মহান পারস্য সম্রাটের নাম জুড়ে বিতর্কে আগুনে ফের ঘি ঢালল ইহুদিরা? এর উত্তর দেবে সময়।