Swiss Bank

গ্রাহক তালিকায় নাম ছিল স্বয়ং হিটলারের! ‘কালো টাকা’ লুকোতে কেন ধনকুবেরদের সবচেয়ে বড় ভরসা ‘নিরপেক্ষ’ সুইস ব্যাঙ্ক?

ফ্রান্স, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া দিয়ে ঘিরে থাকা সুইৎজ়ারল্যান্ডের নেই কোনও সেনাবাহিনী। কিন্তু তার পরেও দুনিয়ার তাবড় বিত্তশালীরা টাকা ও সোনা গচ্ছিত রাখেন সেখানকার ব্যাঙ্কগুলিতে। কিন্তু কেন?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:৪৬
Share:
০১ ২০

ধনকুবের শিল্পপতি থেকে বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতা। বিত্তবান ক্ষমতাশালীদের মধ্যে রয়েছে সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে টাকা বা সোনা গচ্ছিত রাখার প্রবণতা। কেন নিজের দেশের ব্যাঙ্ককে ভরসা করেন না তাঁরা? ‘কালো টাকা’ লুকিয়ে রাখতেই কি ব্যবহার করা হয় এই ইউরোপীয় দেশটির যাবতীয় ব্যাঙ্ক? সুইৎজ়ারল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের জবাব রইল আনন্দবাজার ডট কম-এর এই প্রতিবেদনে।

০২ ২০

সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এর গোপনীয়তা। গ্রাহকের কোনও তথ্য কখনওই ফাঁস করে না তারা। ফলে কোন ব্যক্তি কখন, কত টাকা সেখানে রাখছেন, তা জানার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্স, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া দিয়ে ঘেরা স্থলবেষ্টিত সুইৎজ়ারল্যান্ড একটি ‘নিরপেক্ষ’ দেশ। ফলে এক দিকে যেমন যে কেউ সেখানে টাকা রাখতে পারেন, অন্য দিকে তেমনই সেই অর্থ বেহাত হওয়ার বা কোনও সামরিক জোটে চলে যাওয়ার ঝুঁকি নেই।

Advertisement
০৩ ২০

খ্রিস্টীয় ১৭ শতকে পথচলা শুরু করে সুইস ব্যাঙ্ক। ওই সময় ইউরোপের অভিজাত শ্রেণিকে রক্ষা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এর পর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে মজবুত করতে ১৭১৩ সালে সুইস পার্লামেন্ট ‘গ্রেট কাউন্সিল অফ জেনেভা’য় পাশ হয় বিশেষ গোপনীয়তার আইন। প্রতিবেশী ফ্রান্সের ব্যাঙ্কগুলি তখন চালাচ্ছে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। আর তাই সেখানে টাকা রাখতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না ক্যাথলিক খ্রিস্টান ফরাসি রাজা।

০৪ ২০

১৭৮০ সালে সুইস ব্যাঙ্কে রাখা যাবতীয় সম্পত্তিকে বিমার আওতায় আনা হয়। ফলে এতে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছিল। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধে কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের চূড়ান্ত পরাজয় হলে ইউরোপের রাজনীতিতে আসে বড় বদল। ওই সময় নিজেদের একটি ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হিসাবে ঘোষণা করে সুইৎজ়ারল্যান্ড। ফলে পরবর্তী সময়ে কোনও সামরিক জোটেরই অংশ হতে দেখা যায়নি জেনেভাকে।

০৫ ২০

১৮৪৮ সালে ছোটখাটো একটা গৃহযুদ্ধের পর তৈরি হয় সুইস ফেডারেশন। এর মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে চলে যায় আল্পসের কোলের ওই ইউরোপীয় দেশ। এতে রাজনৈতিক ভাবে স্থিতিশীলতা পেয়েছিল জেনেভা। ফলে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে মজবুত করতে কঠোর গোপনীয়তার আইন তৈরি করা এবং তা মেনে চলার ক্ষেত্রে তাদের তেমন অসুবিধা হয়নি। বিষয়টি গ্রাহকদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল।

০৬ ২০

তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-’১৮) সুইস ব্যাঙ্কের ব্যবসাকে আরও রমরমিয়ে তুলেছিল। ওই সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কগুলির কর্তাব্যক্তিরা ঘন ঘন ফ্রান্স এবং জার্মানি সফর করেন। মূলত এই দুই দেশের অভিজাত এবং ধনীদের গ্রাহক হিসাবে পেতে চেয়েছিলেন তাঁরা। এর জন্য গোপনীয়তার আইনের ঢালাও প্রচার চালাতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের। যুদ্ধের অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে তাঁরাও দলে দলে সুইৎজ়ারল্যান্ডের ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা রাখতে শুরু করেন।

০৭ ২০

সে সময় যুদ্ধের খরচ মেটাতে বিশেষ একটি কর নিচ্ছিল ইউরোপের বহু দেশ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিজাত শ্রেণির থেকে মোটা টাকা আদায়। ফলে ওই কর ফাঁকি দিতে সুইস ব্যাঙ্কে ভিড় জমাতে শুরু করেন তৎকালীন ধনকুবেরদের একাংশ। ১৯৩৪ সালে গোপনীয়তার আইনে বড় বদল করে সুইস সরকার। সেখানে বলা হয়, তথ্য ফাঁস হলে দেওয়ানি নয়, এ বার থেকে ফৌজিদারি ধারায় অভিযুক্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিকের বিচার হবে। এতে জেনেভার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলির বিশ্বাস কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।

০৮ ২০

১৯৩৩ সালে অ্যাডল্‌ফ হিটলার ক্ষমতায় এলে জার্মানিতে শুরু হয় ইহুদি নিধন। এই ঘটনার সর্বাধিক প্রভাব পড়ে সুইস ব্যাঙ্কের উপর। ইহুদি ব্যবসায়ীরা তাঁদের অর্থ লুকিয়ে রাখতে জেনেভার ব্যাঙ্কগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ১৯৩৯-’৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইৎজ়ারল্যান্ড’-এ (ইউবিএস) ১১০ কোটি রেইশমার্ক (তৎকালীন জার্মান মুদ্রা) জমা রাখেন স্বয়ং হিটলার। এ ছাড়া তাঁর সহযোগী নাৎসি নেতারাও অর্থ লুকিয়ে রাখতে জেনেভার ব্যাঙ্কগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন।

০৯ ২০

সুইস ব্যাঙ্কগুলিতে ইহুদিদের অর্থ গচ্ছিত থাকার বিষয়টিকে কখনওই ভাল চোখে দেখেননি হিটলার। আর তাই ১৯৪০ সাল নাগাদ সুইৎজ়ারল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন তিনি। পরে অবশ্য জার্মান জেনারেলদের সঙ্গে পরামর্শে সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয় তাঁকে। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, জেনেভার ব্যাঙ্কগুলিতে তাঁর নিজেরই টাকা গচ্ছিত থাকায় এই অভিযানের ঝুঁকি নিতে চাননি বার্লিনের ফ্যুয়েরার।

১০ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইহুদিদের সম্পত্তি উদ্ধারে নেওয়া হয় একাধিক পদক্ষেপ। এতে সুইস ব্যাঙ্কগুলির উপর চাপ বেড়েছিল। ৯০-এর দশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে হিটলারের জমা করা অর্থ ফেরত চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জেনেভা কিন্তু সেই টাকা দিতে রাজি হয়নি। উল্টে নিয়ম মেনে যাবতীয় অর্থ জার্মানিকেই ফিরিয়ে দেয় তারা। ফলে টোল খায়নি গ্রাহকদের বিশ্বাস।

১১ ২০

২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়লে ফের পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে গোপনীয়তা সংক্রান্ত আইন ফের বদলায় সুইস পার্লামেন্ট। এ বার ব্যাঙ্কের গোপন তথ্য ফাঁস করলে ছ’মাসের বদলে পাঁচ বছরের জেলের বিধান রাখা হয় তাতে। তার পরেও জেনেভার ব্যাঙ্কগুলির ভিতরের খবর কখনওই বাইরে আসেনি, সেটা ভাবলে ভুল হবে।

১২ ২০

সুইস ব্যাঙ্কের রমরমা ব্যবসায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেন মার্কিন নাগরিক ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ড। ২০০১ সালে জেনেভার ইউবিএসে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থের বিষয়গুলি দেখভাল করতেন তিনি। ২০০৫ সালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলার কারণে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন বার্কেনফিল্ড। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে যোগাযোগ করেন সেখানকার বিচারবিভাগের সঙ্গে।

১৩ ২০

মার্কিন বিচারবিভাগকে সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমেরিকানদের ‘কালো টাকা’র সন্ধান দেন বার্কেনফিল্ড। তড়িঘড়ি তদন্তে নামে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। তাতে জানা যায়, শুধুমাত্র ইউবিএসে ১,৮০০ থেকে দু’হাজার কোটি ডলার লুকিয়ে রেখেছেন ১৯ হাজারের বেশি মার্কিন নাগরিক। এর জন্য জেনেভার ব্যাঙ্কটির উপর ৭৮ কোটি ডলারের জরিমানা চাপিয়ে দেয় ওয়াশিংটন।

১৪ ২০

সুইস ব্যাঙ্কের গোপন তথ্য ফাঁস করে বার্কেনফিল্ড বেঁচে গিয়েছিলেন এমনটা নয়। কর ফাঁকির অভিযোগে ২০০৯ সালে জেল হয় তাঁর। ২০১২ সালে সেখান থেকে মুক্তি পান তিনি। ওই সময় সুইস ব্যাঙ্কের গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য ১০.৪ কোটি ডলার পেয়েছিলেন তিনি। অন্য দিকে গণমাধ্যমে গোটা ঘটনাটি পরিচিতি পায় ‘বার্কেনফিল্ড ডিসক্লোজ়ার’ হিসাবে।

১৫ ২০

২০০৯ সালে সুইস ব্যাঙ্ক ইউবিএসের বিরুদ্ধে মামলা করে মার্কিন সরকার। ওই বছরই জেনেভা সফরে যান যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। মোট ৫২ হাজার আমেরিকান নাগরিকের ব্যাঙ্কের তথ্য চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গোপনীয়তার আইনকে সামনে রেখে সেটা প্রকাশ করতে রাজি হয়নি সুইস সরকার। শেষে ওয়াশিংটনের চাপে মাত্র সাড়ে চার হাজার গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে তারা।

১৬ ২০

সুইস ব্যাঙ্কে ‘কালো টাকা’ গচ্ছিত রাখার বিষয়টি বন্ধ করতে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা। তাঁর আমলে পাশ হয় ‘বিদেশি অ্যাকাউন্ট কর সম্মতি আইন’ (ফরেন অ্যাকাউন্টস ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট)। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কোনও ব্যাঙ্কে টাকা বা সম্পত্তি গচ্ছিত রাখলে বাধ্যতামূলক ভাবে তার তথ্য প্রকাশ করতে বলা হয়েছিল।

১৭ ২০

ক্ষমতায় থাকাকালীন সুইৎজ়ারল্যান্ডকে হুমকি দেন ওবামা। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ না করলে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করবে ওয়াশিংটন। এতে অবশ্য প্রবল চাপের মুখে পড়ে ওই ইউরোপীয় দেশে। ফলে বাধ্য হয়ে গোপনীয়তার বিষয়টি থেকে কিছুটা সরে আসে জেনেভা। তবে তার পরেও সেখানকার ব্যাঙ্কগুলির থেকে ভরসা হারাননি দুনিয়ার ধনকুবের শিল্পপতিরা।

১৮ ২০

যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো রাস্তায় পরবর্তী কালে হাঁটা শুরু করে একাধিক ইউরোপীয় দেশ। ২০১৫ সালে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ব্রিটেনের সঙ্গে রুবিক চুক্তিতে সই করে সুইস সরকার। এতে বলা হয়, কোনও ব্যক্তি দেশের যাবতীয় কর মিটিয়ে দিলে সুইস ব্যাঙ্কে রাখা অর্থের তথ্য গোপন রাখতে পারবেন। এতে জেনেভার লাভই হয়েছিল।

১৯ ২০

শোনা যায়, বর্তমানে অলিগার্কি নামের রুশ অভিজাত শ্রেণি, চিনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদাধিকারী এবং মার্কিন ধনকুবেরদের বিপুল সম্পত্তি গচ্ছিত আছে সুইস ব্যাঙ্কে। গত কয়েক বছরে দুনিয়া জুড়ে বেড়েছে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা। তার জেরে জেনেভার ব্যাঙ্কগুলির সম্পত্তি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।

২০ ২০

সুইস ব্যাঙ্কের ভল্ট নিয়ে অবশ্য ইউরোপে একাধিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, টাকা এবং সোনা সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ধরনের বাঙ্কার তৈরি করেছে জেনেভার যাবতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কারও মতে আল্পসের দুর্গম এলাকায় রয়েছে তাদের ভল্ট। গোপনীয়তার আইনের জন্যই এর কোনটা সত্যি তা আজও জানা যায়নি।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement